করোনা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের বিমার অঙ্ক দ্বিগুণ, বাড়ল উপভোক্তাদের পরিধিও

আগে শুধু ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আশা এবং আইসিডিএস কর্মীদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা বিমার অঙ্ক হিসেবে বরাদ্দ ছিল।

Written by SNS Kolkata | March 31, 2020 7:34 pm

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (File Photo: IANS)

রাজ্যে করোনায় মৃতের সংখ্যা এক থেকে বেড়ে দুই হওয়ার পরপরই করোনা মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত সব ধরনের কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমার অঙ্ক বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে জেলাশাসক, সচিব এবং স্বাস্থ্য আধিকারিকদের নিয়ে ভিডিওকনফারেন্স বৈঠকে মমতা ঘোষণা করলেন করোনা মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ধরনের কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমার অঙ্ক ৫ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ লক্ষ টাকা করা হল।

আগে শুধু ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আশা এবং আইসিডিএস কর্মীদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা বিমার অঙ্ক হিসেবে বরাদ্দ ছিল। এবার তাদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হল অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার, কুরিয়র, সাফাই কর্মী, কেমিস্ট, রান্নার কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি এমনকী লকডাউন সফল করতে সক্রিয় পুলিশকর্মীরা ও বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের এমনকী করোনায় আক্রান্তদের পরিবারকেও এই বিমার আওতার আনার কথা বলেন মমতা। এমনকী বিমা কার্যকর হওয়ার সময়ও ১৫ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তিনি। এই সমস্ত বিষয়ে বিমা কোম্পানিগুলির সঙ্গে কথা বলার জন্য রাজ্যের মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে রাজনৈতিকভাবে সমলোচনা করলেন বিজেপি নেতারা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রান্ত নীতির জন্যই বাংলার কর্মীরা বিমার টাকা ৫০ লক্ষের জায়গায় মাত্র ১০ লক্ষ টাকা করে পাবেন। করোনা মোকাবিলার জন্য আযুম্মান ভারত প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন করোনা মোকাবিলায় যুক্ত দেশের সব ফ্রন্টলাইন কর্মী তথা চিকিৎসক, নার্স, সাফাইকর্মী, প্যারামেডিকেল স্টাফ, আশা, আইসিডিএস কর্মীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা করে বিমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিমার পরিমাণ দ্বিগুণ করার ঘোষণার পরেও রাজনৈতিক টাগ-অফ-ওয়ার খেলায় নেমে পড়েন বিজেপি নেতারা।

আগামী দু’সপ্তাহকে ‘এমার্জেন্সি সিচুয়েশন’ বলে মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় সমবার প্রতিটি জেলার জেলাশাসক, জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এবং সচিবদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন। জেলায় জেলায় করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা যাতে সমন্বয়ের অভাবে ব্যাহত হয় সেই কারণেই এই বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিটি জেলা ধরে ধরে কোথায় কী পরিস্থিতি, কোন জেলার কোথায় কোথায় আইসোলেশন সেন্টার, কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড তৈরি হচ্ছে, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের কোথায় রাখা হচ্ছে এমনকী তাদের প্রাতরাশে কিংবা বিকেলে কী খেতে দেওয়া হচ্ছে এই বিষয়েও খোঁজ খবর নেন।

একদিকে জেলা হাসপাতালের স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের সঙ্গে সেখানে চিকিৎসার সরঞ্জাম ও পরিষেবায় কী ঘাটতি থাকছে তার খোঁজ নেন। জানিয়ে দেন ৩০০’টির মতো ভেন্টিলেটর মেশিন অর্ডার দেওয়া হয়েছে। মোবাইল ভেন্টিলেটরও আনানো হচ্ছে। স্বাস্থ্য সচিব বিকে কুমারকে বলেন, করোনা চিকিৎসার সরঞ্জাম যাতে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলিতে পৌছে দেওয়া যায়।

অন্যদিকে প্রতিটি জেলার জেলাশাসককে এক এক করে জিজ্ঞেস করেন, কোন জেলার কোথায় কত বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড, কোয়ারেন্টাইন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। এই জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব শুরু হয় উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে দিয়ে। কালিম্পং’এ করোনায় দ্বিতীয় মৃত্যু নিয়েও সুনির্দিষ্ট খোঁজখবর নিতে বলেন স্বাস্থ্য আধিকারিককে।
এদিন করোনা প্রস্তুতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ পর্বে মুখমন্ত্রীর কোপে পড়েন তিন জেলাশাসক। প্রথমজন ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক রোশনি কোমল। তিনি জানিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা হাসপাতালেই আইসোলেশন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে।

একথা শুনে ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। সাফ জানিয়ে দেন যেখানে সাধারণ রোগিদের চিকিৎসা হয়, সেখানে করোনা আক্রান্তদের রাখা যাবে না। বলেন, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা হাসপাতালটি এমনিতেই ঘিঞ্জি। ওখানে একজন অসুস্থ হলে বিপর্যয় ঘটে যাবে। একজন রোগির থেকে পঞ্চাশজন ডাক্তার নার্সের সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। মুখ্যমন্ত্রী আইসোলেশন’এর জন্য ওই জেলার আয়ুষ হাসপাতালটিকে রাতারাতি প্রস্তুত করতে বলেন। ডেকরেটরকে ডেকে রাতারাতি বেড তৈরির কথা বলেন। জেলাশাসকে ভৎর্সনা করে বলেন, অল্পের মধ্যে কাজ সারলে হবে না। পরিণত এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। টাকা পয়সা নিয়ে কার্পণ্য করলে চলবে না।

এদিন পশ্চিম মেদিনীপুরের জন্য স্পেশাল প্যাকেজেরও বন্দোবস্ত করতে নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যসচিবকে। ভেন্টিলেটর, স্যালাইন, অক্সিজেন সিলিন্ডার পাঠিয়ে অন্তত পঞ্চাশ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারটিকে প্রস্তুত করতে বলেন। একই সঙ্গে মোহনপুরে ৮০ শয্যার কোয়ারেন্টাইন সেন্টারটিকেও প্রস্তুত করতে তৎপর হতে বলেন এই জেলার জেলাশাসক রোশনি কোমলকে। যাদের রেশন কার্ড নেই, তারাও যাতে খাওয়ার পায়, সেজন্য নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করতে বলেন জেলাশাসককে।

এদিন ঝাড়গ্রাম জেলাশাসক আয়েশা রানিও মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে পড়েন। এই জেলার মেডিকেল কলেজ এবং সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এমনকী হাসপাতালের নৈশ আশ্রয়কেও কোনওভাবেই করোনা চিকিৎসায় লাগানো যাবে না, একথা সাফ জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। এগুলির জন্য বিলল্প জায়গার সন্ধান জেলাশাসক দিতে না পারলে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সংকট পরিস্থিতির গভীরতা বোঝার চেষ্টা করুন।

এরপর মুখ্যসচিব জানান, ওই জেলা সংলগ্ন বিদ্যাসাগর ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এবং সেন্ট জোসেফ হাসপাতালকে আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ওই জেলার কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হিসেবে বন দফতরের গেস্ট হাউসকে কাজে লাগাতে বলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। উত্তরে জেলাশাসক বলেন, সেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা থাকেন। উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী ওই সন্ন্যাসীদের ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে পূর্ত দফতরের গেস্ট হাউসে সরিয়ে দিতে বলেন। এইসব ব্যবস্থাপনার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জেলাশাসককে ভৎসনা করে বলেন, নিজের জেলার কোথায় কী আছে, সেটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হোন।

সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর রোষানলে পড়েছেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার জেলাশাসক নিখিল নির্মল। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, গত কয়েক দিনে সেখানে ভিনরাজ্য থেকে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক ঢুকেছে। মমতা প্রশ্ন করেন, এই পরিস্থিতিতে যখন কেন্দ্রে নির্দেশে সব সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন কীভাবে ওই জেলায় লোকজন ঢুকছে? তোমরা কী করছ? সীমান্তবর্তী জেলা বলে দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রশাসনকে সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী এদিন সিনিয়ার আইপিএস অফিসার অজয় নন্দকে উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলা এবং দক্ষিপ্তঙ্গের পাঁচটি জেলার নোডাল অফিসারের দায়িত্ব দেন।

এছাড়া পূর্ব মেদিনীপুর, মালদহ, নদীয়া, হুগলি, হাওড়া, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলার করোনা যুদ্ধের পরিস্থিতির হালহকিকৎ নিয়ে খোঁজখবর নেন জেলাশাসক ও জেলা স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে। দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়, বীরভূম- এই পাঁচটি জেলার করোনা প্রতিরোধের জন্য একটা সমন্বয়ী ব্যবস্থার পরামর্শ দেন।

উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের অধ্যক্ষ এদিন মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানে বেশ কিছু ভাবী ডাক্তার, হাউস স্টাফ হিসেবে করোনা চিকিৎসায় কাজ করতে চাইছে। মুখ্যমন্ত্রী তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, যারা কাজ করতে চাইছে, তাদের কাজের সুযোগ করে দিন। করোনা মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে নামার জন্য আহ্বান জানান। এই কাজের জন্য ০৩৩-২৩৪১২৬০০ নম্বরে আবেদন করতে বলেন। জানিয়ে দেন, স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের বিষয়টি self4society.mygov.in এই ওয়েবসাইটে জানা যাবে।

একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এদিন সরকারি কর্মচারীদের আশ্বস্ত করে বলেন, করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা যাতে তাদের গায়ে এসে না লাগে সেজন্য সরকার তৎপর। তাই একদিন পরে এপ্রিলের মাস পয়লাই বেতন মিলবে রাজ্য সরকারি কর্মচারী এবং অবসরপ্রাপ্তদের। এর আগেই রাজ্য সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল, এককালীন দু’মাসের সামাজিক পেনশনের টাকা মিলবে উপভোক্তাদের। এবার সরকারি কর্মচারীদেরও বেতন নিয়ে উদ্বেগ নিরসন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।