এ পর্যন্ত তৃণমূল নেতৃত্ব সাংবাদিক বৈঠক কিংবা জনসভা করে অভিযোগ জানাচ্ছিল। কিন্তু শুক্রবার সরাসরি জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তরে গিয়ে ক্ষোভ উগরে দিল তৃণমূল প্রতিনিধিদল। সূত্রের খবর, কমিশনের আধিকারিকদের সামনেই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের বিরুদ্ধে তীব্র বক্তব্য রাখেন তৃণমূলের কয়েকজন সাংসদ। তাঁদের অভিযোগ— জ্ঞানেশ কুমারের হাতে রক্ত লেগে আছে। তাঁর সিদ্ধান্ত এবং ভূমিকার কারণেই দেশে এত মৃত্যু, এত আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেন তাঁরা।
এসআইআর চলাকালীন কাজের চাপ ও আতঙ্কে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন বলে তৃণমূলের দাবি, সেই মৃতদের তালিকা সরাসরি নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দিয়েছে এই প্রতিনিধিদল। একই সঙ্গে কাজের অতিরিক্ত বোঝা ও মানসিক চাপ সহ্য করতে না-পেরে যেসব বিএলও মারা গিয়েছেন বলে অভিযোগ, তাঁদের নামের তালিকাও জমা দেওয়া হয়েছে কমিশনে। এই নথিগুলিই দেখিয়ে তৃণমূলের বক্তব্য— মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের হাতে রক্ত লেগে আছে। ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট করে দিচ্ছে, কমিশনের বিরুদ্ধে তৃণমূলের ক্ষোভ এখন তুঙ্গে।
Advertisement
এসআইআর প্রক্রিয়াকে ‘অপরিকল্পিত’ বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক দিনের ব্যবধানে দু’টি আলাদা চিঠি পাঠিয়েছিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে। মুখ্যমন্ত্রীর এই ধারাবাহিক আপত্তির পরেই তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয় কমিশন। সেই অনুযায়ী শুক্রবার দিল্লির নির্বাচন কমিশনে পৌঁছন তৃণমূলের ১০ জন সাংসদ।
Advertisement
বৈঠক শেষে বাইরে এসে ডেরেক ও’ব্রায়েন, মহুয়া মৈত্র, শতাব্দী রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দোলা সেন জানান— তৃণমূলের পক্ষ থেকে যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, সেগুলোর একটিও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি কমিশনের কর্তারা। তাঁদের মতে, কমিশনের এই নীরবতাই তৃণমূলের আশঙ্কাকে আরও জোরদার করেছে।
তৃণমূলের সার্বিক অভিযোগ, এসআইআর প্রক্রিয়া মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও বাঙালিদের নিশানা করেই চালানো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ঘাসফুল শিবিরের সাংসদরা কমিশনের সামনে পাঁচটি মূল প্রশ্ন তোলেন। প্রথম প্রশ্ন, সত্যিই কি ভোটার তালিকা শুদ্ধ করার উদ্দেশ্যেই এসআইআর চালু হয়েছে, নাকি বাংলাকেই নিশানা করা এর আসল লক্ষ্য? যদি শুদ্ধিকরণই উদ্দেশ্য হয়, তবে বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম বা অরুণাচল প্রদেশে একই প্রক্রিয়া চালু করা হল না কেন? কেন শুধুমাত্র বাংলাতেই? দ্বিতীয় প্রশ্ন, ২০২৪ সালের ভোটার তালিকায় যদি অবৈধ ভোটারের অস্তিত্ব থেকেই থাকে, তাহলে সেই তালিকার ভিত্তিতে গঠিত সরকার কীভাবে বৈধভাবে ক্ষমতায় আছে? তৃতীয় প্রশ্ন, বিহারে এসআইআর চালানোর পর কমিশন ঠিক কতজন বিদেশি বা অনুপ্রবেশকারীকে শনাক্ত করতে পেরেছে? চতুর্থ প্রশ্ন, বিজেপি নেতারা বারবার বলছেন— এসআইআরের পর বাংলার ভোটার তালিকা থেকে নাকি এক কোটির বেশি নাম বাদ যাবে। তাঁদের কাছে এই তথ্য এল কোথা থেকে? কমিশন কি তাহলে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত কোনও সংস্থায় পরিণত হয়েছে? শেষ প্রশ্ন, তৃণমূল যে মৃতদের নামের তালিকা কমিশনের হাতে তুলে ধরে দাবি করেছে— এসআইআর-জনিত ভয় ও চাপের কারণেই তাঁদের মৃত্যু— সেই মৃত্যুর দায় নেবে কে?
এই পাঁচটি প্রশ্নই তুলে ধরে তৃণমূল দাবি করেছে যে, এসআইআর প্রক্রিয়া চালু করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি, প্রশাসনিক নয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই চিঠি লিখে এসআইআর প্রক্রিয়া অবিলম্বে স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনকে। শুক্রবার কমিশনে উপস্থিত হয়ে একই দাবি ফের জানিয়েছেন তৃণমূলের সাংসদদের প্রতিনিধি দল।
এসআইআর নিয়ে একাধিক মামলা এখন একসঙ্গে বিচারাধীন সুপ্রিম কোর্টে। আদালতেও তৃণমূলের আবেদন— এই প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ রাখা হোক এবং প্রয়োজন হলে সময় বাড়িয়ে পরে করা হোক। গত বৃহস্পতিবার এসআইআর-সংক্রান্ত মামলার শুনানি হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতে। যদিও সেদিন কোনও স্থগিতাদেশ জারি করা হয়নি। তবে আদালত জানিয়েছে, আগামী ৯ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বক্তব্য শোনা হবে।
প্রসঙ্গত, ওই তারিখের আগেই এসআইআরের প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। একই দিনে— অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বরই খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের দিন, যা কমিশন আগেই নির্দিষ্ট করে ঘোষণা করেছে। ফলে, সুপ্রিম কোর্টে শুনানির আগেই কার্যত প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ শেষ হয়ে যাবে— এমনটাই অভিযোগ তৃণমূলের।
Advertisement



