আবীরলাল
বাংলার তথাকথিত সভ্যসমাজে কান পাতলেই শুনতে পাবেন মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, এই জেলাগুলি একটা সুন্দর নাম উপহার হিসেবে পেয়েছে তা হলো রাজমিস্ত্রীর জেলা। দেশের যে কোনো বড় শহরের নির্মাণস্থলে হোক কিংবা মুম্বইয়ের রেস্তোরাঁয়, কলকাতার দর্জিপাড়ায় বা দিল্লির শহরতলিতে উঁকি মারলেই দেখতে পাবেন সেখানে কর্মরত বেশিরভাগ ছেলের বাড়ি মালদা, মুর্শিদাবাদ, কিংবা উত্তর বা দক্ষিণ দিনাজপুরে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলার অন্য জেলাগুলোতে কি দারিদ্র্য নেই? বেকারত্ব নেই? তবুও কেন এই তিন জেলা থেকেই সবচেয়ে বেশি যুবক ভিনরাজ্যে কাজ করতে যায়, আজ তারই উত্তর খুঁজতে চলেছি।
Advertisement
সর্বাগ্রে বলা যায়, এই অঞ্চলের মানুষের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল নদী-ভাঙন। প্রতি বর্ষায় পদ্মা ও গঙ্গার প্রচণ্ড স্রোত এই দুই তিন জেলার বুক চিরে এগোয়, গ্রাস করে হাজার হাজার বিঘা জমি। একদিনেই ভিটেমাটি-সহ সর্বস্ব হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো বাধ্য হয়ে তখন হয়ে ওঠেন অভ্যন্তরীণ পরিযায়ী শ্রমিক; অন্য রাজ্যের ইঁট কাঠ বালিতে জীবিকা খুঁজে পাওয়া শ্রমিকশ্রেণি।
Advertisement
আবার অঞ্চলটি সম্পূর্ণভাবে শিল্পহীন। মুর্শিদাবাদ একসময় রেশমশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল, কিন্তু সরকারি অবহেলায় সেই ঐতিহ্য আজ প্রায় মৃতপ্রায়। মালদাতে আমের ব্যাপক উৎপাদন হয় ঠিকই, কিন্তু তা কৃষিভিত্তিক আয় ছাড়া আর কোনও শিল্প তৈরি করতে পারেনি। উত্তর দিনাজপুরে কোনও ভারী শিল্প নেই, নেই বড় কারখানা, নেই বাণিজ্যিক দিক থেকে প্রসারিত অবকাঠামো। যে কয়েকটি চা বাগান আছে, সেখানকার মজুরি এত কম যে সেই আয়ের উপর নির্ভর করে একটা সম্পূর্ণ পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই যুবকদের সামনে বিকল্প থাকে মাত্র দুইটি, চাষাবাদ করা অথবা পরিযায়ী শ্রমিক হওয়া। আর চাষ করার মতো জমিও যেহেতু সীমিত এবং চাষাবাদে মুনাফা যেহেতু কম, তাই পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন বরণ করে নেওয়াই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়।
আবার জেলাগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে বিড়িশিল্প। বহু গৃহবধূ ঘরে বসে বিড়ি বাঁধার কাজ করেন, কিন্তু এক হাজার বিঁড়ি বেঁধে ১৫০-২০০ টাকা আয় করে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়ে। মহিলারা যেহেতু এই অতি কম আয়ের কাজের মধ্যে আবদ্ধ, থাকেন,তাই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বাধ্য হয়েই বাইরে গিয়ে বেশি আয় করতে হয়। আবার বাংলায় একজন রাজমিস্ত্রি বা হেল্পার যেভাবে দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করেন, সেই একই কাজ কেরালায় করলে মেলে ৮০০-১০০০ টাকা মজুরি। অর্থাৎ একই পরিশ্রমে দ্বিগুণ আয় লাভ করা যায়। ফলে শ্রমিকেরা বুঝতেই পারেন ছয় মাস বাইরে কাজ করলে যে টাকা হাতে জমবে, তা বাংলায় পুরো বছরেও সেই আয় সম্ভব হবে না। আবার একবার কেউ বাইরে পাড়ি দিলে সে এরপর নিজের গ্রামের তিন চারজনকে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় চেইন মাইগ্রেশন, যা বর্তমানে এই জেলাগুলোর সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। আবার কিশোরদের স্কুল ড্রপ আউট হওয়া জেলাগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। দারিদ্র্যের তাড়নায় বহু মুসলিম কিশোর ক্লাস ৮ বা ৯-এর পরেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। এই ছেলেরা অদক্ষ শ্রমিক হিসেবেই বড় শহরগুলোতে গিয়ে কাজ খুঁজে নেয়, কেউ নির্মাণশ্রমিক, কেউ দর্জি, কেউ রান্নার হেল্পার হিসেবে। শিক্ষার অভাব কর্মজীবনে বিকল্পের পথ বন্ধ করে দেয়।
সমস্যার মূলে আছে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক উদাসীনতা। বাম আমলে হোক বা তৃণমূল আমলে সরকাররা এই জেলাগুলোর উন্নয়নের বিষয়ে খুব বেশি ভাবেনি, তারা এগুলোকে দেখেছে ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে। নেতারা দিয়েছেন রেশন, কিছু ভাতা, ক্লাবগুলোকে খুশি করার জন্য বার্ষিক অনুদান, কিন্তু শিল্প, দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি, কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে বার করে দেওয়ার কথা তাঁরা ভাবেননি। ফলে এই জেলাগুলো যেন এক ধরনের উপেক্ষিত অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কিছু সংস্কার, প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা হলে এই উপেক্ষিত অঞ্চলই হয়ে উঠবে বাংলার সমৃদ্ধির পীঠস্থান। সেই বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি। প্রথমত, এগ্রো প্রসেসিং বা কৃষিজাত দ্রব্যের প্রক্রিয়াকরণ শিল্প নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। মালদার কালিয়াচক, ইংরেজবাজার, চাঁচল এবং গাজোলের আমবাগানগুলো থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টন আম উৎপাদিত হয়। কিন্তু ভ্যালু অ্যাডিশনের অভাবে তার বেশিরভাগই নষ্ট হয় বা অতি কম দামে বিক্রি হয়। অথচ এই অঞ্চলে যদি ম্যাঙ্গো পাল্প প্রসেসিং ইউনিট, আমসত্ত্ব, জেলি, জ্যাম তৈরির পরিকাঠামো তৈরি করা যায়,তাহলে মালদার আম আরো বেশি পরিমাণে ব্র্যান্ডেড পণ্য হিসেবে দেশ বিদেশে রপ্তানি হতে পারে। অন্যদিকে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, ইটাহার ও কালিয়াগঞ্জ ভুট্টার নতুন বেল্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এখান থেকে কাঁচা ভুট্টা বহিরাজ্যে রপ্তানি করা হয়, অথচ স্থানীয়ভাবে কর্নফ্লেক্স, স্টার্চ, কর্নঅয়েল বা পোলট্রি ফিড তৈরি হলে রায়গঞ্জ শিল্পাঞ্চল বা ইসলামপুরের পাশে বিশাল কারখানা তৈরি যেতে পারে। মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ, জলঙ্গি, বেলডাঙা, লালগোলা, ভরতপুর অঞ্চলে পাট, চিনি, সবজি,এসবের উপর ভিত্তি করে আধুনিক ইউনিট গড়ে তোলা গেলে দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক ফাইবার হাব হয়ে উঠতে পারে মুর্শিদাবাদ জেলা। দ্বিতীয়ত, টেক্সটাইল ও রেডিমেড গার্মেন্টস নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। মুর্শিদাবাদের ডোমকল বা জলঙ্গি, মালদার কালিয়াচক কিংবা বৈষ্ণবনগর, এই এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যেই হাজার হাজার মুসলিম যুবক দর্জির কাজে অভ্যস্ত। কিন্তু কাজ খুঁজে তাঁরা মুম্বই, কেরালা, গুজরাত চলে যান। একই দক্ষতা যদি ডোমকল জলঙ্গি এলাকায় গার্মেন্টস ভিলেজ আকারে গড়ে ওঠে, এবং মালদার বৈষ্ণবনগর বা চাঁচলে টেক্সটাইল পার্ক তৈরি হয়, তবে হাজার হাজার পরিবারের জীবন বদলে যাবে। সরকার যদি সুলভ বিদ্যুৎ, ছোট লোন এবং সহজ লাইসেন্স ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে এখান থেকে জিন্স, শার্ট, বাচ্চাদের পোশাক সরাসরি বাংলাদেশ, আসাম, বিহার বা ঝাড়খণ্ডে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, রেশম বা সেরিকালচার। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর, খাগড়া, জলঙ্গি, রঘুনাথগঞ্জ অঞ্চল একসময় বাংলার সিল্ক রাজধানী হিসেবে পরিগণিত ছিল। এখনও মালদার সুজাপুর, বৈষ্ণবনগর ও কালিয়াচকেও প্রচুর তাঁতি পরিবার রয়েছে। এখন বালুচরি, তসর ও মুর্শিদাবাদী সিল্ক চাইনিজ সিল্কের চাপে কোণঠাসা। আধুনিক পাওয়ার লুম, সুতোকাটা যন্ত্র, ডিজাইন স্কুল এবং একটি বড় সিল্ক পার্ক যদি রঘুনাথগঞ্জ বহরমপুর করিডরে তৈরি করা হয়,তাহলে আবারও এই শিল্পের রমরমা শুরু করা যাবে। তার সঙ্গে গ্লোবাল মার্কেট প্লেসে ব্র্যান্ডিং করলে মুর্শিদাবাদ সিল্ক বা মালদা সিল্ক আবার আন্তর্জাতিক পরিচিতি ফিরে পেতে পারে। চতুর্থত, কোল্ড স্টোরেজ ও লজিস্টিক হাব নিয়ে ভাবা যেতে পারে। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর, কালিয়াগঞ্জ, রায়গঞ্জ হলো ভারতের চিকেনস নেক যা উত্তর পূর্ব ভারতে ঢোকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। এই অঞ্চলে বড় বড় গুদাম, মালবাহী কেন্দ্র, কোল্ড স্টোরেজ এবং ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক তৈরি হলে ই কমার্স কোম্পানি অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট এখানেই তাদের হাব স্থাপন করতে পারে। এতে স্থানীয় হাজার হাজার যুবকের ড্রাইভিং, ডেলিভারি, লোডিং আনলোডিং এবং ওয়্যারহাউস ম্যানেজমেন্টে চাকরি তৈরি হবে। পাশাপাশি কৃষিপণ্য নষ্ট হওয়ার হারও বহুলাংশে কমবে। পঞ্চমত, পর্যটন শিল্প। মুর্শিদাবাদ বাঙালির ইতিহাসের পীঠস্থান। হাজারদুয়ারি, কাটরা মসজিদ, মতিঝিল, নিমতলা, নশিপুর রাজবাড়ি সবই মার্কেটিংয়ের অভাবে বিশ্বমানের পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। বহরমপুর হাজারদুয়ারি, মতিঝিল, কাশিমবাজার, খাগড়া এই পুরো বেল্টকে যদি রাজস্থানের উদয়পুর বা জয়পুরের ধাঁচে হেরিটেজ সার্কিট হিসেবে সাজানো হয়, ভালো হোটেল, ক্যাফে, বোটিং, গাইডিং কোর্স দেওয়া হয়, তাহলে একাই এই শিল্প মুর্শিদাবাদের অর্থনীতিকে অন্য রূপ দিতে পারে। শেষে আসে শ্রমনিবিড় হালকা শিল্প প্লাস্টিক মোল্ডিং, প্যাকেজিং, কৃষিযন্ত্রের ছোটখাটো পার্টস,এসব শিল্প সহজেই বসবে চাঁচল, সুজাপুর, রতুয়া, জলঙ্গি, লালগোলা বা রায়গঞ্জ শিল্পঅঞ্চলের আশেপাশে।
এখানে অতিরিক্ত জমির প্রয়োজন কম, বিনিয়োগও কম, কিন্তু চাকরি তৈরি হবে প্রচুর। কিন্তু কেন এসব এখনও হচ্ছে না? তার কারণও স্পষ্ট, সিঙ্গুরের পর জমি অধিগ্রহণ রাজনৈতিক ট্যাবু হয়ে গেছে; বিদ্যুৎ ও রাস্তার দুর্বল পরিকাঠামো শিল্পের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে, আর সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। বহু নেতা মনে করেন, মানুষ যদি স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন তাহলে ভাতা নির্ভর ভোটব্যাঙ্ক কমে যেতে পারে, এই ভয় নীতিনির্ধারণে বিপদ ডেকে আনে। অথচ বাস্তব সত্য হলো: মালদা, মুর্শিদাবাদ ও দিনাজপুর যদি শ্রমিক রপ্তানিকারক জেলার বদলে উৎপাদনের জেলা হয়ে ওঠে, তবে পুরো উত্তরবঙ্গের অর্থনীতিই পাল্টে যাবে, অভিবাসন কমবে, মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়বে এবং বাংলা আবার শিল্পে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সমাধানগুলো তো সামনে স্পষ্ট, দরকার শুধু বাস্তবায়নের সাহস; এটাই আজকের মূল প্রশ্ন।
Advertisement



