পশ্চিমের গড়বেতা ভেঙে দিয়েছে পার্থবাবুর ঝাড়গ্রাম জয়ের স্বপ্ন

জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।

Written by SNS Kolkata | June 10, 2019 3:33 pm

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Photo: IANS)

জঙ্গলমহলের উন্নয়নের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। বিগত বাম সরকারের আমলের শেষের দিকে জঙ্গলমহলে অতি বামপন্থীদের সক্রিয়তা বহুগুন বেড়ে গিয়েছিল। বুলেট ও বারুদের দাপাদাপিতে রীতিমতাে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল জঙ্গলমহলের সাধারণ মানুষের জীবন। রক্তের হােলিখেলা লেগেই ছিল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর জঙ্গলমহলের স্বাভাবিক ছন্দ তিনি ফিরিয়ে আনেন। জঙ্গলমহলের শান্তিকে চিরস্থায়ী করার ডাক দিয়ে উন্নয়নে জোয়ার আনেন পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায়। বিগত বাম সরকারের আমলে উন্নয়নের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকা মানুষজন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বিগত বাম সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে যারা মাওবাদীদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন তাদের অনেকেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসে সরকারী প্যাকেজ গ্রহণ করে।

২০১৪ সালে লােকসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলের প্রতিটি লােকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ী হন। ঝাড়গ্রাম লােকসভা কেন্দ্র থেকে ২০১৪ সালের লােকসভা নির্বাচনে ডা. উমা সােরেন তিন লক্ষ সাতচল্লিশ হাজারেরও বেশি ভােটে জয়ী হন। ২০১৪ সালে এত বিপুল ব্যবধানে জয়ী হওয়া আসন ২০১৯এর লােকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী বীরবাহা সােরেন টুডু এগারাে হাজারেরও বেশি ভােটে বিজেপি প্রার্থী কুণার হেমব্রমের কাছে পরাজিত হন।

লােকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের অভাস অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে। পঞ্চায়েত নিবাচনে ঝাড়গ্রাম জেলায় প্রায় ৭৩ শতাংশ পঞ্চায়েত বিজেপি, মাজি পরগনা মহল, আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ ও ভূমিজদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের আশানুরূপ ফল না হওয়ায় চূড়ামনি মাহাতকে মন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। যখন ঝাড়গ্রাম জেলা আত্মপ্রকাশ করে সেই সময় চূড়ামনি মাহাতকে শাসকদলের জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

২০১৭ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঝাড়গ্রামে যান বিজয়া সম্মিলনী করতে। সেই সময় অজিত মাইতিকে পশ্চিম মেদিনীপুরের পাশাপাশি ঝাড়গ্রাম জেলার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুরের সভাধিপতি উত্তরা সিং হাজরাকে বলা হয় ঝাড়গ্রাম জেলার উন্নয়নে পরামর্শ দেওয়ার জন্য।

পঞ্চায়েত নির্বাচনে নির্বাচনের টিকিট সঠিকভাবে বিলি না হওয়ায় বিস্তর অভিযােগ ওঠে। ঝাড়গ্রাম জেলার শাসক দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা নিজেদের পকেটের লােককে টিকিট পাইয়ে দেন পঞ্চায়েতের। সেই সঙ্গে অভিযােগ ওঠে ঝাড়গ্রামে কি কোনও নেতা নেই যে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে নেতা নিয়ে এসে ঝাড়গ্রামে তৃণমূলকে চালাতে হবে?

ঝাড়গ্রামে শাসকদলকে সাবলম্বী করতে অজিত মাইতিকে ঝাড়গ্রাম জেলার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জঙ্গলমহলের উন্নয়নকে সাধারণ মানুষের দোরগােড়ায় পৌছে দেওয়ার জন্য দু টাকা কেজি দরে চাল, সেতুনির্মাণ, রাস্তাঘাট তৈরি, পানীয় জলের সমস্যার সমাধান, বেকার সমস্যার সমাধান, আইটিআই সহ নানাবিধ উন্নয়ন মূলক প্রকল্প বাস্তবায়িত করা হয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলায়। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের আশানুরূপ ফল না হওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি তৃণমূল সুপ্রিমাে।

এরপর ঝাড়গ্রাম জেলায় পর্যবেক্ষক করে পাঠানাে হয় তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব তথ্য রাজ্য মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। সেই সঙ্গে ঝাড়গ্রাম বিধানসভার বিধায়ক তথা প্রাক্তন পশ্চিমাঞ্চল ও আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী ডা. সুকুমার হাঁসদাকে ঝাড়গ্রাম জেলার কোর কমিটির চেয়ারম্যান করে একটি কোর কমিটি গড়ে তােলেন পার্থ বাবু। দায়িত্ব পাওয়ার পর পার্থবাবু প্রথমে সংগঠনের খােলনলচে বদলে দেন তৃণমূল সুপ্রিমাের নির্দেশ মেনে।

অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং দক্ষ সংগঠকদের হাতে ব্লকগুলির দায়িত্ব দেন সংগঠনের। এই রদবদলে সাফল্যও আসে। ২০১৮ সালের ২১ জুলাই এর মঞ্চে ৭৬ টি বিরােধী পঞ্চায়েত তৃণমূলে যােগদান করে। ঝাড়গ্রাম জেলায় অনেকগুলি অঞ্চল যেগুলিতে বিরােধীদের আধিপত্য ছিল সেগুলি অতি সহজেই তৃণমূলের দখলে আসে। সেই সঙ্গে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম বিধানসভা ও গােপীবল্লভপুরে বিজেপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অজয় কুমার সেন ও সুশীল ঘােষ পার্থবাবুর হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেসে যােগদান করেন।

বিজেপির অনেক মন্ডল সভাপতি এবং মন্ডল সম্পাদক তৃণমূল কংগ্রেসে আসেন। রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারে পার্থবাবু বহুবার ঝাড়গ্রামে গিয়েছেন, দলের ছােট বড় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বৈঠকও করেছেন। দলের কোথায় কি ধরনের ফাঁক ফোঁকর রয়েছে তা খুঁজে বের করে মেরামত করার চেষ্টাও করেছেন যথাসাধ্য।

প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু বিশুই পার্থবাবুর প্রতিনিধি হয়ে ঝাড়গ্রামে গিয়েছেন। সেইসঙ্গে ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের কোর কমিটির চেয়ারম্যান ডা. সুকুমার হাঁসদাও চেষ্টা করেছেন পার্থবাবুর নির্দেশ মেনে কাজ করতে। কিন্তু ভােটের ফলাফলে দেখা যায় ঝাড়গ্রাম জেলা পুনরুদ্ধার প্রায় হয়ে গেলেও পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা বিধানসভা যা তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী বীরবাহা সােরেন টুডু পিছিয়ে যায় ৬৮১১ টি ভােটে। শালবনী বিধানসভায় কিছুটা ঘাটতি পূরণ করলেও বান্দোয়ানে ২৯৭০ টি ভােটে পিছিয়ে পড়েন তৃণমূল প্রার্থী। গড়বেতা বিধানসভার বিধায়ক আশিস চক্রবর্তী কমপক্ষে ৩৫-৪০ হাজার ভােটে লিড দেবেন এমনটাই দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন। চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু গড়বেতা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি দিলীপ পাল, তৃণমূলের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি লিপিকা গিরি ও সঞ্জয় মন্ডলের নেতারা বিজেপিতে যােগদান করায় গড়বেতায় তৃণমূল কিছুটা হলেও দুর্বল হয়ে পড়ে।

এদিকে নয়াগ্রাম বিধানসভায় বিজেপির ঝুলিযতে যায় ৮৪৩১৬ টি ভােট। তৃণমূল পায় ৮০৯৭৮ টি ভােট। ঝাড়গ্রাম বিধানসভায় বিজেপির প্রাপ্ত ভােট ৮৩৫৪০ তৃণমূলের প্রাপ্ত ভােট ৮২০৪৫ টি। গােপীবল্লভপুর বিধানসভায় বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছে ৮৮৬৭২ টি ভােট। এখানে তৃণমূল পেয়েছে ৮১৮৩৬ টি ভােট। গড়বেতা বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছে ৯১৩২৮ টি ভােট, তৃণমূল পেয়েছে ৮৪৫১৭ টি। শালবনি বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছে ১০৩৭০৬ টি ভােট তৃণমূল পেয়েছে ১১২৪৩১ টি। বিনপুর বিধানসভায় তৃণমূল পেয়েছে ৭৬১৯৬, বিজেপির প্রাপ্ত ভােট ৭৩১৩৮, বান্দোয়নে বিজেপির প্রাপ্ত ভােট ৯৮০৩৯, তৃণমূলের ঝুলিতে গিয়েছে ৯৫০৬৯ টি ভােট।

পরিসংখ্যান বলছে যদি গড়বেতা তার ভােট অটুট রাখতে পারত তাহলে পর্যবেক্ষক পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় তৃণমূলকে ঘিরে যে স্বপ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেছিলেন তা পূরণ হতে পারত। গড়বেতা বিধানসভার ফলাফল ভেঙে দিল পার্থবাবুর সেই স্বপ্ন।