মহম্মদ শাহাবুদ্দিন
শিক্ষকতা শব্দের মধ্যে এক সম্মানিত ব্যক্তিত্বের ছবি ফুটে ওঠে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভালবাসা, সুগভীর নৈতিকতাবোধ। শিক্ষকতা সমাজের এক উঁচুস্তরের পেশা। এক একটা যুগে সেই প্রজন্মের মানসিক আশ্রয় হয়ে ওঠেন শিক্ষক। মায়ের স্নেহের আঁচল আর বাবার শক্ত মুঠির নিরাপত্তা ছেড়ে শিশু প্রথম যেখানে উপনীত হয় তা হল শিক্ষাঙ্গন। মনে করুন পথের পাঁচালীর অপুর কথা। প্রসন্ন গুরু মহাশয়ের হাতে বেত, তীব্র সতর্ক চোখ আর শ্রুতি লিখনের বিচিত্র বাক্য বিন্যাস অপুকে যেমন ভীত সন্ত্রস্ত করেছিল তেমনিই তাকে নতুন জগতের দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। অর্থ না বুঝেই অপু শুনছিল-“এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবনগিরি…”। পাঠশালা থেকে বিদ্যালয় সেখান থেকে মহাবিদ্যালয়ের বৃত্তের জগৎ। ছাত্ররা প্রথাগত পাঠ যেমন গ্রহন করে শিক্ষকের কাছে তেমনিই বহু অজানা না বোঝার শূণ্যতাকে পূরণ করে অভিভাবক এবং গৃহশিক্ষকদের সহায়তায়। গৃহশিক্ষক কথাটির সঙ্গে শিক্ষাদান এবং গৃহাঙ্গন দুটোই যুক্ত। বিদ্যালয়ের বহু ছাত্ররা নিজের কথা অনেক সময় বলে উঠতে পারে না। গৃহশিক্ষক সেই অকথিত আবেদন এবং অনুভুতিটাকে একান্ত সাহচর্যে সযত্নে প্রকাশ কারতে সাহয্য করেন। যুগযুগ ধরে গৃহশিক্ষকতার প্রথা প্রচলিত। একদা ছিল তা বড়ই সম্মানের। সময়ান্তরে সম্পর্কটা দেওয়া নেওয়ার পর্যবসিত হয়েছে।
Advertisement
সুপ্রাচীন কালেও ছিল গৃহশিক্ষতা। আমরা গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের কথা জানি। পিতা ফিলিপ আলেকজান্ডারের ১৩বছর বয়সে তাঁর জন্য গৃহশিক্ষক নিয়োগ করে দেন দার্শনিক এ্যারিস্টটলকে। ইতিহাসে রাজপরিবারে গৃহশিক্ষকদের ভূমিকার কথা পাই। ইতিহাসের অতো পিছনে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের দেশে এককালে সামন্তযুগে জমিদার বাড়ীতে গৃহশিক্ষকরা বসত করেই থাকতেন। কিছু সম্পত্তিও তাদের নামে লিখে দেওয়া হত। সপরিবারে সেটাই ছিল তাদের স্থায়ী ঠিকানা। এরপর ঊনিশ শতকে তখন নতুন শিক্ষার জোয়ার। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ীর জ্যোতিষ্করা সবাই গৃহশিক্ষকের আলোয় আলোকিত হয়েছিলেন। বিশ শতক থেকেই আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটল। গ্রাম শহরের মধ্যবিত্তের ছেলে মেয়েরা এলো পড়ুয়া হয়ে। সাধারন বাড়ীতে গৃহশিক্ষকতার শুরুও তখন থেকে।
Advertisement
গৃহশিক্ষকতা মধ্যবিত্ত তরুন প্রজন্মের জীবন যুদ্ধের মতো। নবীন বয়সে আস্থাহীন সময়ের একটা অবলম্বনের মতো। এখানে চাকুরীজীবী গৃহশিক্ষকদের কথা বাদ থাক। লেখাপড়া জানা বেকার যুবক নিজের জীবনকে গড়ে তোলার বয়সেই অন্যের জীবনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে নিত। এক সময় গ্রাম থেকে আসা মেধাবী ছাত্ররা খুঁজে নিত মেস বাড়ী। পড়াশোনার ফাঁকে অবসর সময় কাটাতো গৃহশিক্ষকতা করে। শহরের কলেজ পড়া ছেলে মেয়েরাও রোজগারের আশায় নিজেকে টিউশনির সঙ্গে জুড়ে দিত। সামান্য কটা টাকায় নিজের প্রয়োজন মেটাতে, শখ মেটাতে দু একটা থিয়েটার সিনেমা দেখতেই খরচ হয়ে যেত।
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থাকে আমাদের ভুললে চলবে না। পরিবর্তিত অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছিল যৌথ পরিবার। এইসব পরিবারের নিরাপদ ঘেরাটোপ ছিঁড়ে যখন মধ্যবিত্তের একক জীবনযাপন শুরু হয়েছিল তখন থেকেই বাড়তি রোজগারের চাপ বাড়ির কর্তার কাঁধ থেকে উঠতি কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের ওপর এসে পড়ে ছিল। কারণ যৌথ পরিবারে বাবা কাকা জ্যাঠা দাদু সকলের সম্মিলিত ভাবে আয় সংসারে লাগিয়ে দেওয়া হত ফলে অর্থনৈতিকভাবে সামান্য দূর্বল পিতাও কোন বিষয় চাপ অনুভব করতেন না। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছেলে মেয়েদের কাঁধেও একক ভাবে ব্যয় ভার চেপে বসল। তখন থেকেই নানা ধরনের রোজগারের পথ খোঁজার শুরু, এর অন্যতম ছিল প্রাইভেট টিউশনি।
সারাদিনের নিত্য ধারাপাতের খাতায় ক্লান্ত চোখের শ্রান্ত সঞ্চালন। তরুন তাজা প্রাণের আস্তিত্বের লড়াই। অর্থনৈতিক ভাঙাগড়ায় নানান বিপর্যয়ের মধ্যে দেশের যুব সমাজের সামনে অতল অন্ধকার নামিয়ে আনছিল। সেই অন্ধকারেও আত্মদীপের আলোয় পথ চলতে শুরু করেছিল প্রাইভেট টিউশনি করে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা ছেলে মেয়েরা। সমাজে তাদের তেমন শিরোপা মেলেনি, আজও মেলেনা। কিন্তু এরাই শ্রেণীকক্ষের অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একটু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা শিক্ষার্থীর খামতি পূরণ করে সামান্য অর্থের বিনিময়ে। এদের কাছে টিউশনি জীবন ধারণের লড়াই। অনেক বঞ্চনার মধ্যেও নিজের প্রত্যয়ে টিকে থাকা। এই টিকে থাকা আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য। বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিবর্তনের তরঙ্গমুখর রাষ্ট্রের এরাই অর্থ-সামর্থের লড়াইয়ের ক্লান্ত যোদ্ধা। তাদের সমস্ত মানসিক উৎকর্ষকে ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করে নিজের কাছে নিজেকেই প্রমাণ করে চলেছে। গৃহশিক্ষকতার চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বড়ই জটিল। কেউ অঙ্কের গৃহশিক্ষক চান কিন্তু সঙ্গে রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যার পারঙ্গমতাও আশা করেন। ফলে মধ্য মেধার শিক্ষক সেই চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। তখন আসে অনিরাপত্তার ভাবনা। এই অনিরাপত্তার ভাবনা নিয়েই গৃহশিক্ষকের বিকেল থেকে সন্ধ্যা গড়ানো সময় কাটে। গোধূলির আলো আর সন্ধ্যা দীপের স্নিগ্ধতা তাদের জন্য নয়। তখন ওরা ছোটে এক বাড়ির শিক্ষকতা সেরে অন্য বাড়ির অপেক্ষমান ছাত্র ও অভিভাবকের সামনে সঠিক সময় পৌঁছবার জন্য। এখানেই শেষ নয়। স্কুল বিশেষে, পড়ানোতেও বৈশিষ্ট্য যোগ করার দায় থাকে। স্কুলের পাঠের বিষয় সংক্রান্ত অতিরিক্ত তথ্য জানানোর প্রচেষ্টা রাখতেই হয়। কারণ শিক্ষিত সচেতন অভিভাবকদের এটাও চাহিদা। সন্তান সেই জ্ঞান ধারন করতে পারবে কিনা সেটা বিচার্য হয় না। লক্ষ্য হয় শিক্ষকের জ্ঞান পরিবেশনের দক্ষতা। দক্ষতা এবং পারদর্শীতার তুলা দন্ডে মাপা হয় গৃহশিক্ষকের পারিশ্রমিক। এই পারিশ্রমিকও কিন্তু সব সময় মাসের প্রথমে আসে না। কখনো কখনো মাস গড়িয়ে যায়। গৃহশিক্ষক নিজের শ্রম, ইনটালেক্ট, স্মৃতি ও শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলেন ছাত্রকে। তাঁর শ্রমের মর্যাদা টুকু পান কতটুকু। এই যন্ত্রনা সবাই বোঝে না। যাদের জীবনে এটা ঘটে তারাই বোঝে।
বর্তমান সময়ে একটা ফ্যাশন হয়েছে সব বিষয়ে গৃহশিক্ষক রাখা। ছাত্রকে সব শিক্ষকের পড়ানোর মেথড, নানান নির্দেশ, হোম ওয়ার্ক সব কিছু এক সাথে গিলে খেতে হয়। এই গলাদ্ধকরন একটা বড় সমস্যা। একদিকে অভিভাবক চাইছেন সব বিষয়ে তার সন্তান যেন নব্বইয়ের ঘর টপকায়।
ছেলেমেয়ে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হল কিনা সে নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর আয়ত্ত করার সফলতাই তাদের শিক্ষার মাপকাঠি। আর গৃহশিক্ষকের দর পত্রটিও নির্ভর করে ছাত্রের নম্বরের ওপর। পঠন পাঠনের সমীকরণে বিচিত্র সম্পর্ক এখন। এইভাবে বুনো রামনাথেরা হারিয়ে যাচ্ছেন বিস্মৃতির আড়ালে। শিক্ষার্থীর সাফল্যে যখন সবাই খুশিতে মেতে ওঠেন তখন এইসব গৃহশিক্ষকরাও উজ্জ্বল চোখে নিজের প্রত্যয়ের আনন্দ উপভোগ করেন। কিন্তু এই উপভোগ তার একলার, সেখানে সফল শিক্ষার্থীর একটা প্রণাম ভিন্ন আর কিছুর প্রত্যাশা নেই। তাঁরা বর্তমান সময়ের পিলসুজ। প্রদীপের আলো ছড়িয়ে পড়ে সফলতার হাসিতে, পোড়া তেল গড়িয়ে পড়ে পিলসুজের গায়ে। এটাই নির্মম সত্য। ব্যতিক্রম নেই এমন নয়, তবে এটাই ঘটনার সার। সরকারী স্কুলগুলির এখন ভগ্নদশা। কোথাও শিক্ষক আছে ছাত্র কম আবার কোথাও ছাত্র আছে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র কয়েকজন। ফলে একজন শিক্ষককে অন্যান্য বিষয়েও পড়াতে হয়। বৰ্তমান সময়ে শিক্ষা এবং শিক্ষা পরিবেশ দুটিই প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষকের চাকরী কেনাবেচা, যোগ্য অযোগ্য শিক্ষক খুঁজে বের করা, এসব শিক্ষার মানকে নীচু তলায় নামিয়ে এনেছে। এক্ষেত্রে শাসকের ভূমিকাও সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এইসব নানান ঘাত প্রতিঘাত পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, শিক্ষার আদর্শগত রূপ ও সুষ্ঠু সমষ্টিগত চেতনাকে অবক্ষয়ের পথে ঠেলে দিচ্ছে। শিক্ষা এখন অনেক কিছুর মতো পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের বেসরকারী করণের যুগে প্রকাশ্যে তার কেনাবেচা চলছে। শিক্ষার অধঃপতন ক্রেতা বিক্রেতার মনে দাগ কাটে না। সবাই কেমন নির্বিকার। বিক্রেতারা অর্থভোগী। ক্রেতাদেরও কোন আনন্দ নেই। সমষ্টি ভাবনাই তো হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতা বা অভিভাবকের কাছে সন্তানের সাফল্যটাই বড়। কিন্তু গৃহশিক্ষক তো পণ্য বিক্রয় করেন না। তারা বিক্রয় করেন শ্রম আর মেধা। বিক্রয় করেন সেবা। তারা সঞ্চারিত করেন মূল্যবোধ। গৃহশিক্ষক শিক্ষার ফেরিওয়ালা নন। প্রতিটি কালে তারা মানুষ গড়ার নীরব কারিগর। তারা সমাজের যথার্থ সেবক। সেবা কাজের মধ্যে তাদের অর্থ রোজগার করতেই হয়। কারণ তাদেরও সংসার চালাতে হয়। তাদেরও ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটাতে হয়। তাদেরও ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে হয়।
Advertisement



