এনআরসি : উত্তাল বাংলা

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হওয়ার পরেই বাংলার বিভিন্ন জেলাতে অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। বিলের প্রতিবাদ করে সড়ক এবং রেল অবরােধের ঘটনাও ঘটেছে।

Written by SNS Kolkata | December 14, 2019 2:36 pm

অগ্নিগর্ভ বাংলা (Photo: Twitter/@MajiDevDutta)

নাগরিকত্ব সংশােধনী আইন বাতিলের দাবিতে উত্তপ্ত অসম, বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাও। বিল পাস হওয়ার পরেই বাংলার বিভিন্ন জেলাতে অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। বিলের প্রতিবাদ করে সড়ক এবং রেল অবরােধের ঘটনাও ঘটেছে। কোথাও বা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযােগের ঘটনায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে রাজ্য সরকার।

দিঘা থেকে ফিরেই শুক্রবার নবান্নে প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি, আই-জি আইনশৃঙ্খলা এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। নাগরিকত্ব সংশােধনী বিলের প্রতিবাদে বিভিন্ন এলাকায় অশান্তির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। অশান্তির ঘটনা নজরে আসতেই মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীর কাছে শান্তি বজায় রাখতে আবেদন করেছেন।

এদিকে নাগরিকত্ব বিল পাস হওয়ার পরেই শহর কলকাতা সহ মালদহ, মুর্শিদাবাদ, হাওড়ার মতাে একাধিক জেলাতে ব্যাপক গােলমালের ঘটনা ঘটে। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরােধ করে বিক্ষোভকারীরা। অন্যদিকে অবরােধের জেরে হাওড়া শাখায় দূরপাল্লার একাধিক ট্রেন আটকে পড়ায় সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন।

প্রতিবাদ বিক্ষোভের জেরে হাওড়ার উলুবেড়িয়া স্টেশনে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। করমণ্ডল, হামসফর এক্সপ্রেসের উপর হামলাবাজির ঘটনায় বহু যাত্রী ট্রেনের মধ্যে আটকে পড়েন। ট্রেন লক্ষ্য করে ইট ছোঁড়ার ঘটনাও ঘটে। স্টেশন চত্বর অন্ধকার করে দেওয়া হয়। আর বিক্ষোভের জেরে লােকাল ট্রেন চলাচলও ব্যাহত হওয়ায় প্রচুর যাত্রীকে স্টেশনে আটকে পড়ে থাকতে হয়। বাগনানের লাইব্রেরি মােড়ে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান আন্দোলনকারীরা। আর এর জেরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ছয় নম্বর জাতীয় সড়ক।

বিলের প্রতিবাদ করে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা স্টেশন চত্বরে অগ্নিসংযােগ করে উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রেল কর্তৃপক্ষ সরকারের সাহায্য চেয়েছে। উস্তিতে অবরােধের ঘটনা ঘটে। দুপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি মিছিল আসে ধর্মতলা এলাকাতে। পার্ক সার্কাসের সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং প্রায় আড়াই ঘন্টা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এই অবরােধের জেরে দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে একইভাবে আন্দোলনের আঁচ পড়ে নদিয়া এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকাতেও। ক্যাব নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক গােলমালের ঘটনায় রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর রাজ্যবাসীকে শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছেন।

সিপিএম, কংগ্রেসসহ একাধিক বামপন্থী দল রাজ্যবাসীকে শান্ত থাকার আবেদন করেছেন। উলুবেড়িয়ার ঘটনা নিয়ে এডিজি (রেল) অধীর শর্মা বলেছেন, ‘উলুবেড়িয়াতে কেবিন লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। লাইনে টায়ার জ্বালিয়ে দেওয়ায় কিছুক্ষণ ট্রেন আটকে ছিল স্টেশনে’। বেলডাঙাতে একই ঘটনা ঘটলেও কেউ আহত হয়নি। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় রাজ্যপাল ধনকরের সঙ্গে কথা বলেন।

নগরিকত্ব সংশােধনী বিল বা সিএবি (ক্যাব) বাতিলের দাবিতে শুক্রবার রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা। এদিন প্রথমে কয়েক হাজার মানুষ বড়ুয়া মােড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরােধ করে। কয়েক ঘণ্টার অবরােধে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জাতীয় সড়ক। ভাঙচুর করা হয় অ্যাম্বুলেন্স। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় বেলডাঙ্গা থানার ওসি জামালউদ্দিন মণ্ডল। ওসি’র সামনেই পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হতে থাকে ইট। ইটের আঘাতে এক পুলিশকর্মী জখম হন। পরিস্থিতি মােকাবিলা করতে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ঘটনাস্থলে ছুটে আসে বিভিন্ন থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী, কমব্যাট ফোর্স এবং র‍্যাফ। শুরু হয় ফের আরও একবার লাঠিচার্জ। এরপর বিক্ষোভকারীদের একদল বেলডাঙ্গা থানার সামনে বিক্ষোভ এবং ভাঙচুর করে। অন্য দলটি বেলডাঙ্গা স্টেশনে গিয়ে ভাঙচুর করে একাধিক স্টলে। স্টলের সমস্ত জিনিসপত্র রেললাইনের উপরে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে বিক্ষোভকারীরা তাণ্ডব চালায় স্টেশনে। বাধা দিতে গিয়ে আরপিএফের এক কর্মী আহত হন। এদিকে ক্যাব পাশ হওয়ার পরে আতঙ্কে থাকা এক প্রৌঢ়ের হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে।

এদিন বেলডাঙ্গা ছাড়াও জেলার সদর শহর বহরমপুর সহ সাগরদিঘি, সালার, ডােমকল, জলঙ্গি, বড়ঞা ইত্যাদি জায়গায় দফায় দফায় রাজ্য সড়ক অবরােধ, বিক্ষোভ মিছিল হয়। বহরমপুর থানার ভাকুড়ি মােড়ে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক অবরােধ করে বিক্ষোভ দেখান নাগরিক একতা মঞ্চ নামে একটি সংগঠনের শতাধিক সদস্য। তারা জাতীয় সড়কের উপরে সারি সারি টায়ার জ্বালিয়ে দেয়। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জাতীয় সড়ক। দূরপাল্লার যানবাহন সব থমকে যায়। বহরমপুর থানার আইসি সনৎ দাসের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী মাথায় হেলমেট পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর রেস না কাটতেই সাগরদিঘি থানার হরহরি, পাে পাড়া, জুগােড়, সন্তোষপুর, কড়াইয়া ইত্যাদি গ্রামের শতাধিক মানুষ বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সাগরদিঘি হাসপাতাল মােড়ে বিক্ষোভ সভা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কুশপুতুল দাহ করেন তাঁরা। ক্যাব বাতিলের দাবিতে এদিন বড়ঞা থানার ডাকবাংলা মােড় থেকে বিশাল মিছিল বের হয়। বিভিন্ন এলাকা পরিক্রমা করে মিছিলটি। পোড়ানাে হয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুতুল। এছাড়াও এদিন নওদা থানার গঙ্গাধারি, রেজিনগর থানার জাতীয় সড়কে, জলঙ্গিতে রাজ্য সড়ক অবরােধ করে বিক্ষোভ দেখান মানুষ। দফায় দফায় রাজ্য সড়ক অবরােধের ফলে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয় বিভিন্ন এলাকায়।

ক্যাব বাতিলের দাবিতে বেলডাঙ্গা, বহরমপুর, জঙ্গিপুর সহ জেলাজুড়ে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, তার পিছনে কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে বলে এদিন রাতে সাংবাদিকদের জানান তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সহসভাপতি তথা মুখপাত্র অশােক দাস। তিনি বলেন, মুর্শিদাবাদের শান্তির বাতাবরণ নষ্ট করতে চাইছে কংগ্রেস। বেলডাঙ্গা সহ গােটা জেলাজুড়ে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে কংগ্রেসের প্রচ্ছন্ন মদত ও ভূমিকা রয়েছে। শান্ত জেলাকে অশান্ত করতে কংগ্রেসের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকাকে আমরা ধিক্কার জানাচ্ছি। আমাদের নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জেলার পর্যবেক্ষক মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, শান্তির বার্তা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের। আমরা সেই নির্দেশকে মাথায় রেখেই রাস্তায় নেমেছি। মুর্শিদাবাদে হিন্দু এবং মুসলমানের যে ঐতিহ্য, তা আমরা ভাঙতে দেব না। রক্ষা করবই। এদিন দলীয় কর্মসূচিতে যােগ দিতে মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা পলিটব্যুরাে সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র। ক্যাব বাতিলের দাবিতে মুর্শিদাবাদ অগ্নিগর্ভ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলে, তিনি বলেন, ‘সবকিছু উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে করা হচ্ছে। গায়ের জোরে নাগরিকত্ব সংশােধন বিল পাশ করা হয়েছে। এর কারণই হল গােটা দেশে উত্তেজনা এবং মেরুকরণ তৈরি করা। মানুষের যে আসল সমস্যা, সেখান থেকে নজর কাড়ার জন্যই এই কাজগুলি করা হচ্ছে। আমরা মানুষকে বলব আতঙ্কিত হবেন না। ভয় পাবেন না। শান্তি বজায় রাখুন। একসঙ্গে সবাইকে লড়তে হবে। একটা লােকও সীমান্তের ওপারে যাবে না। বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের মধ্যে বােঝাপড়া আছে। অসমের ক্ষেত্রে কিছুজনকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের সরকার রাজি ছিল বলেই। এখন যদি ভারত বলে ১২ লক্ষ নিয়ে যাও, তাহলেই তাে ওরা নেবে না। এরাও পাঠাতে পারবে না। কত ডিটেনশন ক্যাম্প করবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘এই বিল বাতিলের দাবিতে আমরা আদালতে যাব। বিকাশ ভট্টাচার্যকে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলাম। উনি ডিড তৈরি করে দু-একদিনের মধ্যেই দিল্লিতে যাচ্ছেন। এ রাজ্য থেকে আমরা তাকে মামলা করার জন্য বলছি।

এদিকে সিএবি বা ক্যাব পাশ হওয়ার পরেই আতঙ্কে হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল এক প্রৌঢ়ের। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি থানার ফুলশহরী গ্রামের ঘটনা। এলাকাটি শেখদিঘি গ্রামের মধ্যে পড়ে। পেশায় চায়ের দোকানদার কুদরত শেখ নামে ওই প্রৌঢ় বৃহস্পতিবার রাতে হৃদরােগে আক্রান্ত হন। তাঁকে জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে শুক্রবার তার মৃত্যু হয়। মৃতের বাড়ির লােকজন থেকে প্রতিবেশীদের অভিযােগ, ক্যাব পাশ হওয়ার পরেই আতঙ্ক এবং চরম দুশ্চিন্তায় ছিলেন কুদরত। সে কারণেই তিনি হৃদরােগে আক্রান্ত হন। তার ছেলে আপেল শেখ। বলেন, ‘লােকসভা এবং রাজ্যসভায় সিএবি পাশ হওয়ার পরেই তিনি ভেঙে পড়েন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দেন। আমাদের কাছ এসে বার বার বলতে থাকেন, তােরা কোথায় যাবি? তােদের কী হবে? আমরা তাঁকে চিন্তা করতে না করেছিলাম। বৃহস্পতিবার ঘুমােতে যাওয়ার আগেও দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তারপরই হৃদরােগে আক্রান্ত হন’। প্রতিবেশী মহম্মদ তাহাজাবল হাদ্বসান বলেন, ‘চায়ের দোকানে টিভিতে বিল পাশের খবর দেওয়ার পর থেকেই আতঙ্কে শুরু হয় তার। বার বার আমাদের বলতেন, তাহলে কি ভিটে মটি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে যেতে হবে। আমরা তাকে আতঙ্কিত না হওয়ার কথা বলেছিলাম’।

এনআরসি-র প্রতিবাদে আরামবাগের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিক্ষোভ, মিছিল ও পথ অবরােধের খবর পাওয়া গেছে। প্রধানত বেশ কিছু মুসলমান সংগঠন একত্রিত হয়ে এই কর্মসূচি পালন করেছে বলে জানা গেছে। কোনও কোনও জায়গায় তৃণমূলের পক্ষ থেকেও আন্দোলন করা হয়েছে। পুলিশের লাঠি চার্জের অভিযােগ পাওয়া গেছে হরিণখােলা এলাকা থেকে। অভিযােগ ক্ষুব্ধ জনতা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে এবং পুলিশকে ইট পাটকলে ছোঁড়ে।