চাপমুক্ত নয় বিজেপি, টক্কর দিতে তৈরি তৃণমূল

বিধানসভার উপনির্বাচনকে ঘিরে এত উত্তাপ আগে কখনও দেখা যায়নি। নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনার পারা চরমসীমায় পৌঁছেছে।

Written by Debashis Das Kolkata | November 25, 2019 1:17 pm

প্রতীকী ছবি (File Photo: IANS)

বিধানসভার উপনির্বাচনকে ঘিরে এত উত্তাপ আগে কখনও দেখা যায়নি। নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনার পারা চরমসীমায় পৌঁছেছে। তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচন এ রাজ্যের চার রাজনৈতিক দলের কাছে মর্যাদার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অঙ্কের নিরিখে দুটি কেন্দ্রেই এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। একটিতে তৃণমূল।

২০১৯ এর লােকসভা নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে খড়গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে ৪৫ হাজারের বেশি কিছু ভােটে। কালিয়াগঞ্জে বিজেপি এগিয়ে রয়েছে ৫৬ হাজার ভােটে। করিমপুরে অবশ্য তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে ১৪ হাজারের বেশি ভােটের ব্যবধানে। মাত্র ছ’মাস আগে লােকসভার নির্বাচন হয়েছে। তার পরে এই প্রথম বড়সড় পরীক্ষায় বসছে এ রাজ্যের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দল।

খড়গপুর আসনটি রীতিমতাে মর্যাদার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি-তৃণমূলের কাছে। কারণ এই কেন্দ্র থেকেই প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রবেশ করার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষ। সেই দিলীপই এখন মেদিনীপুর লােকসভার সাংসদ। স্বাভাবিকভাবে এই আসনটি ধরে রাখার জন্য ভেতরে ভেতরে বিজেপি ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। ৪৫ হাজার ভােটে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও বিজেপির শীর্ষ নেতাদের ফুরসত ফেলার সময় ছিল না। তাদের রক্তচাপ ক্রমশ বাড়ছে কারণ এই আসনটিতে তৃণমূলের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রতিকুল পরিবেশকে অনুকুলে আনার ক্ষেত্রে যার জুড়ি মেলা ভার সেই শুভেন্দু অধিকারী খড়গপুর সদর বিধানসভার দায়িত্বে রয়েছেন। সে কারণে রাতের ঘুম চলে গিয়েছে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষের। অঙ্ক বিজেপির হয়ে কথা বললেও আবেগ কিন্তু রয়েছে তৃণমূলের সঙ্গে। সে কারণে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী প্রদীপ সরকারের নির্বাচনী প্রচারে যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গিয়েছে।

একদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন, অন্যদিকে শুভেন্দুর সাংগঠনিক ক্যারিশমা, সেই সঙ্গে পিকের পরামর্শ। এই তিন অস্ত্রে বিজেপিকে ঘায়েল করতে চাইছে তৃণমূল। উৎসাহ এবং আবেগ শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের ভােটবাক্সে বসন্ত আনতে পারে কিনা তার দিকে তাকিয়ে গােটা রাজনৈতিক মহল।

অন্যদিকে বসে নেই বিজেপিও। বঙ্গ বিজেপি তাদের সমস্ত শক্তি উজাড় করে দিয়েছে এই আসনটি ধরে রাখার জন্য। তেলেঙ্গানার বিজেপি বিধায়ক থেকে শুরু করে ভােজপুরী গায়ককে নির্বাচনী প্রচারে নিয়ে এসে মিনি ইন্ডিয়ার জনগণের মন জয় করার চেষ্টার কসুর করেননি বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘােষ। কারণ এই কেন্দ্রে যিনি বিজেপি’র প্রার্থী হয়েছেন তিনি দিলীপ ঘনিষ্ঠ প্রেমাদ ঝা। । সে কারণে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দিতে নারাজ বিজেপি রাজ্য সভাপতি।

অন্যদিকে অনেক যুদ্ধের নায়ক শুভেন্দু অধিকারীও নির্বাচনী জনসভায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘দিলীপবাবু বয়সে আমার চেয়ে সিনিয়র হতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিতে নয়’। এই মন্তব্যের মধ্যেই খড়গপুর আসনকে ঘিরে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে কতটা স্নায়ুর লড়াই রয়েছে তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না।

অন্যদিকে নির্বাচনী লড়াইয়ে এবারই প্রথম সরাসরি জোট করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে বাম-কংগ্রেস। ভােটব্যাঙ্কের রক্তক্ষরণ কমিয়ে ঠিক কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারল বাম কংগ্রেস তার পরীক্ষাও আজ। কংগ্রেসের প্রয়াত প্রাক্তন বিধায়ক জ্ঞান সিং সােহনপাল ১১ বার বিধায়ক হয়েছিলেন খড়গপুর সদর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে । ২০১৬ বিধানসভার নির্বাচনে ৬ হাজারেরও বেশি ভােটে চাচাকে হারতে হয় দিলীপ ঘােষের কাছে।

এবার সেই চাচার আসনে প্রার্থী হয়েছেন কংগ্রেসের মাস্টারমশাই। চাচার ছায়ায় কংগ্রেস প্রার্থী চিত্তরঞ্জন মণ্ডল চাইছেন তৃণমূল ও বিজেপির অঙ্ক গুলিয়ে দিতে। তৃণমূল ও বিজেপির টানটান লড়াইয়ের মধ্যে বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থীকে অবহেলা করছে না খড়গপুর। কারণ এই প্রার্থী যুযুধান দুই প্রতিপক্ষের বাড়া ভাতে ছাই দিতে পারেন। ভােট ময়দানে রয়েছে বিজেপির বিক্ষুব্ধ প্রার্থীও। যদিও শেষ মুহুর্তে দল তাকে বহিষ্কার করে। পুলিশ রিপাের্ট বলছে, তৃণমূল নেতারা খড়গপুরে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়লে তৃণমূলের জয় সময়ের অপেক্ষা।

যদিও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব সেকথা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, পুলিশ নবান্নকে খুশি করতে মনগড়া রিপাের্ট পাঠিয়েছে। এমনই এক আবহের মধ্যে আজ ভােট। শেষ পর্যন্ত মর্যাদার এই লড়াইয়ে খড়গপুরে কে জয়ী হয় এখন সেটাই দেখার। অঙ্কের নিরিখে কালিয়াগঞ্জে বিজেপি এগিয়ে রইলেও ফ্রন্টফুটে খেলছে তৃণমূলও। কারণ খড়গপুরের মতাে উত্তর দিনাজপুর জেলার এই বিধানসভা আসনটিতেও শুভেন্দু অধিকারী দায়িত্বে রয়েছেন।

শুভেন্দু ছাড়াও তৃণমুলের হেভিওয়েট বেশ কয়েকজন নেতাকে এই কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে দেখা গিয়েছে। রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিধানসভা কেন্দ্রে লাগাতার প্রচার করেছেন। এই বিধানসভা কেন্দ্রটির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখতে তৃণমূল বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে।

কালিয়াগঞ্জে বিজেপির হাতিয়ার যদি মেরুকরণ হয়, তাহলে তৃণমূলের হাতিয়ার এনআরসি জুজু। একদিকে বিজেপির নাগরিকত্ব সংশােধনী বিল, অন্যদিকে তৃণমূলের এনআরসি বিরােধিতা, এই বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারে এটাই মূল ইস্যু। এই কেন্দ্রের বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থী হয়েছে ধীতশ্রী রায়। তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছেন তপন দেয়। বিজেপির টিকিটে লড়ছেন কমল সরকার। তিনি উত্তর দিনাজপুর জেলার একমাত্র বিজেপির জেলা পরিষদ সদস্য। এই কেন্দ্রে রাজবংশী ভােট অন্যতম ফ্যাক্টর হতে চলেছে।

অঙ্কের নিরিখে বিজেপি এগিয়ে থাকলেও তৃণমূলও পিছু হঠতে রাজি নয়। যদিও ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে প্রমথনাথ রায় এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুতেই এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তবে দিন যত সামনের দিকে এগিয়েছে এই কেন্দ্রে ততই ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে বাম-কংগ্রেস। স্বাভাকিভাবে এই কেন্দ্রে নির্বাচনী লড়াইটা সীমাবদ্ধ বিজেপি-তৃণমুলের মধ্যে।

নদিয়া জেলার করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন ঘিরেও আশা-আশঙ্কার দোলাচলে রাজনৈতিক দলগুলি। যদিও অঙ্কের নিরিখে এই কেন্দ্রে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। করিমপুর নদিয়া জেলার মধ্যে হলেও আসলে এটি মুর্শিদাবাদ লােকসভা কেন্দ্রের অধীন। মহুয়া মৈত্র সাংসদ হয়ে যাওয়ায় এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন হচ্ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বিমলেন্দু সিংহরায়, বিজেপির জয়প্রকাশ মজুমদার এবং বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী গােলাম রাবি এই তিনজনের মধ্যেই জোরদার টক্কর হওয়ার সম্ভাবনা।

যদিও এই কেন্দ্রটিকে ধরে রাখতে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র সংসদে শীতকালীন অধিবেশন ছেড়ে করিমপুরে পড়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে এই আসনটি মহুয়ার কাছে অনেকটা মর্যাদার লড়াইয়ের মতাে। করিমপুরে নােটায় ভােট পড়েছিল ১৪ হাজার। এই অঙ্কই অনেক হিসেব গুলিয়ে দিতে পারে। সেদিকে নজর রেখে নিজেদের কৌশল তৈরি করেছে তিন পক্ষই।

প্রার্থীপদ নিয়ে বিজেপির মধ্যে অসন্তোষ ছিল। তবুও নিখাদ তৃণমূল বিরােধিতাকে উচ্চগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই কেন্দ্রে জয়প্রকাশ মজুমদারকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের সঙ্গেই রয়েছে। সে কারণে তৃণমূলের এখানে ট্রাম্পকার্ড বিমলেন্দু সিংহরায়। বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থী সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই এলাকায় পরিচিত। তাই সার্বিকভাবে বাম কংগ্রেসও তুলনামূলকভাবে ভালাে ফল করতে পারে এই কেন্দ্রে।

এই তিন কেন্দ্রের বিধানসভা উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ভােটের আগে থেকেই চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। পিছিয়ে থেকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দুই কেন্দ্রে লড়ছে তৃণমূল। বিজেপি দুই কেন্দ্রে এগিয়ে থেকেও চাপমুক্ত নয়। এটাই এই নির্বাচনের মূল নির্যাস। অন্যদিকে করিমপুর আসনেও লড়াই দিতে রীতিমতাে কোমর বেঁধে নেমেছে বিজেপি। আগামী ২৮ নভেম্বর এই তিন কেন্দ্রের নির্বাচনী ফলাফল ঠিক করে দেবে আগামী দিনে এই বঙ্গে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কোনদিকে বইবে একথা হলফ করে বলা যেতেই পারে।