জিয়াগঞ্জের আততায়ী রাজমিস্ত্রি, টাকার জন্যই খুন শিক্ষক পরিবার

সাত দিনের মাথায় ধরা পড়ল মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ থানার কানাইগঞ্জ লেবুবাগান এলাকায় শিক্ষক পরিবার হত্যাকাণ্ডের আততায়ী।

Written by SNS Berhampore | October 16, 2019 12:55 pm

শিক্ষক পরিবার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল। (Photo: IANS)

সাত দিনের মাথায় ধরা পড়ল মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ থানার কানাইগঞ্জ লেবুবাগান এলাকায় শিক্ষক পরিবার হত্যাকাণ্ডের আততায়ী। দশমীর দিন দুপুরে নিজের বাড়িতে নৃশংভাবে খুন হন পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পাল, তার স্ত্রী বিউটি মন্ডল পাল এবং একমাত্র ছেলে ছ’বছরের বন্ধুঅঙ্গন পাল ওরফে আর্য।

জেলা পুলিশের সঙ্গে সিআইডি যৌথভাবে ঘটনার তদন্তে নামে। মৃত শিক্ষক এবং তার স্ত্রীর পরিবারের বহু সদস্যকে জিজ্ঞাসাবেদর পাশাপাশি জিয়াগঞ্জের লেবুবাগান ও সাগরদিঘি থানার সাহাপুর গ্রামের বহু মানুষকে বারবার পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। এই সাহাপুর গ্রামেই মৃত শিক্ষকের মামা বাড়ি ও বড়াে হয়ে ওঠা।

সাহাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়েরই শিক্ষক ছিলেন বন্ধুপ্রকাশ। অবশেষে পরিবারের সবাইকে খুনের অভিযােগে পুলিশ যাকে গ্রেফতার করল তার বাড়িও সাহাপুর গ্রামে। মৃত শিক্ষকের বাড়ির পাশেই। সােমবার গভীর রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের পরে পুলিশ গ্রেফতার করল উৎপল বেহেরা নামে বছর কুড়ির এক যুবককে।

মঙ্গলবার মুখ ঢাকা উৎপলকে সঙ্গে নিয়েই সাংবাদিক বৈঠক করেন জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার। এই বৈঠকে তিনি জানান, মৃত বন্ধুপ্রকাশ শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে জীবন বিমা পলিসির কাজও করতেন।

মৃত শিক্ষকের কাছে ধৃতের বাবা একটি অর্থলগ্নি সংস্থায় জীবনবীমা করিয়েছিলেন। বছরে দিতে হত চব্বিশ হাজার টাকা। দু’বছর তিনি এই টাকা দেন। প্রথম বছরে রশিদ মিললেও দ্বিতীয় বছরের রশিদ না মেলার কারণে পুজোর আগে মােবাইলে ধৃত উৎপলের সঙ্গে বন্ধুপ্রকাশের বচসা হয়। বচসার সময় বন্ধুপ্রকাশ নাকি উৎপলকে গালিগালাজ করে। এই গালিগালাজ সহ্য করতে না পেরে এবং তার বদলা নিতে দশমীর দিন সে একাই গােটা পরিবারকে শেষ করে দেয়। পুরাে ঘটনাটি সে ঘটিয়েছে দুপুর ১৬.০৬ থেকে ১২.১১ মিনিটের মধ্যে। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘটনাস্থল থেকে পালায় উৎপল।

এদিন সাংবাদিক বৈঠকে জেলা পুলিশ সুপার বলেন, ৮ অক্টোবর ঘটনার দিন মৃত শিক্ষকের আত্মীয় বন্ধুকৃষ্ণ ঘােষ জিয়াগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযােগ দায়ের করেন। তার ভিত্তিতে তদন্তে নামে পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে কিছু জিনিস আমরা বাজেয়াপ্ত করি। তার মধ্যে একটি চিঠি ছিল। যেটা বিউটি পালের লেখা। এছাড়াও একটা ধারালাে অস্ত্র, রক্তমাখা একটি পলিসি এবং একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। এর ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়। অনেকগুলি কারণ সামনে উঠে আসে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। যারা আততায়ীকে পালাতে দেখেছিলেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করি। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় মৃতের পরিবারের সদস্যদেরও। বন্ধুপ্রকাশের গ্রামের বাড়ি সাহাপুর গ্রামেরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করি আমরা।

এই জিজ্ঞাসাবাদের সূত্রেই সােমবার রাতে আমরা সাহাপুর গ্রামের বাসিন্দা পেশায় রাজমিস্ত্রি উৎপল বেহেরাকে গ্রেফতার করি। সে তিনজনকে খুনের কথা স্বীকার করেছে। আজ তাকে আদালতে তােলা হবে। চোদ্দদিনের পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করা হবে। কি কারণে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড? উত্তরে জেলা পুলিশ সুপার বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি বন্ধুপ্রকাশ পাল বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মানি মার্কেটিং, মিউচুয়াল ফান্ড থেকে শেয়ার বাজারে অর্থ বিনিয়ােগ সবকিছুর সঙ্গেই সে যুক্ত ছিল।

১০ অক্টোবর রামপুরহাটে আরেকটি সংস্থা খােলার কথা ছিল তার। নিজের গ্রাম সাহাপুর এবং পাশ্ববর্তী বহু গ্রামের অনেক লােককে যে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত করিয়েছিল। আমরা তদন্তে নেমে খোঁজার চেষ্টা করছিলাম তাদের যারা অর্থ রেখে প্রতারিত হয়েছেন অথবা মারা গিয়েছেন বা টাকা জমা দেওয়ার পরে সেই টাকা জমা হয়নি। তার ভিত্তিতেই জিজ্ঞাসাবাদ চালাই। তাতে জানতে পারি মৃত শিক্ষক নিজেও খুব আর্থিক চাপে ছিলেন। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কেউ কেউ তাকে চাপও দিচ্ছিল।

জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েই আমরা পাই সাহাপুর গ্রামের বাসিন্দা মাধব বেহেরাকে। সে অর্থ লগ্নি করতে না চাইলেও তার ছেলে উৎপল বেহেরার চাপে সে বন্ধুপ্রকাশের কাছে একটি এগারাে বছরের পলিসি করে। প্রতি বছর ২৪ হাজার টাকা দিতে হবে। দু’বছর সে টাকা দেয়। প্রথম বছরের রসিদ পেলেও দ্বিতীয় বছরের রসিদ সে পায়নি। সাহাপুরে শিক্ষকতা করতে গেলে বন্ধুপ্রকাশের কাছে সে বেশ কয়েকবার সেই রশিদ চায়। বাবার সঙ্গে ছেলে উৎপলও তার কাছে রসিদ চেয়েছিল। কিন্তু পায়নি। টাকা দিয়েও রসিদ না পাওয়া নিয়ে বাবা এবং ছেলের মধ্যে প্রায়ই অশান্তি হয়। রসিদ না পাওয়ার জন্য বাবা ছেলেকেই দোষারােপ করতে থাকে। কারণ বাবার যুক্তি ছিল ছেলের জন্যই সে অতগুলি টাকা বন্ধুপ্রকাশকে দিয়েছিল।

উৎপল পূর্ব মেদিনীপুরের এগরাতে রাজমিস্ত্রির কাজ করে। সেখান থেকে পুজোর আগে সে ফের বন্ধুপ্রকাশকে ফোন করে। দুজনের মধ্যে বচসা হয়। উৎপল জেরায় স্বীকার করেছে বচসার সময় মৃত শিক্ষক তাকে গালিগালাজ করে। তাকে বাজে কথা বলে। এরপরেই তাকে খুনের সিদ্ধান্ত নেয় উৎপল।

কীভাবে পর পর তিনজনকে খুন করা হল? উত্তরে জেলা পুলিশ সুপার বলেন, ৩ অক্টোবর পঞ্চমীর দিন মেদিনীপুর থেকে সাগরদিঘিতে ফেরে উৎপল। ৫ অক্টোবর সপ্তমীর দিন আজিমগঞ্জ হয়ে জিয়াগঞ্জে ঢােক সে। জিয়াগঞ্জ থানার সদরঘাটে তার দিদির বাড়ি। সেখানে ওঠে। আজিমগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটি দোকান থেকে খুনে ব্যবহৃত ধারালাে অস্ত্রটি কেনে। বাড়ি ফিরে যায়। ৭ অক্টোবর নবমীতে পুজো দেখতে ফের সে দিদির বাড়ি আসে। বন্ধুপ্রকাশের বাড়ির এলাকাটি দেখে যায়। কিন্তু ঠিক কোন বাড়িটা সে বুঝতে পারেনি। ৮ অক্টোবর দশমীর দিন সকাল সাড়ে দশটায় সে বন্ধুপ্রকাশকে ফোন করে। তার সঙ্গে দেখা করার কথা জানায়। বন্ধু প্রকাশের কাছে তার বাড়ির সঠিক ঠিকানা জেনে নেয়। সে বাড়িতে আছে কিনা, সেটাও জেনে নেয়। তারপর দুপুরে তার বাড়িতে আসে। নাম ধরে ডাকে পরিচিত হওয়ায় দরজা খুনে দেয় বন্ধুপ্রকাশ। দরজা খুলে পিছন ফিরতেই উৎপল ধারালাে অস্ত্র দিয়ে তাকে পিছন থেকে আঘাত করে সে বিছানায় পড়ে যায়। এরপর ঘরের ভিতরে যায়। পাশের ঘরে ছিল বন্ধুপ্রকাশের স্ত্রী ও ছেলে। সেখানে প্রথমে স্ত্রীকে একইভাবে ওই অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। তার স্ত্রীও বিছানায় পড়ে যায়। শেষে ছেলেকে খুন করে।

খুনের পরে সে ওই বাড়িতে ছিল। এমন সময় দুধ বিক্রেতা এসে দরজা ধাক্কা দিতেই উৎপল তাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। যে পােষাক পরে সে খুনগুলি করেছিল সেটি খুলে রাস্তার জঙ্গলে ফেলে দেয়। খুনের সময় সে যে শার্টটি পড়ে ছিল সেটি আমরা উদ্ধার করেছি। তার কথা মতাে আরেকটি উদ্ধার করা হবে। এই জামার নিচে পড়ে থাকা আরেকটি জামা এবং প্যান্টের নিচে পড়ে থাকা থ্রি কোয়ার্টার একটি প্যান্ট পড়ে ট্রেন ধরে গ্রামে ফিরে যায় স্নান করে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে শুরু করে। তাকে আমরা কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করি। সে আমাদের জানায় ঘটনার দিন সে সাগরদিঘিতে ছিল। কিন্তু তার মােবাইলের টাওয়ার সেদিন আজিমগঞ্জ দেখায়। তাতে আমাদের সন্দেহ আরও বাড়ে।

খুনের পরে সে জিয়াগঞ্জ সদরঘাউট দিয়ে পালিয়ে আজিমগঞ্জে গিয়েছিল। সদরঘাটের ফুটেজে তাকে দেখা যায়। সাগরদিঘি থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করি। রাতে সে ভেঙে পড়ে এবং খুনের কথা স্বীকার করে। খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রটি বাড়ির পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উৎপলকে নিয়ে ঘটনার পুননির্মাণ করা হবে। তবে পূর্বে তার বিরুদ্ধে কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। খুনের পর থেকে বারবার বন্ধুপ্রকাশের বন্ধু সিউড়ির বাসিন্দা সৌভিক বর্মনের কথা উঠে আসছিল। তাকে গত শুক্রবার পুলিশ আটক করে। এই খুনের সঙ্গে তার ভূমিকা নেই বলে জানান পুলিশ সুপার।

তিনি বলেন, ২০০৪ সাল থেকে সে বন্ধুপ্রকাশের সঙ্গে ব্যবসা করে। সৌভিককে গুরু বলে মনে করত বন্ধুপ্রকাশ। সমস্ত ব্যবসায় মৃত শিক্ষককে এই সৌভিকই নামিয়েছিল। তদন্তে তার নাম বার বার উঠে আসে। সেই মতে জেরা করা হয়। কিন্তু শেষে জানা যায়, খুনের সঙ্গে সে যুক্ত নেই। উৎপল একাই তিনটি খুন করেছে, তবে সৌভিকের বিরুদ্ধে সাগরদিঘি থানার বারালা গ্রামপঞ্চায়েতের বহু মানুষ প্রতারণার অভিযােগ করেছে। সেই অভিযােগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে আমরা আইনত ব্যবস্থা নেবে।

ধৃত উৎপল বেহেরাকে মঙ্গলবা লালবাগ মহকুমা আদালতে তােলা হয়। তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা তাকে চোদ্দ দিনের জন্য নিজের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করলে এসিজেএন সুপর্ণা রায় সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। এদিকে শিক্ষক পরিবার খুনের আগে দিদির বাড়িতে গিয়েছিল উৎপল বেহেরা। পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের কাছে এই বিবৃতি দেওয়ার পরেই উৎপলের দিদি শ্রাবণী সরকারের বাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে এলাকার মানুষ।

জিয়াগঞ্জ আজিমগঞ্জ পুরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রাবণীদেবীর বাড়ি। এই ওয়ার্ডের লেবুবাগানে থাকতেন মৃত শিক্ষক এবং তার পরিবার। খুনের আগে দিদির বাড়িতে উঠে বন্ধুপ্রকাশ পালের বাড়ি দেখে গিয়েছিল। সে কারণে মঙ্গলবার তার দিদির বাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে এলাকার মানুষ। ইট দিয়ে জানলা ভাঙার চেষ্টা হয়। জিয়াগঞ্জ থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়ে উত্তেজিত মানুষকে সরিয়ে উৎপলের দিদিকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে যান পুরসভার চেয়ারম্যান তৃণমূল কংগ্রেসের প্রসেনজিঞ ঘােষ। তিনিও পরিস্থিতি সামাল দেন।

শ্রাবণী বেহেরা সরকার বলেন, আমার ভাই এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে না। তাকে ফাঁসানাে হচ্ছে। যদি সে খুনই করতাে তাহলে গ্রামের বাড়িতে থাকবে কেন? সে তাে পালিয়ে যেতে পারত। নবমীর দিন গ্রামের অনেকের সঙ্গে সে জিয়াগঞ্জে ঠাকুর দেখতে এসেছিল। রাত দশটার ট্রেনে বাড়ি ফিরে যায়।

এদিন উৎপলের গ্রেফতারের পরেই সাহাপুর গ্রামে বন্ধুপ্রকাশের মামাবাড়ির সামনে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানাে হয়। বন্ধুপ্রকাশের খুনের পরে যারা বেশি টাকা চলে যওয়ার হা হুতাশ করছিল তাদের মধ্যে ছিল উৎপল। ফলে প্রথমে পুলিশের সন্দেহ না হলেও পরে সন্দেহ তীব্র হয় এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মাত্রা বাড়ানাে হয়। শেষে ভেঙে পড়ে খুনের কথা স্বীকার করে সে বলে জানান পুলিশ সুপার।