মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে ফের বড়সড় আলোড়ন। রাজ্যের মহিলাদের আর্থিক ক্ষমতায়নকে সামনে রেখে ‘লাডলি বেহনা যোজনা’য় মাসিক অনুদান বাড়িয়ে ৫ হাজার টাকা করার রূপরেখা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব। শুধু তাই নয়, আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে অতিরিক্ত সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রস্তুতিও ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর থেকেই রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চর্চা।
মধ্যপ্রদেশ সরকারের দাবি, রাজ্যের মা-বোনেদের স্বনির্ভর করে তোলাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘লাডলি বেহনা যোজনা’ শুধু ভোটের প্রতিশ্রুতি নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক প্রকল্প। ধাপে ধাপে অর্থ বাড়িয়ে মহিলাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের উদ্দেশ্য।
Advertisement
বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প যেমন রাজ্যের মহিলাদের মধ্যে নতুন ভরসা তৈরি করেছে, মধ্যপ্রদেশে ঠিক তেমনই প্রভাব ফেলেছে ‘লাডলি বেহনা যোজনা’। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ঘোষণা করে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই পথেই হেঁটে মধ্যপ্রদেশেও মহিলাদের জন্য মাসিক আর্থিক সহায়তার প্রকল্প চালু হয়।
Advertisement
প্রথমে এই যোজনায় মহিলারা মাসে ১ হাজার টাকা পেতেন। পরে তা বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ২৫০ টাকা। চলতি বছরে দীপাবলির পর ভাইফোঁটার উপহার হিসেবে আরও ২৫০ টাকা যোগ হয়। ফলে বর্তমানে ‘লাডলি বেহনা’দের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ঢুকছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। প্রতি ইংরেজি মাসের ১০ তারিখে এই টাকা সরাসরি মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব জানিয়েছেন, সরকার এখানেই থেমে থাকবে না। তাঁর কথায়, ‘আমরা ধাপে ধাপে টাকা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী বিধানসভা নির্বাচন, অর্থাৎ ২০২৮ সালের আগেই রাজ্যের মহিলারা প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে পাবেন। তার জন্য আর্থিক পরিকল্পনা এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।’
এই ঘোষণার রাজনৈতিক গুরুত্ব কম নয়। ২০২৩ সালের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে ‘লাডলি বেহনা যোজনা’ বিজেপির জন্য কার্যত গেম চেঞ্জার হয়ে উঠেছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত। মহিলাদের বড় অংশ এই প্রকল্পের সুফল পাওয়ায় বিজেপির পক্ষে জনসমর্থন জোগাড় করা সহজ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখেই বর্তমান সরকার আরও এক ধাপ এগোতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে বিরোধীদের প্রশ্নও কম নয়। কংগ্রেসের অভিযোগ, ভোটের আগে বড় বড় ঘোষণা করলেও বাস্তবে প্রতিশ্রুতি পূরণে গড়িমসি করছে সরকার। কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, ২০২৩ সালের নির্বাচনের সময় বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মাসে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু সরকার গঠনের পর দীর্ঘ সময় ধরে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ধাপে ধাপে মাত্র ২৫০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে, যা বিরোধীদের মতে প্রতারণা।
কংগ্রেস আরও দাবি করেছে, প্রকল্পটি আদৌ দীর্ঘমেয়াদি কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। অতীতে একাধিক রাজ্যে এই ধরনের প্রকল্প চালু হলেও পরে আর্থিক চাপে তা বন্ধ বা সীমিত করা হয়েছে। সেই আশঙ্কা থেকেই তারা বারবার প্রশ্ন তুলছে, ‘লাডলি বেহনা যোজনা’ ভবিষ্যতেও একই ভাবে চলবে তো?
এই সমালোচনার জবাবে মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, ‘এই প্রকল্প বন্ধ করার কোনও প্রশ্নই নেই। আমরা ধাপে ধাপে প্রতিশ্রুতি পূরণ করছি। প্রথমে ১ হাজার, তারপর ১ হাজার ২৫০, এখন ১ হাজার ৫০০ টাকা। আগামী দিনে তা ৫ হাজার টাকায় পৌঁছবে।’ তাঁর দাবি, আর্থিক ভারসাম্য বজায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
রাজ্য সরকারের অন্দরমহলের খবর, মহিলাদের জন্য অতিরিক্ত সাড়ে ৩ হাজার টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা মূলত নির্বাচনের আগেই কার্যকর করার চেষ্টা চলছে। অর্থাৎ মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত সহায়তা মিলিয়ে এককালীন বড় অঙ্কের টাকা পেতে পারেন উপভোক্তারা। এতে করে গৃহস্থালির খরচ, চিকিৎসা, সন্তানদের পড়াশোনা—বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের উপর নির্ভরশীলতা কমবে বলেই সরকারের দাবি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগামী দিনে মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে মহিলাদের ভোট আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ‘লাডলি বেহনা যোজনা’ সেই ভোটব্যাঙ্ককে আরও মজবুত করার কৌশল বলেই মনে করা হচ্ছে। একদিকে যেমন বিজেপি এই প্রকল্পকে হাতিয়ার করে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে চাইছে, তেমনই কংগ্রেসও বিকল্প প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহিলাদের মন জয়ের চেষ্টা করছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘লাডলি বেহনা যোজনা’ এখন আর শুধু একটি সামাজিক প্রকল্প নয়, মধ্যপ্রদেশের রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মাসে ৫ হাজার টাকা পাওয়ার ঘোষণায় মহিলাদের প্রত্যাশা যেমন বেড়েছে, তেমনই আগামী নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপও বাড়ছে।
Advertisement



