সংঘাতের পথে না হেঁটে সরকারের লেখা ভাষণ হুবহু পড়লেন রাজ্যপাল

শুক্রবার রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া ভাষণ বিধানসভায় হুবহু পড়ে দিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। ভাষণ নিয়ে একটি তির্যক মন্তব্যও শােনা গেল না রাজ্যপালের মুখ থেকে।

Written by SNS Kolkata | February 8, 2020 4:22 pm

বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। (Photo: IANS)

সব জল্পনার অবসান। রাজ্যপালের ভবিষ্যৎবাণীর ‘ইতিহাস’ বােধহয় থমকে গেল সংবিধানের বেড়াজালে। শুক্রবার রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া ভাষণ বিধানসভায় হুবহু পড়ে দিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। ভাষণ নিয়ে একটি তির্যক মন্তব্যও শােনা গেল না রাজ্যপালের মুখ থেকে।

শুধু তা-ই নয় বিধানসভা থেকে বেরিয়ে রাজ্যপাল এদিন টুইটও করেন। যেখানে তিনি নিজেই জানিয়েছেন সংবিধানের মর্যাদা রেখেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও বিবাদে যেতে চাননি। তার আশা সকলেই সংবিধানের প্রতি আনুগত্য দেখাবেন। এভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ বাড়িয়ে মানুষের সেবা করা যায়। পরিবর্তে এদিন রাজ্যপালের ভাষণের সূত্র ধরে রাজ্য সরকারের সমালােচনা করতে দেখা গেল বাম-কংগ্রেস বিরােধী দলনেতাদের। রাজ্য ও রাজ্যপালের বিবাদকে লােকদেখানাে বলেও কটাক্ষ করেন বিরােধীরা।

শুক্রবার সকাল থেকেই বিধানসভায় অতি সক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতাে। বেলা বারােটায় বিজনেস অ্যাডভাইসরি কমিটির বৈঠক থেকেই রাজ্যপালের ভাষণ নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কা নিয়ে ফিসফাস শােনা যাচ্ছিল। এবার বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণের সময় চিত্র-সাংবাদিকদের সভাকক্ষে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বিজনেস অ্যাডভাইসরি কমিটির বৈঠকের পরে তৃণমূলের পরিষদীয় দলের বৈঠক হয় বিধানসভার নৌশাদ আলি কক্ষে। সেখানে বিধানসভার চিফ হুইপ নির্মল ঘােষের নির্দেশে রাজ্যপালের ভাষণের সময় সবাইকে সংযত থাকতে বলা হয়।

কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে নিজের আসনে বসে প্রতিবাদ জানালেও কোনওভাবেই আসনত্যাগ করে ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ জানাতে বারণ করে দেওয়া হয়। তৃণমূল বিধায়কদের এদিন সংবিধানের মূল প্রস্তাবনা লেখা অ্যাপ্রন, নাে সিএএ, নাে এনআরসি লেখা হেয়ার ব্যান্ড বিতরণ করা হয়। সেইসব অ্যাক্সেসরিজ পরেই তৃণমূল বিধায়কদের বিধানসভায় এদিন বসে থাকতে দেখা যায়।

শুক্রবার বেলা ১:৫০ মিনিটে বিধানসভায় প্রবেশ করেন রাজ্যপাল। অধিবেশনের শুরুতে বিধানসভায় প্রবেশের সময় মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভিবাদন জানান। বাজেট অধিবেশনে রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া দীর্ঘ বক্তব্য পড়তে শুরু করেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। ভাষণের প্রথমাংশে প্রয়াত মানুষদের প্রতি শােকজ্ঞাপন। যেখানে অসম’সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এনআরসি আতঙ্কে কিংবা সিএএ-এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারানাে মানুষদের কথাও রাজ্যপাল পড়লেন শােকাহত নিচু স্বরে।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যেপাধ্যায়কে ডিলিট দেওয়ার অংশটি পড়ার সময়ও রাজ্যপালের গলায় বিন্দুমাত্র ক্ষোভের আভাস পাওয়া দেল না। কেন্দ্রীয় সরকারের ভ্রান্ত নীতি প্রসূত নােটবন্দি, অপরিকল্পিতভাবে জিএসটি লাগু, আর্থিক মন্দার প্রসঙ্গ পাঠের সময়ও এতটুকু কেপে গেল না রাজ্যপালের কণ্ঠস্বর। উল্টে রাজ্যের দেওয়া তথ্য অবিকল পাঠ করে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় বলেন, দেশে ৪৫ বছরে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি হয়েছে। একই সঙ্গে রাজ্যে বেকারত্ব কমেছে ৪০ শতাংশ। রাজ্যপাল এদিন বলেন, গত এক বছরে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা ছিল শান্তিপূর্ণ, সেই ধরনের কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে এর আগে রাজ্যপাল বহুবার নেতিবাচক কথা বললেও শুক্রবার বিধানসভায় এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের প্রশস্তিই করতে হল তাঁকে। শুধ রাজ্য সরকারই নয়, অনগ্রসর শ্রেণির মানুশ যে মখ্যমন্ত্রী সক্রিয় এবং উদ্যোগী নেতৃত্বেই উন্নয়নের মুখ দেখেছে সেকথা একটু কেশে নিয়ে নিজমুখে স্বীকার করে নিতে হয় রাজ্যপালকে। জঙ্গলমহলে রাজ্য সরকারের চালু করা বিশেষ প্যাকেজ, পাহাড়ে জিটিএ-এর সহযােগিতায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাজ্য সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করতে শােনা যায় রাজ্যপালকে।

এদিন রাজ্যপাল তাঁর অবাঙালি টানের উচ্চারণে রাজ্যের একাধিক প্রকল্পের খাদ্যসাথী, সবুজ সাথী, কন্যাশ্রী, জীবনশক্তি, ঐক্যশ্রী, নিজশ্রী, কৃষক বন্ধন, ধান দিন চেক নিন, জল ধরাে, জল ভরাে, মাভৈঃ ইত্যাদি প্রকল্পের কথা তুলে ধরেন তার ভাষণে। বাঙালি নামের প্রকল্পের উচ্চারণ করতে গিয়ে কখনও তিনি হোঁচট খেয়েছেন (মাভৈঃ প্রকল্পের ক্ষেত্রে), কখনও তার অনভ্যস্ত বাংলা উচ্চারণে ‘ধান’ হয়ে গিয়েছে ‘ধন’, কখনও ‘জল’ হয়েছে ‘জাল’। কিন্তু তবুও তিনি একনাগাড়ে পড়ে গিয়েছেন রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া বক্তব্য। যার সিংহভাগ জুড়ে ছিল তথ্য ও পরিসংখ্যান সহযােগে রাজ্য সরকারের প্রকল্পগুলির সাফল্যের খতিয়ান।

তবে রাজ্যপালের ভাষণের একদম শেষাংশে ছিল দেশের বর্তমান সংকটময় অবস্থার কথা। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যে গণতন্ত্রকে বিঘ্নিত হচ্ছে, দেশপ্রেমের নাম করে ধর্মীয় অখণ্ডতাকে ধ্বংস হচ্ছে, দেশজোড়া অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ সৃষ্টি হচ্ছে, কেন্দ্র বিরােধী সেইসব কথাগুলিও শুক্রবার পড়ে যেতে হয় রাজ্যপালকে। এমনকী কেন্দ্রীয় সরকার যে এনআরসি, সিএএ এবং এনপিআর-এর নাম। করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছে তাও উচ্চারণ করতে হয় বিজেপি মনােনীত রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে।

শুধু তা-ই নয় সিএএ প্রত্যাহারের জন্য শাসক তৃণমূল সরকারের এই আইন প্রত্যাহারের দাবির কথাও রাজ্যপালের মুখ দিয়েই উচ্চারিত হয়। যদিও ভাষণের এই শেষাংশ পড়বার সময় রাজ্যপালের গলা নেমে গিয়েছিলেন অত্যন্ত নিচুগ্রামে। দু একবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে নেন রাজ্যপাল। তবে শেষ পর্যন্ত ভাষণ নিয়ে রাজ্য ও রাজ্যপালের মধ্যে কোনও বাকযুদ্ধই বাঁধেনি। যদিও এর মধ্যেই তৃণমূল বিধায়কদের আসন থেকে উড়ে আসতে থাকে প্রত্যাশিত বিবাদ-বিতর্ক না ঘটায় নানান টিকা-টিপ্পনি। তবে শেষ পর্যন্ত ‘শান্তি শান্তি’ করেই শেষ হয় রাজ্যপালে ভাষণ পাঠ।

রাজ্য সরকারের লিখে দেওয়া দীর্ঘ ভাষণ পাঠ করে বিরােধী দলনেতাদের আসনের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে করমর্দন করতেও দেখতে যায় রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে। এরপর ‘গলা ভিজিয়ে নিতে’ স্পিকারের আমন্ত্রণে তার ঘরে গিয়ে চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেও দেখা গেল রাজ্যপালকে নজিরবিহীনভাবে। তবে প্রথা ভাঙলেও নতুন কোনও ইতিহাস গড়া হল না বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাজ্যপালের ভাষণে।