বিশ্ব বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) তুলে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় মোদী মন্ত্রীসভা। সংসদে পেশ করা হবে ‘বিকশিত ভারত শিক্ষা অধিক্ষণ বিল’। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় এছাড়াও একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা অধিক্ষণ বিল ছাড়াও বিমা ক্ষেত্রে একশো শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প বা এমজিএনআরইজি বদলে এখন থেকে ‘পূজ্য বাপু গ্রামীণ রোজগার যোজনা’ নাম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের পথও খুলে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রীসভার বৈঠকে স্থির হয়েছে ২০২৭ সালের জনগণনার জন্য ১১,৭১৮ কোটি টাকা বরাদ্ধের বিষয়েও।
সপ্তাহ দু’য়েক আগে শীতকালীন অধিবেশনের সংসদীয় বুলেটিনেই শিক্ষা অধিক্ষণ বিলের উল্লেখ করা হয়। এই বিল পাশ হলে ইউজিসি, সারা ভারত কারিগরী শিক্ষা কাউন্সিল (এআইসিটিই) ও জাতীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ কাউন্সিল (এনসিটিই) তুলে দেওয়া হবে। তার বদলে ‘ভারতের উচ্চশিক্ষা কমিশন’ (এইচইসিআই) নামে এক নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে।
Advertisement
বিলের বিশেষ প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এইচইসিআই সর্বভারতীয় স্তরে উচ্চশিক্ষার একেমাত্র নিয়ামক সংস্থা হিসাবে কাজ করবে। তবে মেডিকেল ও আইন কলেজগুলিকে এর আওতার বাইরে রাখা হবে। লোকসভার বুলেটিন অনুযায়ী, এই কমিশনের মূলত তিনটি প্রধান ভূমিকা থাকবে। এগুলি হল: নিয়ন্ত্রণ, স্বীকৃতি প্রদান (অ্যাক্রিডিটেশন) এবং পেশাগত মান নির্ধারণ। তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ বরাদ্দ নির্ধারণ করার কোনও অধিকার এইচইসিআরআই-এর থাকবে না। অর্থ বরাদ্ধের দায়িত্ব পাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক। অর্থায়ণের একচেটিয়া অধিকার কেন্দ্রীয় সরকার পেলে, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধিকার কমবে এবং শিক্ষার কেন্দ্রীয়করণ বাড়বে। এমনই অভিযোগ করেছেন বিরোধীদের বড় অংশ।
Advertisement
আলোচনা ছাড়াই উচ্চশিক্ষা কমিশন সংক্রান্ত বিল সংসদে পেশ করার বিরুদ্ধে মোদী সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানকে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি লেখেন সিপিআইএম সাংসদ জনব্রিটাস। ওয়াকিবহাল মহলের পরামর্শ না নিয়ে কিংবা যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) তৈরি না করে সংসদে এই বিল পেশ করার বিরুদ্ধে বিরোধীরা সরব হন। সাধারণ মানুষের সমক্ষে বিলের খসড়া প্রকাশ না করে, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা রাজ্য সরকারকে আলোচনার কোনও পরিসর না দিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার এমন আমূল পুনর্গঠন করা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীকে এসব প্রশ্ন লিখে পাঠিয়েছেন সিপিআইএম সাংসদ।
তবে মোদী সরকার ব্রিটাসের আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছে। অগণতান্ত্রিক আচরণের ধারবাহিকতা বজায় রেখে এই নতুন বিল সংসদের উভয় কক্ষে পেশ করার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা।
ইউজিসি, এআইসিটিই এবং এনসিটিই সংক্রান্ত আইন বাতিলের কথা বলছে এই বিল। এই তিন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব একটি কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থাকে দেওয়ার স্বাধিকার, বৌদ্ধিক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তার পরিসর এবং সংবিধান প্রদত্ত কেন্দ্র-রাজ্য ভারসাম্য ধ্বংস হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রীয়করণ এবং অর্থ বরাদ্দে একচেটিয়া প্রশাসনিক দখলে শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব বাড়বে।
নতুন উচ্চশিক্ষা কমিশনের সদস্য হবেন কেন্দ্রীয় সরকারের আমলারা। শিক্ষাবিদও সমাজের প্রান্তিক অংশের সেখানে কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। এর ফলে বৌদ্ধিক মান ও উৎকর্ষের মান নিম্নমুখী হবে এবং শিক্ষা প্রসারে বাধা তৈরি হবে। এছাড়াও নতুন কমিশনকে ‘অ্যাক্রেডিটেশন’ দেওয়া এবং কেড়ে নেওয়ার একচেটিয়া অধিকার দেওয়ায় রাষ্ট্রীয় নজরদারি, শিক্ষার খরচে বৃদ্ধি, অস্থিতিশীলতা, বেসরকারিকরণ এবং উচ্চশিক্ষায় বৈষম্য বাড়বে। ২০২০-র জাতীয় শিক্ষা নীতির ধাক্কায় গোটা দেশের শিক্ষাক্ষেত্র এমনিতেই নানা ধরনের সঙ্কট ও অব্যবস্থায় ধুঁকছে। যার ওপর এই নতুন সংস্কারে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে, চলতি সঙ্কট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিরোধীরা।
ইউজিসি তুলে দিতে এই ধরনের বিলের পরিকল্পনা নতুন নয়। ২০১৮ সালে বারতের উচ্চশিক্ষা কমিশন (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বাতিল) বিল, ২০১৮’ নামে একটি খসড়া বিল আনা হয়।
বিরোধীদের বক্তব্য, ২০১৮ সালের খসড়া বিল আনা হয়। বিরোধীদের বক্তব্য, ২০১৮ সালের খসড়া বিলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বর্তমান ত্রুটিগুলি সংশোধন না করে তা বিলুপ্তি করার প্রস্তাব দেওয়া উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এতে শিক্ষার কেন্দ্রীয়করণের পাশাপাশি, আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীকার এবং দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। প্রান্তিক অংশর মানুষ ও রাজ্যস্তরের প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি আমলা এবং কর্পোরেট প্রভুদের হাতে অত্যাধিক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অনুদান বন্টনের মাধ্যম থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যার ফলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে।
Advertisement



