ভারতের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত, মমতার প্রলেপ চান ওঁরা

নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ প্রতিরােধ হিংসার চেহারা নিয়েছে।

Written by Debashis Das Kolkata | December 16, 2019 4:08 pm

এনআরসি-সিএবি'র প্রতিবাদে মমতার মিছিল। (Photo: IANS)

জিনা ইঁহা মরনা ইঁহা, ইসকে সিবা জানা কাঁহা – নাগরিকত্ব সংশােধনি বিল সংসদে পাশ হওয়ার পর এখন তা নাগরিকত্ব আইনে পরিণত হয়েছে। এই নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ প্রতিরােধ হিংসার চেহারা নিয়েছে। যারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ আন্দোলনে এখনও মুখর হননি তাদের একাংশ ক্ষোভে ফুসছে। আগামী দিনে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি যে সরগরম থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আজ সােমবার সপ্তাহের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পথে নামছেন এই আইনের বিরােধিতা করে। স্বাভাবিকভাবে কলকাতার রাজপথ যে স্তব্ধ হবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের পক্ষে সওয়াল ক্রমশ জোরালাে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনকে হাতিয়ার করে এই আইনের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে জনমত তীব্র করতে চাইছে কেন্দ্র বিরােধী দলগুলি।

এই নাগরিকত্ব আইনই উসকে দিচ্ছে দেশভাগের স্মৃতি। যারা একদিন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে এ রাজ্যে এসে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করেছে তাদের সিংহভাগের মধ্যেও আতঙ্ক ও উদ্বেগ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বাক্স-প্যাটরা হাতড়ে নথি খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পুরাে দমে। বছর দুয়েক আগেও এই আতঙ্ক গ্রাস করতে পারে এমনটাও ভাবেননি শহর কলকাতায় থাকা বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলােনীর বাসিন্দারা। অসমে এনআরসির কথা সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে জেনেছে মানুষজন।

সােস্যাল মিডিয়াতে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির ছবি উঠে এসেছে। প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণার সম্ভাবনা আগাম আঁচ তখনও সেভাবে নাড়া দেয়নি, এ রাজ্যের মানুষজনকে। সময় যত সামনের দিকে গড়িয়েছে অসমে নাজেহাল অবস্থার মুখােমুখি হতে হয়েছে কেন্দ্র এবং অসম সরকারকে। ১৬০০ কোটি টাকা চলে গিয়েছে কোষাগার থেকে। অসমের পদক্ষেপ যে সঠিক ছিল না তা পর্তী সময়ে প্রমাণিত সত্য।

এবার এনআরসি সরাসরি না করে ক্যাব নিয়ে আসা হয়েছে সংসদে। এবার তার আঁচ পড়েছে গােটা দেশে। বাদ যায়নি এইরাজ্যও। উদ্বাস্তু কলােনি টালিগঞ্জ, বাঘাযতীন, বিদ্যাসাগর, পাটুলীর মতাে কলােনি এলাকায় থাকা বাসিন্দারা রীতিমত শঙ্কিত। কে জানে আবার করে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে?

১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় এসেছেন অশােক আচার্য। নিজে বিয়ে করেননি কিন্তু ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ভাই এখন পুরােদস্তুর সংসারী। একটি চায়ের দোকান চালান। এই চায়ের দোকানকে সম্বল করেই তিনি দিন গুজরান করেন। অশােকবাবুর এক বােন তিনিও অশােকবাবুর মত বিয়ে করেননি। অসুস্থ বােনের চিকিৎসা চলছে বাড়িতে। তারই মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নথি। এই নথি তাঁর একমাত্র সম্বল। ইস্ট বেঙ্গল রিলিফ কমিটির একটি নথি রয়েছে অশােকবাবুর কাছে। সেই নথিকেই সম্বল করেই তিনি এখন বিদ্যাসাগর কলােনির বাসিন্দা। শেষ পর্যন্ত পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বুঝে উঠতে পারছেন না অশােকবাবু।

শুধু অশােকবাবুই নন, কলকাতার অন্যান্য উদ্বাস্তু কলােনির বাসিন্দারা কমবেশি সবাই উদ্বিগ্ন। সেই উদ্বেগের ছায়া রয়েছে চোখ মুখ জুড়ে। স্মৃতিকে সম্বল করে ভবিষ্যতের ঠিকানা খুঁজছেন তারা। অজানা আশঙ্কা ক্রমশ গ্রাস করছে। সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। যারা এখনও অদৃষ্টের উপর এতটা ভরসা করতে পারছেন না তারা আবার নতুন করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে তাদের সবার মুখে মেরা নাম জোকার  ছবির সেই বিখ্যাত গান ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে জিনা ইঁহা মরনা ইঁহা , ইসকে সিবা জানা কাঁহা ‘। অনেকে আবার এই ছবিরই ডায়লগ বলছেন, জিয়েগা ডি এহি ,মরেগা ভি এহি ,মরেগা ভি এহি ,জিয়েগা ভি এহি

এমনই ছবি শহর কলকাতার আনাচে কানাচে। সীমান্তবর্তী সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা গুলিতে আতঙ্ক আরও তীব্র। ভিটে মাটি হারানাের সেই আতঙ্কই রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে অনেকের। সেই আতঙ্কে দিশেহারা মানুষজন নিজেদের মধ্যে তিক্ততা ভুলে আরও বেঁধে বেঁধে থাকার চেষ্টা করছে। কেউ ফিরে যাচ্ছেন তার শৈশব ও কৈশােরের দিন গুলিতে। তিল তিল পরিশ্রম করে এ রাজ্যকে তারা নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা করে তুলেছেন গড়ে তুলেছেন মাথার উপর ছাদ। কিন্তু নাগরিকত্ব সংশােধিত আইন তাদেরকে নতুন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কঠিন বাস্তবের মুখােমুখি। এক অজানা আশঙ্কা তাদের মনের মধ্যে গ্রাস করেছে।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে গিয়ে টুকরাে টুকরাে অভিজ্ঞতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সব থেকেও কেমন যেন অনেক কিছুর ওপর অধিকার হারানাের আশঙ্কা চেপে বসেছে তাদের মনের মধ্যে। নতুন করে আবার ঠাইনাড়া হতে হবে নাতাে? মানসিক শক্তি আর আগের মতাে নেই। শরীরের সাথে সাথে মনেরও বয়স বেড়েছে অনেক। ফলে লড়াই করার শক্তিটা এখন আগের থেকে অনেক কম। কিন্তু ভেঙে পড়লে তাে চলবে না? প্রয়ােজনে বাঁচার তাগিদে রাস্তায় নামতে হবে। এমনই কথা শােনা গেল তাদেরই মধ্যে থেকে।

অশােক একা নন, অমিত, সন্ধ্যা, ছটুরা এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলােচনায় মশগুল। ১৯৫০ সালের নথিকে সামনে রেখেই নতুন করে শান দিচ্ছে অস্ত্রে। কোনও মতেই তারা ভিটে ছাড়া হবেন না। এক্ষেত্রে অবশ্য তারা আর একা নন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের পাশে রয়েছেন। পথে নামছেন তিনি। অশােক, সন্ধ্যা, অমিত, ছটুদের কাছে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনজন। রক্তের সম্পর্ক নাই বা থাকল কিন্তু এই একটা ইস্যু তাদেরকে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছে। বামেরাও তৈরি হচ্ছে, নিজেদের মতাে করে পথে নামবে কংগ্রেসও।

এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল আরও কাছাকাছি আসুক চাইছেন কলােনীর বাসিন্দাদের সিংহভাগ অংশ। সে কারণেই আওয়াজ উঠছে- ‘পথে এবার নামাে সাথী, পথেই হবে পথ চলা’।

মেরা জুতা হ্যায় জাপানি , ইএ পাৎলুন ইংলিশস্তানি , সরপে লাল টোপি রুশি , ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি – এই গানটির মধ্যেই রয়েছে ভারতবর্ষের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ছবি। দেশ জুড়ে নাগরিকত্ব সংশােধনী আইন পাশ হওয়ায় এই গানের শেষ পর্যন্ত প্রয়ােজনীয়তা ফুরায় কিনা তা সময়ই বলবে। তবে হিন্দুস্তানিবাসীর দিল যে এতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ অবকাশ নেই। আধুনিক সভ্যতার গাণিতিক যুগে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহদের হাত ধরে যে নতুন ভারতবর্ষ (মেক ইন ইন্ডিয়া) তৈরি হতে চলেছে সেই ভারতবর্ষে যদি সত্যি সত্যি আত্মপ্রকাশ ঘটে তার জন্য যে অনেককেই মূল্য দিতে হবে এই আশঙ্কা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে।

ইতিমধ্যে অসমে নাগরিকত্ব সংশােধনী আইনকে কেন্দ্র করে পাঁচজন মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। উত্তাল বাংলাও। এ আঁচ ছড়িয়েছে রাজধানী দিল্লিতেও। সবকিছু মােটামুটি ঠিকঠাকভাবে চলছিল। নােটবন্দির ক্ষত ভুলে মানুষজন যখন একটু থিতু হওয়ার চেষ্টা করছে ঠিক তখনই তিন তালাক বিল ও পরে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলােপ। এর কম্পন কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় যখন তৈরি হচ্ছে দেশের আম জনতা ঠিক সেই সময়েই লােকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হল নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল। এরপরেই ঘটল ছন্দপতন। মােদি-অমিত শাহ’রা কাশ্মীরের জন্য ব্লু প্রিন্ট আগেই কষে রেখেছিলেন। সে কারণে ৩৭০ ধারা কাশ্মীরে বড়সড় অশান্তি কিংবা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু হােমওয়ার্ক না করেই এই বিল আইনে পরিণত করায় বিজেপির নিজের রাজ্যে অসমেই পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এভাবেই ঘটে ছন্দপতন।

নতুন করে ভিটে মাটি হারানাের যন্ত্রণায় কাতর মানুষজন এবার নিদ্রাহীন হতে চলেছেন। মেক ইন ইন্ডিয়ার মাধ্যমে নতুন সকালের স্বপ্নে বুদ মােদি-অমিত শাহ’রা। কিন্তু দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে যারা এদেশে চলে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার শিকড় রয়েছে এমন মানুষ জনও বুঝতে পারছেন না এই ইন্ডিয়ার নতুন সকাল প্রাচীন সনাতন ভারতের চেয়ে কতটা আলাদা হবে। সত্যিকারের এই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সকাল তাদের জীবনে অন্ধকার দূর করা দুরের কথা আরও নতুন করে ঠেলে দিচ্ছে গভীর আঁধারে। সে কারণে তারা বলছে বিজেপি পরিচালিত ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র এ কোন সকাল যা ক্ষতবিক্ষত করে ভারতের হৃদয়। এই সকাল আসলে রাতের চেয়েও অন্ধকার।