অধীশ মিশ্র
Advertisement
রকি চিলচিৎকার করে বাড়ি মাথায় করছে। তুলি ঘড়ির দিকে একবার চকিতে তাকিয়ে দেখলো সময়টা সেই একই। তার মানে সে এসেছে। এই সময় আজ নিয়ে পরপর সাত দিন দিদাটা আসছে ওদের বাড়ি। কিছু চায় না, শুধু দরজায় হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। মলিন চেহারা, ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ি-জামা গায়ে মানুষটা কেমন যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে মনে হয়। রকি পুঁচকে পমেরেনিয়ান, সাহস নেই, শুধু গলার জোরে ভূত পালায়। খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে আস্ফালন করে। তেড়েও যায় না, কামড়েও দেয় না। দিদা ভয় পায় না। তুলির মনে হয় দিদা ভয় পেতে ভুলে গেছে।
Advertisement
বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। তুলির স্কুলে এখন সামার ভেকেশন চলছে, তাই ও বাড়ি আছে। তাই বলে জেঠু, বাবাদের কি ছুটি? সবাই কাজে বাইরে। এই সময় বাড়িতে শুধু মহিলা আর বাচ্চারা। মহিলারাও সারাদিন এত ব্যস্ত যে, দিদা দাঁড়িয়েই থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে, শেষকালে ক্লান্ত হয়ে দোরগোড়ায় বসে পড়ে, তখন হয়ত কেউ এসে দুটো খাবার আর পয়সা দিয়ে যায়। সে আর কতই বা। তবু দিদা ওতেই খুশি। খেয়ে, পয়সা নিয়ে নমস্কার করে চলে যায়। আবার পরদিন চলে আসে।
তুলি রকির সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখে। দিদা মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। ফোকলা মুখের হাসিটা খুব মিষ্টি। তুলি শুধু ভাবে, এটুকু খাবারে দিদার পেট ভরলে হয়। দিদার কিন্তু ভরে, পুরোটা খায়ও না। পাশে দাঁড়ানো নেড়িটাকে উচ্ছিষ্ট দিয়ে এঁটো হাত মাথায় ঠেকিয়ে গুটিগুটি পায়ে চলে যায়। তুলি অবাক হয় মানুষটাকে দেখে। পরশু দিদা ওকে হাত নেড়ে কাছে ডাকলো। রকি তারস্বরে প্রতিবাদ করল, যেন বারণ করছে তুলিকে যেতে, ও তো ছেলেধরা হতে পারে, কী দরকার যাবার। তুলি কিন্তু কাছে গেল। দিদা শুধু ওর থেকে একটু নুন চাইল, খাবারে নাকি নুন একটু কম হয়েছে। ওকে দিদা পুতুল বলে ডাকল। গেল বছর তুলির ঠাকুমা ঠাকুর হয়ে গেল। ঠাকুমা ওকে পুতুল বলে ডাকত। এই দিদা পুতুল বলে ডাকতে তুলি চমকে গেল। আবার ভালোও লাগল খুব। কাছের কেউ তো আর ও নামে ডাকে না, ভালোই তো যদি অচেনা কেউ এভাবে আপন হয়।
তুলি ঠিক করে রেখেছিল দিদার সঙ্গে কথা বলবে, জানতে চাইবে দিদা কে, কোথায় বাড়ি, বাড়িতে কে কে আছে, এরকম ভিক্ষা করে কেন, এইসব। মুখটা বড্ড মিষ্টি দিদার, দেখলে মায়া করে। আজ রকি চ্যাঁচানো শুরু করতেই তুলি ছুটে দরজার কাছে চলে এলো। জানে অন্যদের আসতে সময় লাগবে। সেই ফাঁকে দিদার সঙ্গে দুটো কথা বলবে। দিদা সেই একইভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, পাশে সেই চেনা নেড়িটা। তুলি সোজা এগিয়ে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার রকি কোনো প্রতিবাদ করল না।
‘তুমি রোজ এখানে আসো কেন গো? অন্য বাড়ি যাও না তো!’
দিদা বোধহয় কষ্ট পেল। মুখটা করুণ করে ওর দিকে চেয়ে রইল। তারপর চলে যেতে পা বাড়াতেই তুলি ডেকে উঠল, ‘ও দিদা, চলে যেও না। আমি এমনি বলছি। তুমি আসবে, এখানেই আসবে রোজ। আজ মাংস হয়েছে। দাঁড়াও আমি এনে দিচ্ছি। আজ কিন্তু সবটা ভাত তুমি খাবে। নেড়িকে আমি আলাদা দেব।’
দিদা কী খুশি, ফোকলা মুখে সে কী হাসি! হাতের ইশারায় তুলিকে আরও কাছে ডাকল। ওর মাথায় হাত রেখে কী সব বিড়বিড় করে বলল। বোধহয় মন খুলে আশীর্বাদ করল। তুলি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি ভিক্ষে কর কেন দিদা? তোমার কেউ নেই? বাড়ি নেই?’
দিদা চুপ করে রইল। তারপর সঙ্গের ময়লা পুঁটুলি থেকে একটা মলিন ছবি বার করে দেখাল তুলিকে। একটা ভীষণ সুন্দর দেখতে ঘোমটা দেওয়া বউ সঙ্গে একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিদা ঘষে যাওয়া গলায় বলল, ‘আমার পোলা, রতন, তখন উর সাত বছর বয়েস।’
‘তোমাকে দেখে না?’
‘দেখবে ক্যামনে রে পুতুল, ও নাই যে। সেই কবে গাঁয়ে মড়ক লাইগল। উর বাপটা মইরল, উ নিজে মইরল, আর আমার কপাল ফাইটল। মইরলাম না শুধু। গাঁ ছাড়ে দিলাম। সেই থেকে এই এত্ত বড় গঞ্জে পইড়ে থাকি, খাবার জোটে না, তবু পইড়ে থাকি। যদ্দিন এই প্রাণ ধুকপুক করে, পইড়ে থাকব। আর যাব কুথায় রে পুতুল।’
তুলির খুব কষ্ট হচ্ছিল দিদার কথা শুনে।
‘তুমি আমাকে পুতুল বলে ডাকো কেন?
দিদা মাথা নিচু করে বলল, ‘ওই রতনের একটা বুন হইয়েছিল। আমার বেটি। থাইক্ল না। জন্মের সাত দিন পর চইলে গেল। ওর নাম রেইখেছিলাম পুতুল। মনে লাগে, তুই আমার সেই পুতুল। তাই ডাকি।’
সেদিন তুলি আর কথা বলতে পারেনি দিদার সঙ্গে। দিদা খেয়ে চলে গিয়েছিল, যেরকম রোজ যায়। হ্যাঁ, তুলি দিদাকে মাংস দিয়েছিল। দিদা পরদিন আর আসেনি। আর কোনোদিনই আসেনি। ফুটপাথে নাকি মরে পড়েছিল, কর্পোরেশনের গাড়ি এসে মর্গে চালান করে দেয়, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। তুলিকে আর সেদিনের পর কেউ পুতুল বলে ডাকেনি।
Advertisement



