• facebook
  • twitter
Wednesday, 17 December, 2025

বাংলার নবান্নে সুগন্ধি চালের ঘ্রাণ

গরম ফ্যান ভাতের জন্য ঘোড়াশাল, কই ঝুড়ি, ক্লেশ। অবশ্য এগুলি নবান্নের অনেক আগেই উঠে যেত। দীর্ঘ অসুস্থতার পর রোগীর পাতে পড়ত কবিরাজ চালের ভাত।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বিশ্বজিৎ সরকার

নবান্ন শেষ হতে চলল। অগ্রহায়ণের প্রথম দিন থেকে শুরু করে সারা মাস জুড়ে চলে এই উৎসব। বাংলার লোকায়ত জীবনের কৃষিভিত্তিক উৎসব এই নবান্ন। বাংলার কৃষি-সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতেই নবান্নের চল বেশি। তবে উত্তরবঙ্গের রাজবংশি সম্প্রদায়ের মধ্যে নবান্নের চল আছে। বিগত চার দশকে হারিয়ে গিয়েছে বা যেতে বসেছে বাংলার লোকজীবন সম্পৃক্ত বেশকিছু উৎসব। বিশ্বায়নের এক বলগা-সংস্কৃতি রাঢ় বাংলার কৃষিনির্ভর এই প্রাচীন উৎসবটিকে কিন্তু এখনো উদরস্থ করতে পারেনি। তাই এই উৎসব নিয়ে এখনো গ্রামে গ্রামে শোনা যায় সেই ছড়া— ‘লগাঁয়ের লগিন্নি লাউ নিয়ে লদীর লালা পেরুতে পেরুতে বলে লয়ে লবান্য, লা করলেই লয়।’

Advertisement

রাঢ বাংলায় ধান কাটার শুরু থেকেই এই নবান্নের জন্য থাকে আনন্দঘন প্রতীক্ষা। নবান্ন মানে নতুন ধানের অন্ন, ‘নতুন ধান্যে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে’— লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। বীজ ফেলা থেকে তার বপন, পরিচর্যার যে দীর্ঘায়িত ভালোবাসার শ্রম, সেই শ্রমের ফসল প্রথমে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার এই রীতি চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সেই অর্থে নবান্ন নতুন অন্ন গ্রহণেরও অনুষ্ঠান। নবান্নের আগে প্রথম ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরের ছোট ছেলেরা, ঘরে এলে তাকে বরণ করে নেয়। অনেক জায়গায় এই প্রথম বোঝার ধান থেকে চাল করে তা মূল নবান্নের উৎসবের পায়েসে দু’এক মুঠো মিশিয়ে দেয়। হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও তার রীতি নির্দিষ্ট করে বর্ণিত করা রয়েছে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃ-পুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। নবান্ন উৎসবের আর এক প্রথা কাকবলি। একটি কলার পাতায়, নবান্নের চাল এবং ফলমূল কাকের উদ্দেশ্যে খেতে দেওয়া হয়। মানুষের বিশ্বাস কাকের খাওয়ার মাধ্যমে ওই নতুন চাল মৃত পিতৃপুরুষের কাছে পৌঁছে যায়। উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়িতে এই উপলক্ষে বাচ্ছাদের পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। এই নিয়ে ছড়া আছে। ছোট ছেলে-মেয়েরা ছড়া কেটে কাকেদের আমন্ত্রণ জানায়। নবান্নের দিনে রাঢবঙ্গের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা শুকনো কাশফুল পুড়িয়ে অগ্ন্যুৎসব করে।

Advertisement

মাঠ থেকে ধান তুলে নতুন চালের এই যে কৃষি উৎসব নবান্ন, তা উদযাপিত হওয়ার কিন্তু কোন নির্দিষ্ট দিন নেই। আলাদা আলাদা দিনে বিভিন্ন গ্রামে নবান্নের তোড়জোড় হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় দিন-ক্ষণের ব্যাপারে প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থার সেই চিরাচরিত সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর পরম্পরা। নবান্নের রীতিনীতি হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখ থাকলেও বাংলার কৃষি সমাজের অসাম্প্রদায়িক কাঠামো অনুযায়ী এই নতুন ধানের উৎসব একটু ভিন্ন রীতিতে অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও চালু। মুসলমান কৃষিজীবীদের মধ্যেও নবান্নের আবাহন। এই অর্থে নবান্ন এক অর্থে নতুন উৎসাহে জীবনের বাঁচার কথা বলা। এই কথাই বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকের মূল থীম। নবান্নকে কেন্দ্র করে ইদানীং একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয় দেখা যাচ্ছে। গ্রামের সাবেকি লোকক্রীড়া— যেমন, লাঠিখেলা, হাডুডু, ফুটবলের আসর চালু হচ্ছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাউল কীর্তন, কবিগান।

তবে একটা ব্যাপারে নবান্ন উৎসব তার কৌলীন্য হারিয়েছে। ফসল ওঠার মুহূর্তে বাংলার চাষী তার খেতের সেরা ধানটি দেবতাকে উৎসর্গ করে প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করত এই অন্নের উৎসবে। কিন্তু সেই সেরা জাতের ধান বা চাল অনুপস্থিত এখন এই উৎসবে।

কেননা কয়েক দশক আগেই ধানচাষের জগতে ঘটে গেছে ডিজিটাইজেশন। পুষ্টিগুণ সম্পন্ন সুন্দরী সুগন্ধি ধানের পরিবর্তে নানান সংখ্যার ছড়াছড়ি এখন বাংলার চাষের জমিতে। যে আইআর ৮ দিয়ে শুরু হয়েছিল এই কৃষির পত্তনদারি, তা এখন নানান সংখ্যা নিয়ে ১০৩৪-এ দাঁড়িয়েছে। এইরকমই নানান সংখ্যার মোটা নাদুস নুদুস চাল এখন নবান্নর পাতে।

অথচ একসময় নবান্ন উৎসবে নানান সুগন্ধি চালই ছিল এই উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। এই উৎসবে নানান সরু ও সুগন্ধি চালের প্রতিযোগিতা চলত গৃহস্থের ঘরে ঘরে। যার যত রকমারি ধান তার আভিজাত্য তত বেশি, গ্রামের অন্যতম চর্চিত বিষয় ছিল এই রকমারি চাষের দেখনদারি নিয়ে। এই ধানগুলির চালের মধ্যে রসনার আনন্দ যেমন ছিল তেমনি থাকতো নান্দনিক তৃপ্তিবোধ। এলাকার পরিবেশের তারতম্য অনুযায়ী বাংলার বিভিন্ন গ্রাম প্রান্তে দেখা যেত সেই সব সুস্বাদু জাতের ধান। এই ধানগুলি ছিল বাংলার যুগযুগ থেকে চলে আসা নিজস্ব সম্পদ। নিজস্ব জীবন বৃত্তি ও পরিবেশ রক্ষার কৌশলের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। যেমন নবান্নের সরু অভিজাত ধানের মধ্যে সিতেশাল, রূপশাল, কলম কাটি, সরু নাগরা। এই ধানগুলি আবার সামান্য বৃষ্টির জলেই হয়ে যেত। নলসংক্রান্তিতে ঈশান কোণে স্বচ্ছন্দে নল পোঁতা গেলে চাষির মনে স্বস্তি, নল পোঁতা যাচ্ছে মানে মাটি রসা, সুতরাং জল না থাকলেও ধান ঠিক ফলে যাবে। অগ্রহায়ণের প্রথমেই নবান্নের জন্য পাওয়া যেত এই চাল। চাষি আবার পায়েসের চালের জন্য লাগাতেন ভাষা মানিক, কনকচূড়, শ্যামা, তুলসী মঞ্জুরি। খইয়ের জন্য বিন্নি, কালো মানিক,‌মোটা, নাগড়া, দুধে কলমা, ঝিঙ্গেশাল, লাঠিশাল, মধুমালতি, তুলাইপাঞ্জিও স্বাদ ও পুষ্টিতে সেরা। অন্যান্য পুজোর জন্য নির্দিষ্ট ধান গোবিন্দভোগ, বাসন্তী, খাস। সকালের বা বিকেলের টিফিনের জন্য চাই মুড়ি। কিন্তু যে-সে ধানে মুখরোচক মুড়ি হয় না, তার জন্য চাষির জমিতে দেখা যেত রঘুশাল, লালঝুল, কলমা, চন্দ্রকান্ত, কেলেপাখনা, হিজুলী, বেনাজুপি, বউপাগল, মানিক মুদো, লক্ষ্মী জটা প্রভৃতি। অল্প চালে পেট ভর্তির জন্য বাঁকুড়ার ভূতমুড়ি ছিল উল্লেখযোগ্য। বাঁকুড়ারই আশ্চর্য আর এক ধান সতীন।

একটি বড় চালের পাশে দুটি চাল। সতীনের মতনই আরেকটি ধান যুগল বা রাধাকৃষ্ণ। একটি খোসার মধ্যে দুটি চাল। গরম ফ্যান ভাতের জন্য ঘোড়াশাল, কই ঝুড়ি, ক্লেশ। অবশ্য এগুলি নবান্নের অনেক আগেই উঠে যেত। দীর্ঘ অসুস্থতার পর রোগীর পাতে পড়ত কবিরাজ চালের ভাত। আর শিশুর জন্য জুহা চালের ফ্যান। অপেক্ষাকৃত জলাজায়গায় জল জাবড়া, কামিনী লক্ষ্মী, দিঘল। আবার শুখা জায়গায় কালো মানিক, বিন্নিচুড়, সরু নাগরা। বলাবাহুল্য এসব জাতের ধানগুলি প্রত্যেক চাষি নিজনিজ সামর্থ, সুবিধা এবং ভাবনা অনুযায়ী চাষ করতেন এবং এগুলির অধিকাংশই নবান্নর পাতে ব্যবহৃত চাল। আর সেই সব পুষ্টিদায়ক সুস্বাদু নতুন চালের সঙ্গে খেজুর গুড়, পাক নারকেল এবং নানাবিধ ফল সহযোগে জল খাবার বা পুজোর প্রসাদ দুপুরে নতুন চালের সঙ্গে ভুরিভোজ। কিন্তু নবান্নের ভুরিভোজে সেই সব চাল নেই তার পরিবর্তে পেট মোটা হাজার ছত্রিশ, লাল স্বর্ণ। বাংলার এইসব পুষ্টিকর ধান একদা তৃতীয় বিশ্বের ধানপ্রধান অঞ্চলের খাদ্যসংকট মোচনের উদ্দেশ্যে ফিলিপিন্সের ম্যানিলা ইন্টারন্যাশনাল রাইট রিসার্চ ইনস্টিটিউশনে পাড়ি দেয়। যেখানে এখনো মজুদ আছে বাংলার কয়েক হাজার হারিয়ে যাওয়া প্রজাতি। আশার কথা এইসব পুরনো ধানের চাষে ফুলিয়া বা চুঁচুড়া কৃষি খামারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু এনজিও এগিয়ে আসছেন। তা হলে নবান্নের পাতে এই সুগন্ধি চাল কি ফিরে আসছে!

Advertisement