বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর সংক্রান্ত কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মঘাতী হলেন এক বুথ স্তরের আধিকারিক। শনিবার সকালে বাঁকুড়ার রানিবাঁধের রাজাকাটা মাঝেরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ক্লাসরুম থেকে উদ্ধার হল বিএলও হারাধন মণ্ডলের ঝুলন্ত দেহ। দেহের পাশ থেকে উদ্ধার হওয়া সুইসাইড নোটে সরাসরি এসআইআর-এর কাজের চাপে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছেন তিনি। এই ঘটনাকে ঘিরে রাজ্য জুড়ে নতুন করে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক চাপানউতোর চরমে পৌঁছেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই মৃত্যুর জন্য সরাসরি নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছেন। তাঁর অভিযোগ, অপরিকল্পিত ও জটিল পদ্ধতিতে এসআইআর চালু করেই কমিশন এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অন্যদিকে, বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক মঙ্গল পান্ডে পাল্টা দাবি করেছেন, ‘বিহারে একই কাজ শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছে। বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী প্রথম থেকেই এসআইআরের বিরোধিতা করায় প্রশাসন ও শাসক দল বিএলও-দের উপর চাপ তৈরি করেছে। এই ঘটনার দায় রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে।’
Advertisement
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃত হারাধন মণ্ডল রাজাকাটা মাঝেরপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি রানিবাঁধের ২০৬ নম্বর বুথের বিএলও হিসেবে দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। ওই বুথের কয়েকজন ভোটারের এসআইআর সংক্রান্ত শুনানির নোটিস এসেছিল। সেই সংক্রান্ত নথিপত্র জোগাড়ের কথা বলে রবিবার সকাল প্রায় দশটা নাগাদ তিনি বাড়ি থেকে বের হন। দীর্ঘ সময় ফিরে না আসায় পরিবারের লোকজন খোঁজ শুরু করেন। পরে স্কুলে গিয়ে একটি ক্লাসরুমে সিলিং ফ্যানে গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁর দেহ ঝুলতে দেখা যায়।
Advertisement
পুলিশ জানিয়েছে, মৃতদেহের পাশে একটি হাতে লেখা সুইসাইড নোট পাওয়া গিয়েছে। সেই নোটে হারাধন লিখেছেন, ‘আমি আর চাপ নিতে পারছি না। বিদায়।’ এর পরের লাইনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই বিএলও কাজের জন্য আমিই দায়ী। এর সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। ভুল আমার।’ নোটে নিজের পুত্রের কথাও উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ছেলেকে কোনও কাজ করতে দেননি, সব দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিলেন। শেষাংশে লেখা, ‘আমি কাউকেই বিশ্বাস করি নাই। সব ঠিক করেও ভুল করলাম। ক্ষমা কর আমাকে।’
বর্তমানে রাজ্য জুড়ে এসআইআরের দ্বিতীয় পর্বের কাজ চলছে। এনুমারেশন ফর্ম বিলি ও সংগ্রহ পর্ব শেষ হওয়ার পরে শুরু হয়েছে শুনানি। ‘নো ম্যাপিং’ ভোটারদের নোটিস পাঠিয়ে শুনানিতে ডাকা হচ্ছে এবং তথ্য যাচাই চলছে। রবিবার ছিল শুনানির দ্বিতীয় দিন। সেই দিনই সকালে আত্মঘাতী হন হারাধন।
মৃতের পরিবারের দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই এসআইআরের কাজের চাপের কারণে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। মৃতের ছেলে সোহম মণ্ডল বলেন, ‘বাবার শরীরে নানা সমস্যা ছিল। তবু রাত তিনটে-চারটে পর্যন্ত এসআইআরের কাজ করতে হত। এত চাপ বাবা আর নিতে পারেননি।’ স্ত্রী মালা মণ্ডলের অভিযোগ, ‘ডাক্তার বলেছিলেন রাত ন’টার মধ্যে শুয়ে পড়তে। কিন্তু কাজের চাপে রাতের পর রাত জেগে থাকতে হয়েছে। কোনও দিক থেকেই সহযোগিতা পাননি। সেই অবসাদই আজ সব শেষ করে দিল।’
এই নিয়ে রাজ্যে এসআইআর পর্বে পাঁচ জন বিএলও-র মৃত্যু হল। পূর্ব বর্ধমান, জলপাইগুড়ি, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের পর এ বার বাঁকুড়ায় এই ঘটনা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই এসআইআর-এর নামে সাধারণ মানুষের হয়রানি নিয়ে সরব। তাঁর বক্তব্য, ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে অযথা ভোগান্তি তৈরি করা হচ্ছে। রাজ্যে প্রায় এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার মানুষ শুনানির নোটিস পেয়েছেন, যাঁদের বড় অংশের নাম খসড়া তালিকায় নেই।
এই প্রেক্ষাপটে বুথ লেভেল এজেন্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে তৃণমূল কংগ্রেস। রবিবার প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার বিএলএ-২’কে নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকে দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি স্পষ্ট করে দেন, কোনও বৈধ ভোটারের নাম বাদ যেতে দেওয়া যাবে না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নথি যাচাই, শুনানির নোটিস পৌঁছেছে কি না তা দেখার নির্দেশ দেন তিনি।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এসআইআর পর্বের পরে প্রকাশিত খসড়া তালিকায় রাজ্যে আটান্ন লক্ষের বেশি ভোটারের নাম বাদ পড়েছে। এখন যে শুনানি চলছে, সেখানে মানুষ হতাশ হয়ে ফিরে গেলে নাম বাদ দেওয়ায় সুবিধা হবে। তাই শুনানি কেন্দ্রের পাশে তৃণমূলের সহায়তা শিবির থাকবে এবং বিএলএ-২’দের সক্রিয় থাকতে হবে। তাঁর বক্তব্য, ‘এটা যুদ্ধ। ভোটাধিকার রক্ষা করেই মাঠ ছাড়ব।’
এসআইআর ঘিরে রাজনৈতিক সংঘাত, প্রশাসনিক চাপ এবং একের পর এক বিএলও-র মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। এই আত্মহত্যা সেই চাপেরই এক নির্মম প্রতিচ্ছবি বলে মনে করছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ।
Advertisement



