• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

নাড়া পোড়া চাষির কাছে শাঁখের করাত

চারিদিক থেকে শীতকালের যাবতীয় দূষণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে এই নাড়া পোড়াকেই দায়ী করা হচ্ছে। অবশ্যই শীতকালে দূষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এই নাড়া পোড়া।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

বিশ্বজিৎ সরকার

নাড়া পোড়ানোর বহ্নি-উৎসব শুরু হয়েছে। শীত এলেই নাড়া পোড়া অর্থাৎ ধান গাছের গোড়া পোড়ানো নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। এই নাড়া পোড়ার গন্ধে ঘুম গেছে দূষণ মন্ত্রকের, পরিবেশবিদদের, এমনকী অসংখ্য শহুরে নাগরিকের। এই নিয়ে পাঞ্জাব-হরিয়ানার কিছু চাষিদের জেল জরিমানা হয়েছিল। কারণ ২০১৫ সালের সুপ্রিম কোর্ট ন‍্যাশানাল গ্রিন ট্রাইবুনাল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশিকা অমান্য করে। পাঞ্জাব হরিয়ানার চাষিদের নাড়া পোড়ানোর জন্যই নাকি দিল্লির অতি-মাত্রার দূষণের অন্যতম কারণ। এই বিধি-নিষেধের ফলে পাঞ্জাব-হরিয়ানায় কিছুটা হলেও নাড়া পোড়া কমেছে, তবে বন্ধ হয়নি এখনও। তবে এই নাড়া পোড়ানো কিন্তু ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের অন্যান্য ধানচাষের এলাকায়। এ বঙ্গেও বেশ কয়েকবছর ধরে নাড়া পোড়ানো নিয়ে হৈ চৈ চলছে। কিছুদিন আগে হুগলির গোঘাট এলাকা থেকে এই নাড়া পোড়ানোর জন্য গ্রেপ্তারও করা হয়েছে কয়েকজন চাষিকে। ইদানীং চাষিদের সচেতনতার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পও করছে কৃষিমন্ত্রক। গত বছর ৩ নভেম্বর বেশ কিছু জায়গায় পালিত হয়েছে নাড়া পোড়াবিরোধী দিবস।

Advertisement

চারিদিক থেকে শীতকালের যাবতীয় দূষণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে এই নাড়া পোড়াকেই দায়ী করা হচ্ছে। অবশ্যই শীতকালে দূষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এই নাড়া পোড়া। কিন্তু ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ ও তার কারণ নির্ধারণে চাষিকেই যেভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় তা বড়ই সরলীকৃত ও একপেশে। এ লেখা নাড়া পোড়ানোর পক্ষে সাফাই গাওয়া নয়। কিন্তু ধান কাটা হলেই নাড়া পোড়ানো নিয়ে যেভাবে হৈ চৈ শুরু করে সমস্যার গভীরে না গিয়ে কৃষকের উপর দায় চাপানো হয়, এ নিবন্ধ তারই শুলুক সন্ধান মাত্র ।

Advertisement

কোনও কোনও মহল থেকে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে আবাদশেষে নাড়া পুড়িয়ে জমি চাষ করার অভ‍্যাস চাষিদের বরাবরই। এতবড় একটা ভুল তথ‍্যকে প্রতিষ্ঠিত করা ভাবের ঘরে চুরি করার নামান্তর। দু’দশক কৃষিকাজে নিযুক্ত থাকার অভিজ্ঞতার সুত্রে বলতে পারি, চাষিদের এই অভ্যাস কোনও কালেই ছিল না অন্তত দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে। এই নাড়া পোড়া এ বঙ্গে শুরু হয়েছে মেরে কেটে ৮-১০ বছর। ধান কাটার কাজে হারভেস্টার বা কম্বাইন মেশিনের ব‍্যবহারের দিন থেকে। ধান কাটার পর গুছির গোড়ার অংশ যে মাটিতে আটকে থাকে তাই নাড়া। এই নাড়া জমিতেই হেজে মজে যেত। আমন ধান কাটার পর শীতকালীন বৃষ্টির পর যে ধুলোট চাষ হত জমিতে তাতেই চাপা পড়ে যেত এই ছোট নাড়া। তারপর বর্ষাতে সেই নাড়া মাটির সঙ্গে ধুয়ে মুছে সাফ। আর আউশ চাষের জমিতে অর্থাৎ দো-ফসলি জমিতে আলুর চাষে অবশিষ্ট নাড়াগুলো জমির এক কোণে গাদা করে রাখা এখনও রীতি। কয়েক মাসের মধ‍্যেই এগুলো পচে যায়। আলু ছাড়া সরষে গম ইত্যাদির চাষে আবার অবশিষ্ট নাড়াগুলো দাঁড়া বা ভেলি তুলতেই কাজে লেগে যায়। পরের চাষে সেগুলো জমিতেই মিশে যায়। নাড়া নিয়ে চাষির কোনও দিন সমস্যা হয়নি। তাহলে নাড়া পোড়ানো হচ্ছে কেন?

এই প্রশ্নে আগ্রহ কম, আর এখানেই আছে রহস্য। ধান কাটতে ওই হারভেস্টার যন্ত্র চালু হওয়ার পর থেকেই শুরু নাড়া পোড়া। এ যন্ত্র এমন যেখানে চাষিকে কাস্তে দিয়ে ধান কাটাতে হয় না, এটুতে হয় (আঁটি বাঁধা) না, মাঠ থেকে ঘরে নিয়ে এসে ঝাড়তে হয় না, মাঠেই ধান হারভেস্টার যন্ত্রের মাধ্যমে বস্তাবন্দি হয়ে যায়। শুধু থেকে যায় মাটির সঙ্গে গুছির গোড়া থেকে খড়ের অর্ধাংশ। আগে কাস্তে দিয়ে ধান কাটার পর গোড়ার খুব সামান্য অংশ মাটির সঙ্গে লেগে থাকত, কিন্তু এই যন্ত্রে থাকে অর্ধাংশই। আর এই অর্ধাংশই যত নষ্টের গোড়া, চাষির মাথাব্যথা। এক ফসলি জমি হলে হয়ত থেকে যাওয়া গাছের গোড়া নিয়ে সমস্যা হত না এতটা। ধুলট চাষ এবং আকাশের বৃষ্টিতে মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হত, কিন্তু বর্তমানে ধানের পরই ওই জমিতেই শুরু হয় অন্য চাষ। কিন্তু পরবর্তী চাষের ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান কম থাকায় এই গোড়া জমিতেই সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। অতএব পুড়িয়ে দাও এই খড়। এ ব্যাপারে বর্ধমানের কিছু চাষি স্পষ্টতই জানিয়েছেন তাদের নিরুপায় অবস্থার কথা। কেননা ওই গোড়া কাটার খরচা করার মত সাধ্য তাঁদের নেই (সংবাদসূত্র)।

তাই এই নাড়া পুড়ছে৷ এর আগে দেখে নেওয়া যাক, এই হার্ভেস্টার আসার ফলে ক্ষতির বহর। এটা ঠিক অপেক্ষাকৃত কম খরচে কম সময়ে এবং আমন ধানের ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজটা সম্পন্ন হচ্ছে, কিন্তু ক্ষতি ব্যাপক। এখানে শর্ট টার্ম বেনিফিট আছে, কিন্তু আখেরে প্রচুর ক্ষতি। কাস্তে দিয়ে ধান কাটলে গোটা খড়টা পাওয়া যায়। হার্ভেস্টার আসার ফলে খড়ের আকাল শুরু হবে অচিরেই। গ্রামবাংলায় বাড়ির ছাউনি হিসাবে খড়ের ব্যবহার হ্রাস হলেও

গো-খাদ্যের সিংহভাগ এই খড় থেকেই। এছাড়া প্যাকিংয়ের কাজ, মাশরুম চাষ, জৈব জ্বালানি থেকে শুরু করে পুকুরের জলে শ্যাওলা পরিষ্কার-সহ নানাধিক কাজে খড়ের ব্যবহার। সেই খড় নষ্ট হচ্ছে এই যন্ত্রে। যে জমিতে এই যন্ত্রে ধান কাটা হচ্ছে সেই জমির ধান গাছ থেকে খড় পাওয়া যাচ্ছে না। এ তো গেল খড় থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা। খড় পুড়লে চাষির জমির ক্ষতি।

প্রথমত, মাটির উপরিভাগের জীবাণুগুলি নষ্ট হয়ে মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট করছে, চাষিকে আরও রাসায়নিক সারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মাটির জৈব পদার্থগুলি ভেঙে দিয়ে ভারসাম্য নষ্ট করছে। এমনকী উপকারী কেঁচো মারা যাচ্ছে। চাষি জানে এসব কথা, তা সত্ত্বেও নাড়া পুড়ছে, কারণ খরচ কমার জন্যই তো এই যন্ত্র। আবার যদি তাঁকে কাস্তে নিয়ে ওই অবশিষ্ট অংশ কাটতে হয়, তাহলে তার কী লাভ? এখানেই প্রশ্ন, ধান কাটার বিশাল যন্ত্র তাহলে চাষির সামনে তুলে ধরা খুব কি প্রয়োজন ছিল, যেখানে এ যন্ত্রের ব্যবহারে দূষণ আসবেই? সাধারণ গরিব-মধ্যবিত্ত চাষি তো সামান্য সাশ্রয় খুঁজবে, কিন্তু তাঁদের অহেতুক প্রলোভিত করার দায় কার। ধান ঝাড়াইয়ের কাজে এই যন্ত্রটির ব্যবহার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না এটা ভাবা দরকার। অন্তত গোড়া নির্মূল করার বিকল্প ব্যবস্থা না ভেবে এ যন্ত্রের ব্যবহার কতটা প্রয়োজনীয়?

এছাড়া এই হার্ভেস্টার যন্ত্রের বহুল চলাচলে গ্রামের রাস্তার দফা রফা, যা প্রায়শই সংবাদপত্রের খবরে উঠে আসছে । কৃষিতে বৃহৎ পুঁজির প্রবেশ অনেক আগেই ঘটেছে, এমনতর যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে গ্রামাঞ্চলে ধান কাটার মরশুমের স্থায়িত্বকাল ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে, যার পরিণামে পরিযায়ী শ্রমিক উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে বর্ষা এবং পৌষের কাজের উপর ভরসা করে গ্রামীণ মজুররা আশায় থাকতেন৷ এখন কাজ কম, অতএব চলো অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে৷

Advertisement