আরজি করে সেই ভয়াবহ রাতের ঘটনার পর কেটে গেছে দীর্ঘ ৫টি মাস। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় শনিবার রায়দান করতে পারে শিয়ালদহ আদালত। নিম্ন আদালতের এই রায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বাংলা–সহ গোটা দেশ। ফাঁসি নাকি যাবজ্জীবন, মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নিয়তি কী হবে তার রায় দেবেন বিচারক। সেই রায়ের প্রতীক্ষায় গোটা দেশ।
সুপ্রিম কোর্টে নির্যাতিতার বাবা-মা জানিয়েছেন, এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা হয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন না যে, এই ঘটনায় একা সঞ্জয় রায় দোষী। সিবিআই তদন্তের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে যথাযথ তদন্তের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন নির্যাতিতার বাবা–মা। বুধবার তাঁদের হয়ে এই মামলা দায়ের করেন আইনজীবী করুণ নন্দী। দেশের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার এজলাসে মামলার আবেদন জমা পড়েছে। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে নির্যাতিতার বাবা বলেন যে, তিনি ন্যায়বিচারের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে প্রস্তুত। ‘আমরা ভিক্ষা করব না কিন্তু আমরা লড়াই করব এবং প্রয়োজন হলে ন্যায়বিচার ছিনিয়ে নেব।’
জুনিয়র চিকিৎসক দেবাশিস হালদার ওই সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘ডিএনএ এবং সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি রিপোর্ট নিয়ে আমাদের প্রশ্ন। উদ্দেশ্য কী ছিল? কারা কারা জড়িত ছিল? একা কি এই অপরাধ করা সম্ভব? কেন প্রমাণ নষ্ট করা হল? কারা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল যে, ওই তরুণী চিকিৎসক আত্মহত্যা করে মারা গেছে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। আমরা চাই অন্য যারা জড়িত ছিল তাদের খুঁজে বের করা হোক, নয়তো ন্যায়বিচার সম্পূর্ণ হবে না। আমরা সিবিআই-এর উপর আস্থা রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু প্রমাণ নষ্টের দায়ে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়নি কেন, তার কোনও উত্তর দেয়নি সিবিআই।’
এর আগে সম্প্রতি শিয়ালদহ আদালতে নিজেদের বক্তব্য পেশ করেন নির্যাতিতা চিকিৎসকের
বাবা–মা। ৫৭ পৃষ্ঠার একটি বয়ান জমা দেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, সঞ্জয় একা নয়, মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের মামলায় আরও কয়েকজন যুক্ত রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, যারা যারা এই ঘটনায় যুক্ত, তাদের খুঁজে বের করতে আরও তদন্ত হোক। সেই মতো যাতে চার্জশিট পেশ করা হয় সেই আর্জি জানিয়েছেন তাঁরা।
সিবিআই নিশ্চিত করেছে যে, আরজি কর কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ই দোষী। এই আবহে ধৃতের ‘ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট’ মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছেে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সঞ্জয়ের ফাঁসির আর্জি জানায় সিবিআই। সেই রায়ের আগেই শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন নির্যাতিতার বাবা–মা। তাঁদের আর্জি, উচ্চ আদালতে এই মামলার শুনানিতে যেন পদ্ধতিগত বাধা দূর করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
২০২৪ এর ৮ আগস্ট। নাইট ডিউটিতে ছিলেন সোদপুরের বাসিন্দা তরুণী চিকিৎসক। ওই রাতেই শেষবারের মতো মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হয় তাঁর। ৯ আগস্ট মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পান বাবা–মা। হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। অভিযোগ, ধর্ষণ করে খুন করা হয় তাঁকে। তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশ ১০ আগস্ট এই ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করে।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্য তথা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই পরিস্থিতিতে গত ১২ আগস্ট নির্যাতিতার বাড়িতে যান মুখ্যমন্ত্রী। শোকস্তব্ধ পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের আশ্বাস দেন। ইতিমধ্যে কলকাতা হাই কোর্টে সিবিআই তদন্তের দাবিতে মামলা হয়। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ আগস্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।
ঘটনার নৃশংসতার প্রতিবাদে এবং তরুণী চিকিৎসকের সুবিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে কলকাতা। গত ১৪ আগস্ট রাতদখল করেন মহিলারা। অংশ নেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। ওই রাতেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। গত ১৮ আগস্ট এই ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের হয়। সিপি বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের দাবিতে সরব হন চিকিৎসকরা। গত ২ এবং ৩ সেপ্টেম্বর জুনিয়র চিকিৎসকরা লালবাজার অভিযান করেন। ১০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান আন্দোলন শুরু করেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকের ডাক দেন। তবে দুদিনই ভেস্তে যায় বৈঠক। ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে স্বাস্থ্যভবনে চিকিৎসকদের অবস্থান মঞ্চে পৌঁছে যান মমতা। ‘দিদি’ হিসাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আন্দোলনরত চিকিৎসকদের কাছে আন্দোলন প্রত্যাহারের আর্জি জানান।