• facebook
  • twitter
Thursday, 25 December, 2025

ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন সংকট

ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার এক বিরল স্থিতিশীল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। সীমান্ত সমস্যা, ছিটমহল বিনিময়, সন্ত্রাসদমন সহযোগিতা থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও যোগাযোগ— বহু ক্ষেত্রেই দুই দেশ পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে এগিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে নাটকীয় পটপরিবর্তন ঘটল, তার অভিঘাত এখন স্পষ্টভাবে পড়ছে এই সম্পর্কে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার এক বিরল স্থিতিশীল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। সীমান্ত সমস্যা, ছিটমহল বিনিময়, সন্ত্রাসদমন সহযোগিতা থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও যোগাযোগ— বহু ক্ষেত্রেই দুই দেশ পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে এগিয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে নাটকীয় পটপরিবর্তন ঘটল, তার অভিঘাত এখন স্পষ্টভাবে পড়ছে এই সম্পর্কে।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হঠাৎ ভারতে আশ্রয় নেওয়া কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি বাংলাদেশের ক্ষমতার ভারসাম্যে গভীর রদবদলের ইঙ্গিত। তাঁর অনুপস্থিতিতে যে অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, সেখানে মৌলবাদী ও কট্টর শক্তির দৃশ্যমান উত্থান ভারতকে নতুন করে উদ্বিগ্ন করেছে। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা বলছে— বাংলাদেশে যখনই ধর্মীয় উগ্রতা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পায়, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও সীমান্ত নিরাপত্তায়।

Advertisement

এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে হিন্দু যুবক দীপুচন্দ্র দাসের নৃশংস হত্যা শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি সংখ্যালঘু নিরাপত্তা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একই সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন ভিসা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কার্যত অচল হয়ে পড়া দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ঐতিহ্যকেও বিপন্ন করছে। চিকিৎসা, শিক্ষা ও আত্মীয়তার সূত্রে যে ঘনিষ্ঠ জন-সংযোগ এতদিন ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের নীরব ভিত্তি ছিল, তা আজ চাপের মুখে।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে ভারতের কর্তব্য কী? প্রথমত, আবেগ নয়—কূটনৈতিক সংযমই ভারতের প্রধান শক্তি হওয়া উচিত। বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, সেখানে রাজনৈতিক পালাবদল ভারতের পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্নে নির্ধারিত হতে পারে না। কিন্তু একই সঙ্গে ভারত তার নিরাপত্তা স্বার্থ এবং মানবিক দায়িত্ব থেকেও সরে আসতে পারে না। সংখ্যালঘু সুরক্ষা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ— এই বিষয়গুলিকে স্পষ্ট ও নিরবচ্ছিন্নভাবে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের উচিত কেবল শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের বৃহত্তর নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রগতিশীল শক্তির সঙ্গে সংলাপ জোরদার করা। একটি ‘people-centric diplomacy’ গড়ে তোলার কথাও ভাবা দরকার। এতে ভবিষ্যতে যে কোনও রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হবে।

তৃতীয়ত, সীমান্ত নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসদমন সহযোগিতায় কোনও শৈথিল্য চলবে না। মৌলবাদী শক্তির উত্থান যদি জঙ্গি কার্যকলাপের দিকে মোড় নেয়, তবে তার প্রথম আঘাত আসবে ভারতের উপরেই। এই প্রশ্নে ঢাকায় যে-ই ক্ষমতায় থাকুক, স্পষ্ট ‘রেড লাইন’ টানা জরুরি।

সবশেষে, ভারতকে মনে রাখতে হবে— বাংলাদেশ কেবল প্রতিবেশী নয়, ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে যুক্ত এক সহযাত্রী রাষ্ট্র। সম্পর্কের বর্তমান সংকট দীর্ঘমেয়াদি বিচ্ছেদের দিকে যাবে, নাকি নতুন ভারসাম্যের দিকে— তা অনেকটাই নির্ভর করবে ভারতের দূরদৃষ্টি, ধৈর্য ও নৈতিক অবস্থানের উপর। শক্তির প্রদর্শন নয়, নীতিনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল কূটনীতিই এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।

Advertisement