সুতপন চট্টোপাধ্যায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
Advertisement
১১
মান সিং চলে গেল আবাসনের বাইরের জঙ্গলে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, না সাব, সব পেয়ারা গাছ, আম গাছ, সবেদা গাছ দেখে এসেছি দু’জনে। কোথাও নেই। আলো ফেলেছি, জোরে জোরে হুইসল বাজিয়েছি। নেই। অন্য কোথাও চলে গেছে। আপনারা খোঁজ করুন। বলে সে হুইসল দিতে দিতে পাহারায় চলে গেল। নন্দিনী বলল, এলাহাবাদ ঢুকতে আর কত দেরি?
অতনু বলল, আরও এক ঘণ্টা।
Advertisement
চন্দ্রিমার ফোন এল ঠিক সেই সময় আবার। ফোন তুলেই উৎকন্ঠায় ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় জিজ্জেস করল, দিদি, কোনও খবর পেলি? আমি ফোন নন্দিনীর হাতে দিয়ে দিলাম। নন্দিনী বলল, না এখনও ট্রেন এলাহাবাদ পৌঁছতে দেরি আছে।
—ট্রেনের ড্রাইভারের সঙ্গে ওয়ারলেসে কথা বলা যায় না?
সে তো ট্রেন চালাচ্ছে, সে কী করে জানবে? আর তাঁর নম্বর কোথায়? ইলাহাবাদ ইন না করলে কিছুই জানা যাবে না।
অন্যদিকে প্রায় কান্নাধরা গলায় চন্দ্রিমা বলল, যদি না থাকে ওই ট্রেনে? কী হবে দিদি?
নন্দিনী তখন পাথর। কোনও কিছুই সে গভীরভাবে শুনছে না। সে বলল, আর তো মাত্র ঘন্টা খানেক। তার পর ভাবা যাবে। মাথা কাজ করছে না। তোরা ঘুমিয়ে পড়। আমি খবর পেলে ফোন করব। ফোনের কথোপকথন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সবাই।
চন্দ্রিমা বলল, কী বলিস দিদি? ঘুমবো? তোর মাথা খারাপ? আচ্ছা, পড়ার টেবিলের ড্রযারের কিছু লিখে যায়নি তো? কোনও ক্লু? একবার সেটা দেখেছিস?
নন্দিনী বলল, সত্যি আমার মাথা খারাপ। রাখ। বলে ফোনটা নামিয়ে দিল। দিয়ে অতনুর দিকে তাকিয়ে বলল, এটা তো মাথায় আসেনি। তুমি একবার ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারগুলো দেখ। আমি আর পারছি না। বলে সে আবার স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিলো।
অতনু তার পড়ার টেবিলের সব ড্রয়ারগুলো একে একে খুলে দেখল। এক-একটি ড্রয়ারে এক-এক রকমের জিনিস। উপরের ড্রয়ারে আছে রঙ আর তুলি। অবসরে বসে বসে একাই ছবি আঁকত। সে ইস্কুলের অনেকবার বসে আঁকো প্রতিয়োগিতায় পুরস্কার পেয়েছে। তা নিয়ে সে খুব গর্ব অনুভব করত। পরের ড্রয়ারে আছে কমিক্সের বই। বেশ যত্নে সাজানো। পর্ব ভাগে গার্ডার দিয়ে রাখা যাতে গুলিয়ে না যায়। তৃতীয় ড্রয়ারে আছে তার কবিতার খাতা। সে যে কবিতা লিখত সেই সঙ্গে কিছু ছবি। তার বেশির ভাগই সমুদ্রের তীরের। সার সার নারকেল গাছ, নুলিয়া, বালুচর, ঝিনুক, এইসব। মনে আছে একবার পুরী বেড়াতে যাবার কথা। সেখানের ছবি। কিন্তু এই ছবিগুলো বেড়িয়ে আসার পরে এঁকেছিল। তারিখ দেখে মনে হচ্ছে। ইদানিং সে ছবি আঁকেনি। আঁকলে সেই ছবি এখানে নেই। অতনু যেন বুম্বাকে নতুন করে আবিষ্কার করছে। মনেই হচ্ছে না, সে এখানে নেই। আছে, কাছে-পিঠে আছে কোথাও। সে যে দুপুর থেকে নিখোঁজ মানতেই পারছে না অতনু।
লাস্ট ড্রয়ারে আছে জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের ছবি। দিল্লিতে থাকার কারণে অনেকবার পাহাড়ে বেড়াতে গেছে। নৈনিতাল, রানীক্ষেত, কৌশানি, হিমাচলের ডালহৌসি পাহাড়ে গরমের দিনে বেড়াতে গেছে সপরিবারে। বুম্বা ছোট থেকে পাহাড়ে খেলে বেড়াতে ভালবাসে। সে আঁকার খাতায় নানান পাহাড়ের ছবি এঁকে তারিখ দিয়ে রেখেছে। একবার ডালহৌসি পাহাড়ে এক বানরের পাল্লায় পড়েছিল। একটি বড় বানরকে খাবার দিতে গিয়ে সে তেড়ে এসেছিল এই ভেবে, তাকে যেন আক্রমণ করা হয়েছে। সেদিন থেকে বুম্বা খুব ভয় পায়। সে বানর বা হনুমান দূর থেকে দেখে। তাই তার ছবিতে পাহাড়ে একটিও বানরের বা হনুমানের ছবি নেই। আঁকেনি সে। শুধু গাছের ডাল থেকে তাদের লম্বা লেজ এঁকে রেখেছে। তাহলে কি সে কোনও পাহাড়ের দিকে চলে গেছে? ভারতের উত্তরদিকে সারিবদ্ধ পাহাড়। যে কোনও দিকেই চলে যাওয়া যায়। কোনও কথা না ভেবে দিল্লি বাস ডিপো থেকে সিমলার বাসে উঠে পড়লেই সে অনায়াসে সিমলা পৌঁছে যাবে। কিন্তু সেখানেও তো কেউ নেই!
১২
ঠিক এমন সময় বিমলের ফোন এল গোয়েলের ফোনে। বিমল বলল, বস্কে পাওয়া গেছে। অজয় সাক্সেনা বলে আমাদের সেল্সের এক কলিগ ইলাহাবাদ স্টেশনে যাবে। অজয়কে বস্ বলেছে, পূর্বা পৌঁছনোর আগেই এলাহাবাদ স্টেশনে পৌঁছে যেতে। সময় আছে। তাই বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে রওনা হবে। বস্ বলেছে, যেভাবেই হোক ওকে ট্রেন থেকে ইলাহাবাদে নামিয়ে ওর বাড়ি নিয়ে যেতে। পরের দিন সকালে তাকে নিয়ে লখনউ অফিসে আসতে। আরও বলেছে, কোনোভাবেই যেন ইলাহাবাদ থেকে বেরিয়ে না যায়। তার জন্য ইলাহাবাদ স্টেশন- মাস্টারকে খবর দিতে বলেছেন।
গোয়েল বলল, ভাবীজিকে বল স্টেশন- মাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে।
বিমল আরও জানাল, অজয় এলাহাবাদ স্টেশনে পৌঁছে আমাকে ফোন করবে। রেলওয়ে পুলিশের সঙ্গে দেখা করে লিখিত চিঠি দেবে এবং স্টেশন-মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে দরকারে ট্রেনকে বেশি সময় ধরে থামিয়ে রাখবে। অনিশ্চিত দমবন্ধ আবহাওয়া কিছুটা কমল। কিন্তু প্রশ্নটা ঝুলে রইলই, বুম্বা ওই ট্রেনে আছে তো?
যদি না থাকে তার পর কী করবে? থানা থেকেও কোনও খবর নেই। দারোগা বলেছিলেন ভালো করে, পরিষ্কার করে এফআইআর লিখতে। নন্দিনী তাই লিখেছিল। সেই মত খবর গেছে সমস্ত পুলিশ ফাঁড়িতে। কোনও খবর এল না তো?
নন্দিনী স্টেশন-মাস্টারকে বলল, আমাদের দিকে থেকে অজয় সাক্সেনা বলে একজন ছেলেকে ট্রেন থেকে আমাদের হয়ে নামিয়ে নেবে। ইলাহাবাদ স্টেশন-মাস্টারকে খবর দিয়ে দিন প্লিজ। আমাদের নাম্বারটাও ইলাহাবাদ রেলপুলিশের ইন্সপেক্টরকে দিয়ে রাখবেন। দরকারে যেন তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলে মত নেন।
স্টেশন-মাস্টার বললেন, করবো ম্যাডাম।
১৩
লখনউয়ে অতনুদের অফিস খুব ছোট। শর্মাজী ও তাঁর পিএ বিমল। প্রধানত উত্তরপ্রদেশের সরকারি দপ্তরের সঙ্গে তাঁদের কাজ। আর তিনজন প্রদেশের তিন জায়গায় পোস্টেড। মাসে দু’বার অফিসে আসে, শর্মাজীর সঙ্গে মিটিং থাকে। যেহেতু সরকারি কাজেই বেশি হয়, রেলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ খুব কম বললেই হয়। বিমল ফোন করল আবার। বলল, অজয়কে ধরতে পারছি না। ফোন সুইচড্ অফ আসছে। সে ইলাহাবাদ স্টেশন থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে থাকে। রাতে ফোন অনেক সময় বন্ধ থাকে। আমি চেষ্টা করে দেখছি। কিছু হলে আমি আবার ফোন করব। অজয়ের নাম্বারটা নাও। তোমরাও তোমাদের দিক থেকে চেষ্টা কর। বলে সে ফোন মানিয়ে দিল।
গোয়েল বলল, ইলাহাবাদেই নামিয়ে নিতে হবে। একবার বিহারর মধ্যে ঢুকে গেলে যা কিছু হতে পারে। তারপর নেক্সট স্টপেজ মুঘলসরাই।
একটা পঁয়তাল্লিশে ইলাহাবাদে ঢুকবে। এই সময়ের মধ্যে কিছু একটা করতেই হবে। কমপ্লেক্সের কারা রেলওয়েতে চাকরি করেন, তাঁদের খোঁজ শুরু হল। একজনকে পাওয়া গেল তবে সে বছর তিনেক আগে অবসর নিয়েছে। সেদিকেও কিছুর আশা দেখা গেল না। উৎকন্ঠা তুঙ্গে অতনুর। নন্দিনী আবার এতো রাতে স্টেশনে গেছে, স্টেশন-মাস্টারের অফিস থেকে ইলাহাবাদে ট্রেনকে যেভাবেই হোক আটকাবে সে।
সঙ্গে পবন আছে, তবু রাত্রির দিল্লি শহর যে কোনও শহরের মত ভয়ের। একবার আক্রান্ত হলে তো চিত্র বদলে যায়। আর খারাপ সময় একা আসে না। এক সঙ্গে অনেক বিপদ নিয়ে আসে।
বুম্বা কি এখন ঘুমোচ্ছে? নাকি সে ঘুমের ঘোর কেটে দেখছে, সে তো বাড়িতে নেই। ট্রেনের উপরের বাঙ্কে শুয়ে আছে। কে তাকে এখানে এনে শুইয়ে দিয়েছে খেয়াল করতে পারছে না। কী করে সে এখানে এল, কোথায় সে যাচ্ছে, কী করতে চায়, সব কিছুই তার অজ্ঞাত। হয়ত আমাদের কাছে না দেখতে পেয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে। কামরায় কেউ আছে তো? এমনও হতে পারে, আশেপাশে কেউ নেই। বাঙ্ক থেকে ঘুমের ঘোরে পড়ে গেছে মাটিতে। খুব লেগেছে আর লাগার চোটে হাতে পায়ে আঘাত। যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না। কেউ তো নেই সেখানে। পুলিশরা রাতের ট্ট্রেনে ডিউটি করছে। কামরায় কামরায়। আর রাতের ঘন অন্ধকার ফুঁড়ে ট্রেন ছুটে চলেছে কোন এক অজানা স্টেশনের দিকে। এই সবই ভাবছে অতনু।
(ক্রমশ)
Advertisement



