• facebook
  • twitter
Friday, 19 December, 2025

‘মনরেগা’র নাম বদলে বাঙালিবিদ্বেষী বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে

একজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক, অন্যজন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ত্রাতা হিসাবে বরণীয়। অথচ মত ও পথে দু’জনেই স্বতন্ত্র পথিক। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা গান্ধীজির মনে ধরেনি। আবার গান্ধীজির আন্দোলন প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায়নি। অথচ তারপরেও দু’জনের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক আজীবন ছিল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর দায়িত্ব গান্ধীজির উপরেই ন্যস্ত করতে চেয়েছিলেন।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

বাঙালিবিদ্বেষী আতঙ্ক যে বাঙালিকে পেয়ে বসেছে, তা আজ ঘটনাপরম্পরায় প্রকট হয়ে উঠছে। বাংলার ভাষা থেকে বাংলার গান, বাঙালির আইকন থেকে বাঙালির অবদান সর্বত্র বাঙালিবিদ্বেষের ছায়া ক্রমশ বাঙালির মননকে আচ্ছন্ন করে তোলায় কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবর্তিত উদ্যোগেও বাঙালির মনে কু-ডেকে ওঠে। সম্প্রতি গ্রামীণ এলাকায় একশ দিনের কাজের জনপ্রিয় আইনের নাম পরিবর্তন করে তা নব রূপে পরিকল্পিত হয়েছে। সেখানে ১০০দিনের পরিবর্তে ন্যূনতম কাজের গ্যারান্টি করা হয় ১২৫ দিন। অন্যদিকে ‘মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার গ্যারান্টি’ (Mahatma Gandhi National Rural Employment Scheme বা চলতি কথায় ‘মনরেগা’) আইনকে ‘পূজ্য বাপু গ্রামীণ রোজগার যোজনা’ করার পরিকল্পনা চলছে। আর সেখানেই বাঙালিবিদ্বেষী ছায়া কায়া বিস্তার করেছে। এতে রাজ্যের শাসক দল তথা দেশের বিরোধী দল বহুল প্রচারিত আইনটির নাম পরিবর্তনের মধ্যে বাঙালির অবদানকে অস্বীকারের অভিযোগ তুলেছে।

Advertisement

সেখানে গান্ধীজিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া ‘মহাত্মা’ নাম মুছে দেওয়ার আয়োজন মনে করা হচ্ছে। আতঙ্কগ্রস্ত হোক আর বাতিকগ্রস্তই হোক অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতই হোক, তথ্যের বিকৃতি অস্বাভাবিক নয়। শুধু তাই নয়, সেখানে তথ্যগত সত্যের চেয়ে অনুমান বা ধারণাগত বিভ্রান্তির অবকাশ অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

Advertisement

গান্ধীজির ‘মহাত্মা’ নামটি সমধিক জনপ্রিয়তায় তাঁকে বেনামবাদশা করে তুলেছে। তাঁর কিংবদন্তিতুল্য জনপ্রিয়তায় সেই ‘মহাত্মা’র সুবিস্তৃত ঝটের মৃলে আসল মূলটাই চিনে নেওয়াই দায়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বত্রবিস্তারী ব্যক্তিত্বে গান্ধীজিকে ‘মহাত্মা’ বলার মাহাত্ম্যও জুড়ে যায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে ‘মহাত্মা’ তো বলেননি,উল্টে তা বলায় ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছেন স্বয়ং গান্ধীজির কাছেই।

আসলে গান্ধীজির জীবন বিতর্কে মোড়া। তাঁর মতো জনপ্রিয় নেতা কেউ নেই,বিতর্কেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর ঘটনাবহুল দীর্ঘ জীবনও ইতিহাস রঞ্জিত ঘটনাপ্রবাহ। সত্য ও অহিংসার ব্রতে আজীবন স্বনিয়ন্ত্রিত পথে হেঁটেছেন বলেই পাহাড়প্রমাণ ভুলের কথা স্বীকার করেও ‘আমার জীবনই আমার বাণী’কে মূর্ত করে তুলেছেন। সেখানে তাঁর অহিংস নীতি বিশ্ববন্দিত হলেও সাধারণ্যে ‘গান্ধীগিরি’তে রসিকতা নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়,তাঁর সংগ্রামী জীবনেও অহিংস নীতির সহিংস প্রকৃতি বর্তমান। ১৯২১-এ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজি স্বরাজ এনে দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।

কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, ‘যদি আমার আহ্বানে তোমরা সাড়া দাও,আমি প্রতিজ্ঞা করছি এক বছরের মধ্যেই তোমরা স্বরাজ লাভ করতে পারবে।’ গান্ধীজি তাঁর প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারেননি, একুশ বছর পরে তা আদায় করতেই সহিংস আন্দোলনের ডাক দেন।
১৯৪২-এর আগস্টে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’র ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন আজ ইতিহাস। অন্যদিকে তাঁকে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নানাভাবেই মুখর। সেখানে রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, আম্বেদকর, যোগেন মণ্ডল কে নেই! তারপরেও তিনি অবিসংবাদী জাতির জনক, অহিংসার মূর্ত প্রতীক। তাঁর চরকায় ভারত জেগে ওঠে, তাঁর চশমতাতেই স্বচ্ছ ভারত উঠে আসে।

আবার তাঁর বিপুল গ্রহণযোগ্যতাই বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানায়, তাঁর মহান আত্মত্যাগও প্রশ্নকে জিজ্ঞাসা করে তোলে। শুধু তাই নয়, বিতর্কের নানা পরতে তাঁর ‘মহাত্মা’ও প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়।
আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যায়ন নিয়ে উচ্চকিত ধারণাই অজান্তে আমাদের প্রশ্নহীন আনুগত্যের শিকার করে তোলে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের শংসায় জনপ্রিয়তা লাভের সৌরভ শুধু বিমোহিত করে না,বিভ্রান্তিও ছড়ায়। এরকমই একটি বিভ্রান্তি গান্ধীজিকে নিয়েও প্রবহমান। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ‘মহাত্মা’ বলেছেন, এরূপ ধারণা বিভান্তিকর হলেও সাধারণ্যে প্রচার লাভ করে। একথা সাধারণ্যেই শুধু ছড়ায়নি, বইপত্রেও প্রকাশিত হয়েছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে ‘মহাত্মা’ বলেননিই শুধু নয়, তা নিয়ে তাঁকেই রীতিমতো প্রশ্ন করেছেন।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন নিতে কলকাতায় এসেছিলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে না শর্তে জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা ভবনের দোতলায় তাঁদের সেই আলোচনা চলে প্রায় ঘণ্টাচারেক। এই আলোচনাতেই রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে প্রসঙ্গ ক্রমে সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘কিন্তু আপনি কি মহাত্মা?’

বেশকিছু কাল পরে রবীন্দ্রনাথ সেই অপ্রকাশ্যে থাকা সাক্ষাৎকারের কথা তাঁর প্রতিষ্ঠিত শ্রীনিকেতনের রূপকার লেনার্ড এলমহার্স্টকে জানিয়েছিলেন। এলমহার্স্টের দিনলিপিতে লেখা সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ তাঁর ‘Poet and Plowman’ (সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) বইটিতে প্রকাশিত হয়। বইটি বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত। সেখানে গান্ধীজির দেশের জনগণের প্রতিমা বা প্রতীক হিসেবে দেওয়া ‘মহাত্মা’র কথা শুনে যে রবীন্দ্রনাথ সন্তুষ্ট হননি,তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। তাঁর কথায়, ‘গান্ধীজি, আপনার দেশবাসীর সম্পর্কে এমন ধারণা কি সম্মানজনক, একে কি সৎ বলা যাবে?’ অথচ জনমানসে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে ‘মহাত্মা’ বলেছেন বলে পূর্বের ধারণা এখনও প্রবহমান। এজন্য তা নিয়ে সত্যকে শুধু মেনে নেওয়াই নয়, প্রকাশের মাধ্যমে তা যাতে আর না ছড়ায়, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীজির তিক্ততাও কম হয়নি। অথচ দু’জনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাও কম ছিল না। একজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক, অন্যজন দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ত্রাতা হিসাবে বরণীয়। অথচ মত ও পথে দু’জনেই স্বতন্ত্র পথিক।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা গান্ধীজির মনে ধরেনি। আবার গান্ধীজির আন্দোলন প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন পায়নি। অথচ তারপরেও দু’জনের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক আজীবন ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর দায়িত্ব গান্ধীজির উপরেই ন্যস্ত করতে চেয়েছিলেন। আসলে গান্ধীজির ভাবমূর্তি যতই বিতর্কিত হোক, তাঁর জীবনাদর্শই তাঁকে মূর্তি থেকে প্রতিমায় পরিণত করেছে। সেখানে তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বিতর্কের অবকাশ তৈরি করলেও সত্য ও অহিংসার যাপিত জীবনাদর্শে কটিবস্ত্রেই তিনি কোটি কোটি মানুষের পথচলার অগ্রদূত, অকুতোভয় জীবনবিভূতি।

Advertisement