আগেই উধাও হয়েছিল মোঘল যুগের কথা। অষ্টম শ্রেণির ‘সমাজ বিজ্ঞান’ পাঠ্য পুস্তকে এবার দক্ষিণ ভারত উধাও। ইতিহাসবিদদের বড় অংশের অভিযোগ, এনসিআরটি-র অষ্টম শ্রেণির এই নতুন পাঠ্যবই ইতিহাস বিকৃতিতে নজির গড়েছে। দেশের ইতিহাস চেতনায় দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করাই এই বই ও তার লেখকদের মূল উদ্দেশ্য। ভারতের ইতিহাসের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এতে বাদ দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস কার্যত মুছে ফেলা হয়েছে। সেখানকার বিভিন্ন রাজবংশ, সামাজিক আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক বিন্যাসের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে। কিংবা তার উল্লেখ থাকলেও একেবারে সীমিত। দক্ষিণের আঞ্চলিকতা ভেঙে উত্তর ভারত বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের আধিপত্য কায়েম করতেই এমনটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের বড় অংশের। সঙ্ঘ পরিবারের ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তানের’ বুজরুকির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই যে এমনটা করা হয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
Advertisement
ইতিহাসবিদরা বলছেন, কয়েকটি অধ্যায় বাদ দেওয়া আঞ্চলিক পরিচিতি ও স্মৃতি মুছে দেওয়ার সমান। শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি অধ্যায় বাদ দিয়ে কিংবা অবহেলা করে স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে অতীত সম্পর্কে চেতনা বৃদ্ধির পথ আটকে দেওয়া হয়েছে। বইয়ের প্রথম ভাগের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দেওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রের বিবর্তন, মারাঠাদের উত্থান ও ঔপনিবেশিক শক্তির আগমন নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এক অসম্পূর্ণ ধারণা জন্মাবে। যেমন, দ্বিতীয় অধ্যায়ে মোঘল ও দিল্লির সুলতানি আমলের নামমাত্র উল্লেখ করেই তৃতীয় অধ্যায়ে মারাঠাদের উত্থান পড়ানো হয়েছে। মোঘল যুগ না পড়িয়ে মারাঠাদের বিষয়ে পড়ানো, বর্ণ পরিচয়ের আগেই বাক্য গঠন করতে বলার সমান।
Advertisement
চতুর্থ অধ্যায়ে ইউরোপীয়দের আগমন নিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১৪৫৩ সালে তুরস্কের ওসমানি শাসকেরা রেশম পথ বন্ধ করে দেওয়ার জেরেই যে সমুদ্রপথে পর্তুগীজরা ভারতে আসা শুরু করে, এ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ইতিহাসের কোনও ঘটনা বা পর্যায়ের কারণ বিশ্লেষণ না করেই সোজা ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এনসিআরটি-র নতুন বইয়ের লক্ষ্য হওয়া উচিত ইতিহাসকে শুধুই ঘটনা-নির্ভরভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে তুলে ধরা। বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা কিংবা চেতনা বৃদ্ধিতে কোনও জোর দেওয়া হয়নি।
এসবের মধ্যে দক্ষিণ ভারতকে সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা করা হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবজনক অধ্যায় হলো বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে। এতদিন ইতিহাসের বই থেকে মোঘল কিংবা দিল্লির সুলতানি আমল বাদ দিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের ইতিহাস লেখানোর দাবি করতেন, ‘বিদেশি মুসলিম দখলকারীদের বিষয়ে এত কিছু জানার প্রয়োজন নেই। তবে চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত বিজয়নগর সাম্রাজ্যের চার রাজবংশের কোনওটাই তো হিন্দুত্ববাদীদের ব্যাখ্যায় ‘বিদেশি দখলকারী’ কিংবা ‘মুসলিম’ নয়। তা সত্ত্বেও সঙ্ঘ পরিবারের আপত্তির কারণটা বোঝা মুশকিল।
এনসিআরটি-র পুরনো বইয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্য নিয়ে যা ছিল, তার দশ ভাগের নয় ভাগ বাদ দেওয়া হয়েছে। যেটুকু অংশ রাখা হয়েছে তার মধ্যেও অতি সরলীকরণ করা হয়েছে। এই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শাসক যে ভিন্ন রাজবংশের এবং ভিন্ন সময়ের প্রতিনিধি তা পুরোপুরি মুছে ফেলা হয়েছে। এতে ইতিহাসের বিকৃত ভাষ্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছবে বলে ইতিহাসবিদদের আশঙ্কা।
প্রচীন ও প্রাক্-মধ্যযুগে দাক্ষিণাত্যের সাংস্কৃতিক মাধুর্য, বাণিজ্যিক উত্থান, স্থাপত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নজিরবিহীন সাফল্যের কথা লেখা ছিল এনসিআরটি-র পুরানো বইয়ে। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র-বিরোধী ভক্তি আন্দোলন, তামিল সহিত্য, সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিস্তার— এসব কিছু বর্তমান অষ্টম শ্রেণির বইয়ে অনুপস্থিত।
এনসিআরটি-র কর্তারা দাবি করছেন, দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস মোটেই আগাগোড়া বাদ দেওয়া হয়নি। কিছুটা অবশ্যই রাখা হয়েছে। তবে ইতিহাসবিদদের বড় অংশ মনে করেন, আগা মাথা বাদ দিয়ে কেবল নিয়মরক্ষার তাগিদে দক্ষিণ ভারতের কেবল ভাসা ভাসা উল্লেখ আরও বেশি সমস্যাজনক। এতে ইতিহাস চেতনায় দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়। এই বিপজ্জনক প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে শিক্ষক ও ইতিহাসবিদদের এগিয়ে আসতে হবে প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে। শিক্ষা ও ইতিহাস নিয়ে এই ছেলেখেলা এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন।
Advertisement



