বরুণ দাস
গত ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে অনেক অনুভবী পাঠকেরই হয়তো চোখে আটকে গেছে। কী সেই ‘চোখ আটকে যাওয়া’ খবর? ‘স্পর্শ করা বারণ, ধ্বংসস্তূপে আটকে আফগান মেয়েরা।’ সম্প্রতি আফগানিস্তানে প্রবল ভূমিকম্পে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে গোটা দেশ জুড়ে। ধনসম্পদের পাশাপাশি প্রচুর প্রাণহানীও হয়েছে। এতোটা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয়নি এই গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্থ তালিবান-পন্থী দেশটি। ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতোই যেন সেদেশের বর্তমান অভ্যন্তরীন অবস্থা।
Advertisement
উল্লেখ্য, দুই মহাশক্তিধর দেশের দীর্ঘ টানাপোড়েনে ওই ছোট্ট দেশটির প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। তারপর একসময় রাশিয়া লেজ গুটিয়ে পালালেও আমেরিকা মাটি কামড়ে পড়েছিল আফগান-মাটিতে। বছর চারেক আগে তারাও একইভাবে আফগানিস্তানের মাটি ও মানুষ ছেড়ে পালায়। ফলে দ্বিতীয়বার তালিবানী শক্তি সেদেশের মাটিতে শেকড় গেড়ে বসে। প্রথম বসেছিল ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত। তালিবানীশক্তি ক্ষমতায় আসায় সভ্যতার চাকা পিছন দিকে ঘুরতে শুরু করে। সেদেশের মহিলারা গৃহবন্দি হতে বাধ্য হয়।
Advertisement
রাতারাতি মুসলিম শরিয়ত আইন বলবৎ করে উগ্র তালিবানপন্থীরা। ওই শরিয়ত আইনে যেসব ধর্মীয় বিধি-নিষেধ রয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় মহিলারা। তাদের যাবতীয় মানবিক ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয় এই আইনের নানাবিধ কু-ধারা। মহিলাদের সার্বিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়। তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমন কি, বাইরে বেরিয়ে কাজের অধিকারও। ঘরের বাইরে পা রাখাই তাদের বারণ। কারণ ওই ধর্মীয় আইনে পর-পুরুষের মুখ দেখাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
আফগান বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের লেখা বইও নিষিদ্ধ। মধ্যযুগের অন্ধকারময় পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। একুশ শতকে পা রেখেও তারা সভ্যতার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করে। সেদেশের মহিলাদের দু’টি মাত্র কাজ। এক, দিনে সংসারের কাজ এবং দুই, রাতে পুরুষের যৌনচাহিদা পূরণ অর্থাৎ সন্তান উৎপাদন ও তাদের লালন-পালন। এই দু’য়ের বাইরে নারীদের অন্য কোনও কাজ নেই এই শরিয়তী শাসন ব্যবস্থায়। দেশ ও দশের উন্নয়নে নারীদের কোনও ভূমিকাই স্বীকার করা হয় না শরিয়ত আইনে।
তালিবানীরা স্পষ্টতই জানিয়েছে, শরিয়ত আইনে মহিলারা কোনওভাবেই ‘স্পর্শযোগ্য নন।’ তাই ভূমিকম্পের ফলে ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া মহিলাদের উদ্ধারকার্য করা যাবে না। তারা নিজেরা নিজেদেরকে উদ্ধার করতে পারলে ভালো, তা নাহলে মৃত্যুকে বরণ করে নেবে এটাই শরিয়ত আইন বলছে এবং চিকিৎসকেরাও তাদের চিকিৎসা করতে পারবেন না। সেদেশের তালিবান শাসকরা এই ধর্মীয় ফরমানকেই প্রাধান্য দিতে প্রস্তুত। কোনওভাবেই এর অন্যথা করা যাবে না। মানুষের প্রাণের চেয়েও ধর্মীয় অনুশাসন বড়ো।
যেমন পবিত্র ইসলাম ধর্মে ইহলোক থেকে পরলোকের গুরুত্ব অনেক বেশি। নিজের অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে তারা বেহেশতে যেতেও প্রস্তুত। কারণ সেখানে নাকি চূড়ান্ত বিলাসী জীবন কাটানো যায়। ওই লোডেই অনেক আধুনিক শিক্ষিত তরুণও জেহাদি কাজ করে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে কসুর করে না। সেভাবেই অর্থাৎ ধর্মীয় আখ্যান ও অনুশাসন পেশ করে তাদেরকে মগজ ধোলাই করা হয় বলে অভিযোগ। আজকের উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-নির্ভর দুনিয়ায় ধর্ম আঁকড়ে আছেন বিশাল সংখ্যক মানুষ।
অনেকে হয়তো-বা বলবেন, কেন বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন সে দেশের নারীরা? নারী চিকিৎসকদের কাছে যাবেন তারা। সে দেশে নারী-চিকিৎসক কোথায়? সেদেশের নারীরা তো বাড়ির বাইরে পা রাখতেই পারেন না। শিক্ষাদীক্ষার অধিকার থেকেই বঞ্চিত। ফলে নারী চিকিৎসকের প্রশ্নই ওঠে না। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতেও তো একই পরিস্থিতি। কোথাও নারী শিক্ষক নেই। ফলে সেদেশে নারীশিক্ষারও প্রশ্ন ওঠে না। নারীদের প্রসবকালীন জটিলতা তথা সন্তানের জন্মদানের ক্ষেত্রেও প্রসূতির প্রাণের ঝুঁকি থেকে যায়।
অনেকে তো প্রসবকালীন জট জটিলতায় মারাও যান। আজও অ-প্রশিক্ষিত ধাইদের হাতেই প্রসূতিদের জীবন-মরণ পুরোপুরি নির্ভর করছে। এমনকি, নবাগত সন্তানেরও। নারীদের এটাই ভবিতব্য বলে ধরে নেওয়া হয়। সুতরাং প্রতিকারেরও কোনও পথ নেই। এটাই হল তালিবানী আফগানিস্তানের বর্তমান বাস্তবস্থা। পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে শরিয়ত আইন লাগু হলে একই করুণ ও অমানবিক পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হবে সেদেশের মহিলাদের। একুশ শতকেও আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি-একবার ভাবুন তো।
আজকের আফগান পরিস্থিতি আমাদেরকে নতুন করে ভাবায় বৈকি। নারীকে যেখানে ‘অর্ধেক আকাশ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিদ্রোহীকবি কাজি নজরুল ইসলাম, সেখানে সেই ‘অর্ধেক আকাশ’ জুড়েই ঘন অন্ধকার। এই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সেদেশের উন্নতি হবে কিভাবে? একটা গোটা দেশের অর্ধেক মানুষকেই যদি শরিয়তের অনুশাসন তথা ধর্মের নামে এভাবে গৃহবন্দি করে রাখা হয় তো, সেদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা আফগানিস্তানের আজকের পরিস্থিতিই প্রকৃত প্রমাণ দিচ্ছে।
আর কবে সুস্থ ও স্বাভাবিক চেতনার উন্মেষ ঘটবে আফগানদের? প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বেড়াজাল (পড়ুন মোহজাল) কাটিয়ে কবে তারা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে ও অন্যদের বোঝাতে শিখবেন? কবে তারা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পথচলা শুরু করবেন? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের সবাইকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাদীক্ষা ও আধুনিক জ্ঞান- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রত্যাশিত আলোয় পথ চলাতে সাহায্য করবেন? নারীকে মানুষ নয়, শুধুই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখা শুরু করবেন? বলাবাহুল্য, যতদিন না তারা সজাগ ও সচেতন হবেন, নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন, নারীদের জীবন-যুদ্ধের সহযোদ্ধা হিসেবে দেখবেন, তাদের নারী নয়- প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে উৎসাহ না দেবেন, ভতোদিন সেদেশের উন্নতি কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। তাই সব ব্যাপারেই পিছিয়ে আছেন তারা। এই পিছিয়ে থাকার জন্য তারা শতকরা একশোভাগ দায়ী একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পক্ষে ধর্মীয় অনুশাসনকে অন্তরায় করে তুলেছেন তারা।
আরব দুনিয়ার অনেক দেশেই আজ পাশ্চাত্যের খোলা হাওয়া লাগলেও আফগানরা কিন্তু পাশ্চাত্যের সেই খোলা হাওয়া থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছেন। এরফলে আরব দুনিয়া থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। আজকের মুক্ত বা খোলা হাওয়ার মাঝে আফগানরা কেন নিজেদেরকে ধর্মের নিগড়ে বন্দী করে রাখবেন? ধর্ম থাক সবার হৃদয়ের মাঝে, তাকে দেশশাসনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। প্রায় চোদ্দশো বছরের ধর্মীয় অনুশাসন আজকের উন্নত দুনিয়ায় একেবারেই অচল।
একই কথা অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুশাসন সম্বন্ধেও সমান প্রযোজ্য। যেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে বিশ্বের সর্বত্র লড়াই চলছে, সেখানে আফগানিস্তানে একুশ শতকে পা রেখে নারীদের যাবতীয় নাগরিক অধিকারই অস্বীকার করা হচ্ছে। শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে সার্বিক মনুষ্যত্ব ও মানবিক দিকটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে। এরফলে গোটা সমাজেরই অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে ধ্যান দেওয়ার মতো কেউ নেই। একটা গোটা দেশের মানুষ এমন নির্বিকার হয়ে থাকতে পারেন।
অর্থাৎ উগ্র মৌলবাদীদের কাছে মাথা নত করে থাকতে পারেন? মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার বিরুদ্ধে কেউ কোনও প্রতিবাদটুকু পর্যন্ত করছেন না। একোন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে চলেছেন আফগানিস্তানের মানুষ? ভারা ইরানকে দেখেও কিছু শিখছেন না। হিজাব পরার সরকারি ফতোয়ার বিরুদ্ধে সেদেশের মহিলারা কেমন লড়াকু ভূমিকা নিয়েছিলেন? উর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত করে প্লাকার্ড হাতে তারা প্রকাশ্য রাজপথে প্রতিবাদে নেমেছিলেন। গোটা দুনিয়ায় সেই দুঃসাহসিক আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। চমকে উঠেছিল বিশ্ব।
ইরানের মতো একটি অভি কট্টর মুসলিম দেশে এভাবেও আন্দোলনে শামিল হওয়া যায়? বিশেষ করে মুসলিম নারীদের পক্ষে? সেদেশের কট্টর ও রক্ষণশীল কড়া ইসলামি আইনও সেই আন্দোলনের গনগনে আগুনকে কিছুমাত্র দমাতে পারেনি। ইরান সরকার তথা পুলিশ-প্রশাসনের ব্যাপক ধরপাকড় সহ কড়া শাস্তির মুখেও আন্দোলনরত নারীরা ছিলেন অনড় অটল। সেদিক থেকে আফগান মহিলারা সবকিছু মেনে ও মানিয়ে নিয়ে চলতেই যেন অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন। ফলে শাসকশ্রেণি আরও বেশি উৎসাহিত।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যাঁরা নারী অধিকার নিয়ে লড়াই আন্দোলন করছেন, তাঁরা এগিয়ে এলে আফগান মহিলারা কিছুটা সাহস পেতে পারেন। ইতিমধ্যে তেমন কোনও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী দেখা যায়নি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা কোনও সংগঠনকে। আসলে যেকোনও ধর্মীয় মৌলবাদ যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেদেশের নারীরা। কারণ নারী অধিকারই লঙ্ঘিত হয় সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর ইতিহাসই তার সাক্ষ্য বহন করছে। আফগানিস্তানই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
একবার ভাবুন তো প্রিয়পাঠক, রামমোহন-বিদ্যাসাগররা এদেশে না জন্মালে কী করুণ ও ভয়ানক পরিস্থিতিই না হতো এদেশের নারীদের? আজও হয়তো সহমরণে যেতে হতো (পড়ুন বাধ্য করা হতো) স্বামীহারা নারীদের। শ্মশান থেকে ভেসে আসতো ঢাক-ঢোল-কাঁসর-শাঁখ ঘন্টার নির্মম আওয়াজ। কিংবা ঘরে ঘরে বানাবিধবাদের সকরুণ অবস্থা আজও চাক্ষুস করতে হতো আমাদের। ভাবলে অবাক হতে হয়, ধর্মীয় অনুশানের নামে কতোটা নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে পারেন তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজপতিরা?
রাষ্ট্রসংঘকেও অবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে আফগান নারীদের ধর্মীয় অনুশাসনের নিগড় থেকে বাঁচাতে। আফগান- নারীরা যাতে কোনওভাবে মানুষের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, মনুষ্যত্ব ও মানবিক অধিকার যাতে কোনওভাবে ক্ষুণ্ণ না হয়, একজন পুরুষ নাগরিকের মতোই যাবতীয় নাগরিক অধিকার নিয়ে সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারেন, সেদিকে তাদের প্রয়োজনীয় ধ্যান দিতে হবে বৈকি। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নারীদের প্রতি এমন বৈষম্য কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায়না।
সম্প্রতি দিল্লিতে আফগান বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাংবাদিক সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের বয়কটের মধ্যেও তাদের নারী বিদ্বেষ যে প্রকট তা আরও একবার প্রমাণিত হলো।
Advertisement



