দাম কমল ভারতীয় মুদ্রার। বুধবার সকালে ডলারের তুলনায় রূপি ৯০–এর গণ্ডি পেরিয়ে নয়া রেকর্ড স্পর্শ করল। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটিই রূপির গতি উল্লেখযোগ্যভাবে নিম্নমুখী। এই পতন আচমকা নয়— দেশীয় দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক টানাপোড়েন— তিনের মিলিত প্রভাবে রূপি কার্যত চাপে ভেঙে পড়েছে।
রূপির দুর্বলতার কেন্দ্রে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি
গত এপ্রিল থেকে অক্টোবরে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি পৌঁছেছে ১৯৬.৮২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বেশি। প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের এই ঘাটতি স্পষ্ট করে দিচ্ছে, আমদানি কত দ্রুত রপ্তানিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমদানিকারীরা বাধ্য হয়ে বিপুল পরিমাণ ডলার কিনছেন। ডলারের ওই অতিরিক্ত চাহিদাই রূপিকে আরও নিচে নামিয়ে দিয়েছে।
Advertisement
গত এক বছর ধরেই রপ্তানির বাজারে মন্দা ছিল। এর মাঝেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের হঠাৎ শুল্ক–ঘোষণা ভারতীয় রপ্তানির ওপর বড় ধাক্কা লাগে। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কেনার ‘শাস্তি’ হিসেবে প্রায় সব খাতে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গয়না–রত্ন, বস্ত্র, ওষুধ–রাসায়নিকসহ ভারতের প্রধান রপ্তানি খাতগুলোর ওপর পড়ে নতুন বাধা। এপ্রিল–অক্টোবর সময়ে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ০.৬ শতাংশে। অথচ সোনা–সহ কিছু আমদানি তীব্র হারে বেড়ে ঘাটতিকে আরও বাড়িয়েছে।
Advertisement
বিশ্ববাজারের বিপরীত হাওয়া — ডলারের শক্তি ও বিনিয়োগ প্রত্যাহার
মার্কিন অর্থনীতির জোরালো বৃদ্ধি এবং সুদের হার দীর্ঘদিন উঁচু রাখা— দুইয়ের জেরে ডলার ইতিমধ্যেই বিশ্ববাজারে শক্তিশালী। এশিয়ার বাজার থেকে মূলধন সরে গিয়ে মার্কিন বাজারেই জমা হচ্ছে। ফল—এফপিআই বা বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় শেয়ারবাজার থেকে এ বছরই তুলে নিয়েছেন ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
এরই সঙ্গে অপারেশনাল চক্রে নতুন চাপ তৈরি হয়— ডলার আরও দামী হওয়ার আগে আমদানিকারীরা দ্রুত ডলার কিনছেন, আর রপ্তানিকারীরা হেজিং পিছিয়ে দিচ্ছেন ভবিষ্যতে ভালো দরের আশায়। এই ওঠাপড়া বাজারে ডলারের সরবরাহ কমিয়ে চাহিদাকে আরও বাড়িয়ে দেয়, ফলে রূপির পতন ত্বরান্বিত হয়।
রিজার্ভ ব্যাংকের সীমাবদ্ধতা — সবসময় ডলার বিক্রি সম্ভব নয়
গত এক বছরে রূপিকে বাঁচাতে রিজার্ভ ব্যাংক ব্যাপকভাবে ডলার বিক্রি করেছে— এতে ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার কমেছে ৪৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জানে, এই ডলার–বিক্রির ক্ষমতা সীমাহীন নয়। একটানা ডলার বিক্রি করলে বাজারে রূপির তারল্য কমে যায়, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় তারল্য সংকট তৈরি হয়, যা ঋণপ্রবাহ ও বাজারের অন্য অংশে চাপ তৈরি করে। তাই রিজার্ভ ব্যাংক ধীরে ধীরে রূপিকে ‘নতুন ভারসাম্য’ খুঁজে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
তবে রূপি এখন বছরে প্রায় ৫ শতাংশ দুর্বল, যা ২০২৫ সালে এশিয়ার সবচেয়ে খারাপ পারফর্মার মুদ্রা। বিশ্লেষকদের মতে, সুদের হার, বাণিজ্য–আলোচনা বা মূলধনপ্রবাহ—এই তিন ক্ষেত্রের কোনও বড় নীতিগত পরিবর্তন না হলে ডিসেম্বরজুড়েই রূপি থাকছে ৮৯–৯১–এর মধ্যবর্তী স্থানে।
উল্লেখ্য, ভারতের বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও ভারতীয় অর্থনীতি আমদানি–নির্ভর, বিদেশি মূলধনের ওপর নির্ভরশীল এবং বিশ্ববাজারের ঝুঁকি–আগ্রহ কমলেই বাজারে মন্দা দেখা দেয়। ফলে আংশিকভাবে রূপির দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়।
Advertisement



