নিমতাকাণ্ডে খুনের কথা স্বীকার করলেও প্রিন্সের বয়ান নিয়ে ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য

দেবাঞ্জন দাসের খুনের ঘটনায় প্রথম থেকেই উঠে আসছিল ত্রিকোণ প্রেমের তত্ত্ব। দেবাঞ্জনের বাবাও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ক্রিকোণ প্রেমের কারণেই খুন হয়েছে তাঁর ছেলে।

Written by SNS Barrackpore | October 21, 2019 12:52 pm

প্রতীকী ছবি (Photo: IANS)

নবমীর গভীর রাতে নিমতার বিরাটি রেলগেট সংলগ্ন এলাকায় ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়া দমদম ঘুঘুডাঙ্গার বাসিন্দা দেবাঞ্জন দাসের খুনের ঘটনায় ধৃত প্রিন্স সিং খুনের কথা কবুল করে নিলেও তার বয়ানে একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে। আর এর থেকেই চাঞ্চল্য ফেলে দেওয়া এই খুনের ঘটনায় রহস্য আরও দানা বাঁধছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।

পুলিশের দাবি, শনিবার প্রিন্সকে গ্রেফতার করে বেলঘড়িয়া থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে স্বীকার করে নিয়েছে প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে দেবাঞ্জনের সম্পর্ক মেনে নিতে পারছিল না সে। আর সেই কারণেই দেবাঞ্জনকে খুন করার পরিকল্পনা করে সে। মাত্র দু’ঘন্টাতেই খুনের ছক কষেছিল সে। পুলিশের আরও দাবি প্রিন্স জেরায় জানিয়েছে সে নিজেই দেবাঞ্জনকে গুলি করেছিল।

প্রসঙ্গত দেবাঞ্জন দাসের খুনের ঘটনায় প্রথম থেকেই উঠে আসছিল ত্রিকোণ প্রেমের তত্ত্ব। দেবাঞ্জনের বাবা অরুণ দাসও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ক্রিকোণ প্রেমের কারণেই খুন হয়েছে তাঁর ছেলে।

পুলিশ সূত্রে খবর প্রাথমিক জেরার পর খুনের কথা কবুল করে নিয়ে প্রিন্স জানিয়েছে, বিশালকে সঙ্গে নিয়ে নবমীর রাতেই দেবাঞ্জনকে খুনের ছক করে সে। সল্টলেক সেক্টর ফাইভের একটি ধাবায় বসে ওই রাতেই দেবাঞ্জনকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা পাকা হয়। সেই মত প্রিন্স নজর রাখতে থাকে দেবাঞ্জনের গতিবিধির উপর। ওই রাতে দেবাঞ্জন সল্টলেক সেক্টর ফাইভে একটি পানশালাতে গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে। সেখান থেকে রাত দেড়টা নাগাদ দেবাঞ্জন তার বান্ধবীকে নিয়ে বাড়ির দিতে রওনা হলে প্রিন্স বিশালকে সঙ্গে নিয়ে বিশালের স্কুটিতে দেবাঞ্জনের গাড়ি অনুসরণ করতে থাকে তারা। এরপরে রাত দুটো নাগাদ দেবাঞ্জন নিমতা সর্দার পাড়ায় বান্ধবীকে নামিয়ে দেওয়ার পর প্রিন্স স্কুটার নিয়ে পথ আটকায় দেবাঞ্জনের গাড়ির। তারপরে দেবাঞ্জন ও তার মধ্যে বচসা হয়। সেই বচসা চলাকালীনই সে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়।

পুলিশের দাবি জেরায় প্রিন্স এবং বিশাল স্বীকার করেছে যে দেবাঞ্জনের গাড়ি আটকালে সে কথা বলার জন্য চালকের আসনের দিকের কাচ নামায়। বচসার পর হঠাৎ করেই পিছন থেকে গুলি চালায় প্রিন্স। গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকায় এবং গিয়ার নিউট্রালে না থাকায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরই দেবাঞ্জনের গাড়ি এগিয়ে যায়। প্রায় ১৫০ মিটার এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা মারে একটি ল্যাম্পপােস্টে এবং পাশের পাঁচিলে।

যদিও প্রিন্স ও বিশালের এই বয়ানে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে বলে অনুমান তদন্তকারীদের। তদন্তকারীদের দাবি, প্রিন্সের বয়ানের সঙ্গে মিলছে না ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট। কেন না ময়না তদন্তের রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়েছে দেবাঞ্জনের দেহে দুটি গুলির ক্ষত পাওয়া গিয়েছে। বাঁ দিকে গলা এবং ঘাড়ের মাঝে একটি ক্ষত। অন্যটি ডান হাতের কনুইয়ের কাছে।

তদন্তকারীদের প্রশ্ন, প্রিন্সের দাবি মত সে দেবাঞ্জন যদি চালকের আসনের পাশের জানালা নামায়। সেখান দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি চালালে দেবাঞ্জনের ডান দিক লাগবে। কিন্তু রিপাের্ট বলছে বাঁ দিকে গুলি লেগেছে। প্রিন্স তার যে অবস্থান বলছে সেখান থেকে তার পক্ষে দেবাঞ্জনের বাঁ দিকে গুলি করা কার্যত অসম্ভব। আর এই থেকেই বাড়ছে রহস্য।

ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ এবং তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, ওই ক্ষত তখনই সম্ভব যখন গাড়ির পিছনের আসনে গাড়ির বাঁ দিকে বসে কেউ দেবাঞ্জনকে লক্ষ্য করে গুলি চালাবে। অথচ বিশাল বা প্রিন্স কেউ গাড়িতে ওঠেনি বলে জানিয়েছে। আর সেখানেই পুলিশের সন্দেহ যে বিশাল বা প্রিন্স কোনও তথ্য গােপন করার চেষ্টা করছে।

তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান তৃতীয় কোনও ব্যক্তি ছিল ঘটনাস্থলে অথবা প্রিন্স বা বিশালের মধ্যে কেউ একজন গাড়িতে ছিল। এখন পর্যন্ত বিশাল গােটা ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। পুলিশের অনুমান, বিশালও বেশ কিছু তথ্য গােপন করছে।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের দাবি, যদি পিছনের আসনে বসা কেউ বাঁদিক থেকে গুলি চালায় তবে বুলেট হেড বা বুলটের অংশটি দেবাঞ্জনের দেহ কুঁড়ে বেরিয়ে তার দিকে অর্থাৎ চালকের আসনের আশে পাশে পড়ত। অথচ গুলির অংশটি পাওয়া যায় সামনের বাঁদিকের আসনের সামনে পা রাখার জায়গায়।

তবে তদন্তকারীদের অন্য একটি অংশ অবশ্য এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখছেন না। তাদের মতে গুলির পর গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ল্যাম্পপােস্ট এবং পাঁচিলে ধাক্কা মারে। সেই সময় বুলেটের অংশটির স্থান পরিবর্তন হতেই পারে।

এদিকে ঘটনার দিন দেবাঞ্জনের বান্ধবী সল্টলেকের পানশালা থেকে বেরনাের পর থেকেই ক্রমাগত একটি সােস্যাল সাইটে ভিডিও আপলােড করে গিয়েছেন। ওই ঘটনার সঙ্গে এর কোনও যােগাযােগ আছে কি না, তাও দেখছেন গােয়েন্দারা। সেই সঙ্গে দেখা হচ্ছে কার কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পেয়েছিল প্রিন্স। সেই ব্যক্তি ঘটনার সময় কোথায় ছিল?

এ প্রসঙ্গেই প্রিন্স তদন্তকারীদের জানিয়েছে পরিকল্পনামাফিক বন্ধুর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নেয় সে। এরপরে দেবাঞ্জনের গাড়ির পিছু নেয় এবং খুন করে, তারপরে সে দমদমে বিশালের ফ্ল্যাটে একাদশী পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়েছিল। বিপদ বুঝে তারপর ডেরা বদল করে বজবজে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এমনকি ধরা পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা করে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে নিজের চেহারাও বদলে ফেলেছিল প্রিন্স। পালটে ফেলেছিল চুলের কাট। চশমা পরাও বন্ধ করে দিয়েছিল সে। কিন্তু এত কিছুর পরেও শেষরক্ষা হয়নি।

তদন্তকারীদের দাবি ঘটনাস্থলে কোনও সিসি ক্যামেরা না থাকলেও কিছুটা দূরে একটি সিসি টিভি ফুটেজ পাওয়া গিয়েছে। সেই ফুটেজে দুই তরুণকে স্কুটারে চেপে চলে যেতে দেখা গিয়েছে। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে বিশালের স্কুটারে চেপেই ওই রাতে পালায় দুজন। ইতিমধ্যেই সেই স্কুটিটিও বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। রবিবার প্রিন্সকে আদালতে তােলা হলে বিচারক চোদ্দ দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন।

পুলিশ সূত্রে খবর প্রিন্সের বিরুদ্ধে খুন, ষড়যন্ত্র, তথ্য প্রমাণ লােপাট ও অস্ত্র আইনে মামলা রুজু করা হয়েছে। এদিন দেবাঞ্জনের বাবা বারাকপুর আদালতে জানায় তিনি এই দুঃখের মধ্যে কিছুটা হলেও আনন্দ অনুভব করছে অভিযুক্তরা গ্রেফতার হওয়া। তিনি অভিযুক্তদের ফাঁসির আরজি জানান। সব মিলিয়ে এক ত্রিকোণ প্রেমের জেরে খুনের ঘটনায় রহস্য ভেদ করতে তদন্তকারীরা বর্তমানে খুনের ব্যবহৃত অস্ত্র এবং তার মালিকের খোঁজে রয়েছে যাতে এই রহস্যের জট কাটে। তবে তারাও স্বীকার করছেন, এখনও অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে।