রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
Advertisement
যে গণতান্ত্রিক-বিগ্রহকে মিত্রশক্তিগণ তাহাদের ‘ন্যায়যুদ্ধের’ রথের উপর বসাইয়াছিলেন তাহাকেও আমি পিতৃভূমি-বিগ্রহের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা দেখাইলাম না। ‘এ পাষাণমূর্তিগুলি ভাঙ্গিবে কে?’ ‘পিতৃভূমি, গণতন্ত্র, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতা’ এ সকলের নিকটেই আমি স্বাধীনতা রক্ষা প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদ জানাইলাম।
সেদিন হইতে অতীতের সহিত সম্পর্ক আমার একেবারেই ছিন্ন হইয়া গেল।
Advertisement
আমার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ যে সকল বন্ধুরা জনমতের, এমন কি নিজেদের মতেরও বিরুদ্ধে, তখনও পর্যন্ত আমার পক্ষ লইয়া লড়াই করিতেছিলেন, তাহারা হতাশ হইয়া অস্ত্রত্যাগ করিলেন। সবচেয়ে অন্তরঙ্গ যিনি তিনি লিখিলেন ‘বিগ্রহ’ প্রবন্ধটি তাহার হৃদপিণ্ডে ছুরিকাঘাত করিয়াছে। চিরদিনই আমার প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত আমার মা পারি হইতে আমাকে জানাইলেন ‘বিগ্রহ’ পড়িয়া আমার সম্পর্কে আমার বন্ধুদের মতের সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে—পরিবর্তন হইয়াছে আমার বিরুদ্ধে।’’ (২০শে ডিসেম্বর)
তবুও সেইদিন, ১৯১৪ সালের ২০শে ডিসেম্বর, আমার ডায়েরীতে লেখা, ‘‘জুলাই মাসের পর আজ এই প্রথম আমি পিয়ানো স্পর্শ করিলাম।’’ প্রতি সন্ধ্যায় যাহার সাহচর্য আমি উপভোগ করিয়াছি সেই প্রিয়সঙ্গী সংগীতের সহিত সংস্রব রাখি নাই গত পাঁচমাস। (এই কয়মাস সমসাময়িক ঘটনাবলীর ভয়াবহতা হইতে মনকে বিচ্ছিন্ন করিয়া এক মুহূর্তের জন্যও অবসর বিনোদনে প্রবৃত্ত হইতে পারি নাই। ২০শে ডিসেম্বর তারিখে তিক্ত প্রশান্তির সহিত আমি লিখিলাম: ‘‘এই দেশগুলি ধ্বংস হইয়া গেলেও আমি বিচলিত হইব না; কারণ ইহারা স্বেচ্ছায় ধ্বংসের পথে চলিয়াছে, এমন কি ইহাতে যেন আনন্দও পাইতেছে। আমি, আর ইহাদের জন্য সংগ্রাম করি না, আমার সংগ্রাম সম্মানের জন্য। আজ সন্ধ্যায় একটু মোজার্ট— আমার প্রিয় মোজার্ট—বাজাইয়াছি; আর বাজাইয়াছি কিছু প্রাচীন জার্মান ধর্মসংগীতের সুর।’ (ফ্রেদেরিক মাস যদি জানিতে পারিতেন, তবে নিশ্চয়ই আমাকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করিতেন!)
আমার মন হটাৎ কেন এভাবে মুখ ফিরাইল? ডিসেম্বর মাসে দুইটি ঘটনা ঘটিয়াছে। ফ্রান্সে ঘৃণার বন্যা তখন এতখানি তীব্র ও হিংস্র হইয়া উঠিয়াছিল যেরূপ ইতিপূর্বে আর কখনও হয় নাই। ফ্রান্সের পক্ষে আশুবিপদ তখন কাটিয়া গিয়াছে, তাই ইহা আমার পক্ষে আরও অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। দেশের সবচেয়ে প্রখ্যাত ও স্বাধীনচেতা চিন্তাজীবিগণ এই কোরাসে যোগ দিয়াছেন। যোগ দিয়াছেন বের্গ্সঁ ও রেমি দ্য গুরমঁ। তাসের রাজা বারেস রাগে অন্ধ হইয়া শুধু জার্মানদের উপর নহে, ফরাসী শান্তিবাদীদের উপরও ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন।
তাহাকে অনুসরণ করিয়াছেন আঁদ্রে বোনিয়ে-র ব্যারাত্রাঁ ও এমিল পিকার। ইহারা সকলেই জাম্রান জাতির বৈজ্ঞানিক প্রতিভাকে অস্বীকার করিলেন। পারির ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের রেক্টর বোদ্রিয়ার এই সুরে সুর মিলাইয়াছেন।
নৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই বদলাইয়া গিয়াছে। ঠিক সেই সময় বার্লিনের বিজ্ঞানপরিষদে জনৈক সদস্য ফাদার লাসনের উন্মাদ অপভাষণের একবাক্যে তীব্র নিন্দা করিতেছিল এবং লাইপৎসিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট আস্টভাল্ড-এর সহিত সর্বসম্পর্ক ছিন্ন করিয়া মহানুভবতা প্রদর্শন করিতেছিল।
(ক্রমশ)
Advertisement



