ক্ষুদিরাম ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’ ; পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হবে : শিক্ষামন্ত্রী

স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম বােস মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ইতিহাস বইতে হয়ে গিয়েছেন ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’।

Written by SNS Kolkata | July 10, 2019 11:08 am

শহিদ ক্ষুদিরাম বােসের মূর্তি (Photo: iStock)

ইতিহাস কখনও কখনও মানুষের হাতে বিকৃত হয়। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম শহিদ ক্ষুদিরাম বােস মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ইতিহাস বইতে হয়ে গিয়েছেন ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’।

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ‘অতীত ও ঐতিহ্য’ নামে অষ্টম শ্রেণির যে ইতিহাস বই পশ্চিমবঙ্গ সর্বশিক্ষা মিশনের আর্থিক আনুকূল্যে সরকারি ও সরকার পােষিত স্কুলে বিনামুল্যে বিতরণ করা হয়ে আসছে সেই বইয়ের পাতায় ক্ষুদিরামকে ‘…সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

‘একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’ গীতিকার ও সুরকার পীতাম্বর দাসের যে গান লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে শুনে শহিদ ক্ষুদিরামের জন্য বাঙালির চোখ জলে ভরে ওঠে, কালের যাত্রায় সেই ক্ষুদিরামই পর্ষদের ইতিহাসে হয়ে গিয়েছেন বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী।

মঙ্গলবার বিধানসভায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ইতিহাস বইতে শহিদ ক্ষুদিরামের এই বিকৃত পরিচয় নিয়ে ‘পয়েন্ট অফ অর্ডার’ আনেন বামফ্রন্টের বিধায়ক প্রদীপ সাহা। পর্ষদের বইতে এই ত্রুটির কথা অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অবিলম্বে এই ইতিহাস সংশােধনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।

মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ইতিহাস বইটিতে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী শিরােনামে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। যে অনুচ্ছেদে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, বাঘা যতীন সকলের নামােল্লেখ রয়েছে। এমনকী স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলনের ধারাকে স্পষ্টভাবে ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

লেখা হয়েছে- ‘…স্বদেশী আন্দোলনের শেষ দিকে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদটি বেশি করে দেখতে পাওয়া যায়। এই ধারার একটি প্রধান ভিত্তি ছিল বিভিন্ন সমিতিগুলি। আপাতভাবে সমিতিগুলি শরীরচর্চার। পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক উদ্যোগ নিত। তার মধ্যে দিয়ে মূলত ছাত্র ও যুবসমাজের কাছে স্বদেশি ভাবধারা প্রচার করা হত। সেইসময় মূলত বিভিন্ন সমিতিকে কেন্দ্র করে বিপ্লবী পন্থায় ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার ধারাটি গড়ে ওঠে। একদিকে জাতীয় কংগ্রেসের ‘আবেদন নিবেদন’ নীতির অসারতা স্পষ্ট হচ্ছিল। অন্যদিকে স্বদেশি আন্দোলনের ফলে বেড়ে চলেছিল ঔপনিবেশিক দমন পীড়ন। পাশাপাশি ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্বদেশি আন্দোলন সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে বিপ্লবীদের অনেকেই ঔপনিবেশিক প্রশাসনকে সন্ত্রস্ত করে ধাক্কা দিতে চেয়েছিল। তার ফলে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী ধারাটি ক্রমে প্রবল হয়ে ওঠে।…’উপনিবেশ বিরােধী আন্দোলন এবং চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের নিরিখে বিচার করলে প্রথম পর্বের বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ খুব একটা সফল হয়নি। নানান কারণে তাদের অধিকাংশ কর্মসুচি হয় ধরা পড়ে গিয়েছিল অথবা ব্যর্থ হয়েছিল। তাছাড়া প্রয়ােজনের কারণে তাদের কাজকর্ম গুপ্ত হওয়ার ফলে বৃহত্তর। সামাজিক আন্দোলনের কর্মসূচি হাজির করতে পারেনি বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ। কিন্তু তাদের কাজকর্ম জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর সমাজে তার প্রভাব পড়ত। ব্যক্তিগত স্তরে বিপ্লবীদের আদর্শ ও সাহস অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার বিষয় হয়েছে। তবে সশস্ত্র বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদকে নরমপন্থী ভিক্ষাবৃত্তির থেকে ভালাে মনে করলেও সবাই সেই পথে চলতে চাননি।….’

বইটিতে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, বাঘা যতীনের এই আন্দোলনের গরিমাকে কেবল ক্ষুগ্নই করা হয়নি, বইটির ভাষার মান নিয়েও প্রশ্ন জাগে। ২০১৩ সাল থেকে এইবইটি পড়ানাে হয়ে আসছে। ২০১৭ সালেও এই বিষয়টি বিধানসভায় উল্লেখ পর্বে এনেছিলেন বাম বিধায়ক প্রদীপ সাহা। কিন্তু তখন বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি।

ইংরেজি তুলে দেওয়া নিয়ে বাম বিধায়কদের অনেকসময় সমালােচনা করা হয়। বামফ্রন্টের বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী ক্ষুদিরামের এই পরিচয় নিয়ে তৃণমূলের সমালােচনা করেছেন। ক্রটি স্বীকার করে নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, সিলেবাস কমিটির অভীক মজুমদারকে বলেছি, একটি কমিটি তৈরি করতে।

তিন মাসের মধ্যে জীবন মুখােপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৈরি পাঠ্যপুস্তক রিভিউ কমিটি তার রিপাের্ট দেবে, এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত পাঠ্যপুস্তকে তথ্যগুলি ঠিকঠাক আছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে এই কমিটি। কোনওরকম বিকৃতি হলে তার সংশােধন করা হবে বলে আশ্বাস দেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

অর্থাৎ ইতিহাস শুধু বিকৃতই নয়, সংশােধিতও হতে পারে মানুষেরই হাতে।