শীর্ষেন্দু পাল
তাঁতঘর একুশ শতক পত্রিকার ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যাটি সংগীত সংখ্যা। এর আগেও এই পত্রিকার সংগীত সংখ্যা আরও দুটি প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই সংখ্যার ক্রোড়পত্র মাইহার ব্যান্ড। গানপাগল মহীতোষ তালুকদারকে উৎসর্গ করা এই সংখ্যা। ক্রোড়পত্রের বিষয় ছাড়াও সংগীতের বিভিন্ন দিক ধরা আছে এই সংখ্যায়। সূচীপত্র শব্দের বদলে বৃন্দবাদনে কথাটি ব্যবহার করে সম্পাদক যে আলাপ শুরু করলেন শেষ পাতা পর্যন্ত তার বিস্তার চলল। বিশিষ্ট কবি কথাশিল্পী এবং সংগীত চিন্তক বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটা অসাধারণ নান্দীপাঠ আর সেটার সঙ্গে যথাযথ সঙ্গত করে যাওয়া নিটোল সম্পাদকীয়।
Advertisement
সংগীত কী কেন এবং কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনের পরতে পরতে আষ্টেপৃষ্ঠে আছে এই সব কিছুই পাওয়া যাবে এই সংখ্যাটিতে। আর কী সব বিষয়কে দুই মলাটের মধ্যে এনেছেন সম্পাদক! সংগীত জগতের অন্যতম জ্যোতিষ্ক সলিল চৌধুরীর শতবার্ষিকী স্মরণে লেখার পাশেই তালাত মাহমুদের গান ও অভিনয় নিয়ে আলোচনা। কত অজানা তথ্য না উঠে এল দুটি লেখার মাধ্যমে। অংশুমান ভৌমিকের কলম এবং স্বপন সোমের প্রজ্ঞা ঋদ্ধ করবে পাঠককে নিশ্চিত। সংগীত যে সাহিত্য সভার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা রবাহূত কেউ নয় তা চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গৌতম ঘোষ, বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী। বিক্ষোভে বিরহে প্রেমে বা কাজকর্মে কীভাবে গান হয়ে ওঠে সর্বরোগহরা বিশল্যকরণী তা বলেছেন পবিত্র সরকার। রবি ঠাকুরের গান নিয়ে পড়াশোনা করতে হলে যে নামটা অবধারিতভাবেই এসে যায় সেই দিনু ঠাকুরের নিজস্ব গান সুর এবং স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কেমন করে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন সংগীতের ধারাকে তা দেখিয়েছেন ঋত্বিক মল্লিক।
Advertisement
অর্থনীতিবিদ সুগত মারজিত যে আদতে শিল্পী এবং নিয়মিত সংগীত চর্চা করেন তা খেয়াল রেখে সম্পাদক তাঁকে দিয়ে বাংলা খেয়ালের উপর মনোগ্রাহী পর্যালোচনা লিখিয়েছেন। কোন বিষয়টি কাকে দিয়ে লেখালে সমীচীন হবে সেটার ব্যাপারে যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন সম্পাদক। ভারতের পেশাদার মহিলা শিল্পীদের উপর মীনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতে একেবারে কালানুক্রমিক পরিবর্তন, অবহেলা থেকে সম্ভ্রম প্রাপ্তির পথে উত্তরণ কেমন করে হয়েছে ভারতীয় সংগীত বিদূষীদের তা বর্ণনা করেছেন। তাওয়াইফদের নিয়ে মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ তাঁতঘর একুশ শতককে নিশ্চিত ভাবেই একটা স্পর্ধার উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পদ্মবিভূষণ প্রভা আত্রের কাছে তালিম নেওয়া গায়িকা বাসবী মুখোপাধ্যায়ের লেখনীতে উঠে এসেছে প্রভাজীর গায়কী, ব্যক্তিগত জীবন যাপন এবং কর্ণাটকই রাগ রাগিনীতে অসামান্য দখলের কথা। এর পাশাপাশি পন্ডিত ধ্রুবতারা যোশীর সুযোগ্য ছাত্রী তাপসী ঘোষের লেখায় পণ্ডিতজির সংগীত শিক্ষা ও শিক্ষকতার কথা থেকেই জানতে পারা যায় গুরু শিষ্য পরম্পরা ধরে রেখে কীভাবে তিনি সংগীত সাধকের জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। বিশিষ্ট সংগীত চিন্তক রন্তিদেব মৈত্র দীর্ঘদিন সাহচর্য পেয়েছিলেন ধ্রুপদিয়া শিবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের। সেই স্মৃতিচারণের সঙ্গেই শিবকুমার বাবুর ধ্রুপদী সংগীতচর্চার পাশাপাশি সমকালীন অন্যান্য ধ্রুপদীয়া যেমন নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ রঞ্জন দে প্রমুখের কথা উল্লেখ করেছেন। এর পাশাপাশি শিববাবুর সঙ্গীতের শৈলী ও প্রকার নিয়োগ রয়েছে আলোচনা। অমিতাভ চৌধুরীর লেখা ছড়া এবং কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের আঁকা ছবি দিয়ে শুরু হয়েছে ওস্তাদ জাকির হোসেনের উপর লেখাগুলি। বিশিষ্ট তবলাশিল্পী রূপক ভট্টাচার্যর লেখা থেকেই জানা যায় যে সঙ্গত করার পরিধি ছাড়িয়ে তবলার যে নিজস্ব জগৎ তৈরি করেছিলেন ওস্তাদ জাকির হুসেন তা সারা বিশ্বে অভিকর শিল্পে একটা নতুন দিশা দেখায়। সুদূর দার এস সালামের ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মরত ওখানকার স্বামী বিবেকানন্দ কালচারাল সেন্টার-এর কালচারাল ডাইরেক্টর সুরজাত রায় লিখেছেন ওস্তাদ জাকির হোসেনের জীবন, মৌলিক ঘরানা সৃষ্টি এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার মাধ্যমে তবলাকে accompanying instrument থেকে celebrated solo voice করে তোলার কথা।
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে একেবারে আধুনিক সময় পর্যন্ত চলচ্চিত্রে সংগীতের ব্যবহার এবং তাতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণ মধুজা মুখার্জীর আলোচনায় এসেছে। গবেষকদের তো বটেই প্লেব্যাক সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসু সাধারণ পাঠকেরও ক্ষুধা নিবৃত্তি করবে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মধুজা মুখার্জির লেখা Sound Voice Technologies: the transforming frames of Indian Film Music এই পত্রিকার মান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সঙ্গীতা পণ্ডিতের তত্ত্বাবধানে নিবেদিতা শ্যামের প্রবন্ধটি হিন্দুস্তানি রাগবৈচিত্র্য এবং সেই সমস্ত রাগ গাইবার বা সাধনার সময় নিয়ে লেখা। এই লেখাটিও ইংরেজিতে।
সংগীত বিষয়ক বইয়ের আলোচনাতে ঠাঁই পেয়েছে আব্দুল কাফির সম্পাদনায় ‘দূরের মাদল’ শীর্ষক সংকলনের উপর আলোচনা। করেছেন সুতপন চট্টোপাধ্যায়। সনাতন কীর্তনের রুপরেখা ধরে লিখিত প্রীতম বসুর উপন্যাস ‘প্রাণনাথ হৈও তুমি’-র ব্যাপারে মনোজ্ঞ প্রবন্ধটি অরুন্ধতী আশের। শ্রমের গান শীর্ষক লেখায় অরূপ চক্রবর্তী আলোচনায় তুলে এনেছেন দুটি বইয়ের কথা। ‘ছাদ পেটানোর গান’ এবং ‘নারীর গান শ্রমের গান’ বইদুটির মধ্যে শ্রমজীবী মানুষদের মুখের গান কেমন ভাবে সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চার অঙ্গ হয়ে গেছে তা দেখিয়েছেন লেখক।
ক্রোড়পত্র ‘মাইহার ব্যান্ড’ সম্পর্কে লিখেছেন দশজন ব্যক্তি। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাইহার ব্যান্ড কীভাবে প্রকৃত সংগীত সাধকের পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল তা বলেছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের লেখাটি তথ্যের আকর। এই সমবেত বাদ্যবৃন্দতে ব্যবহৃত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র এবং সুর নিয়ে বা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছিলেন বাবা আলাউদ্দীন খাঁ এবং উদ্ভাবন করেছিলেন নলতরঙ্গ বাদ্যযন্ত্রের তা আলোচনা করেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে পুনর্মুদ্রিত অজয় বিশ্বাসের স্মৃতিকথনটিও বেশ সুখপাঠ্য। অনাথ শিশুদের নিয়ে বাবা আলাউদ্দীন খাঁ বৃন্দবাদনের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। সমবেত বাদন যে ভারতীয় সংগীতেও সম্ভব তা বাবা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেব অনাথ শিশুদের তালিম দিয়ে ভারতীয় সংগীতে বাস্তবায়িত করেছিলেন। বিদেশে গিয়ে সেখানকার সংগীতচর্চার বিষয়গুলিকে আহরণ করে কেমন ভাবে সমবেত বাদনে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন তা লিখেছেন পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই লেখাটি ‘হরপ্পা’র প্রথম সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত। পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী মাইহার ব্যান্ড নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এক অসামান্য স্মৃতিচারণ ও অজানা তথ্যের উপচারে সাজানো তাঁর লেখাটি। সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত মাইহার ব্যান্ডের যে উত্থান ও চলন তা ধরা পড়েছে দুইজনের লেখায়— স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত এবং ইরানী বিশ্বাস। চলচ্চিত্র পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের লেখা যেন মাইহার ব্যান্ডের আঁতুড়ঘরে এক মানসভ্রমণ। চোখের সামনে তিনি জীবন্ত করে তুলেছেন বাবা আলাউদ্দীন খাঁয়ের আস্তানা। মধুবন চক্রবর্তীর লেখাতে মাইহার ব্যান্ডের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটা আশঙ্কার চিত্র ফুটে ওঠে এবং এই ব্যান্ডের পরম্পরা ধরে রাখার জন্য সরকারি প্রয়াসের যে দরকার তা তিনি লিখেছেন। সম্পাদক চমকে দিয়েছেন অশোক কুমার বাধোলিয়ার লেখাটি রেখে। লেখক নিজে মাইহার ব্যান্ডের বাদক। ফলে ইংরেজিতে লেখা তাঁর স্মৃতিচারণটি নিঃসন্দেহে পাঠের দাবী রাখে।
সমস্ত পত্রিকা জুড়ে বাদ্যযন্ত্রের সুন্দর চিত্রাঙ্কনগুলি করেছেন শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত, কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত, শ্যামলবরণ সাহা, বিশ্বদীপ দে, মুক্তিরাম মাইতি ও মধুমন্তী মুখোপাধ্যায়। চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন মুক্তিরাম মাইতি। তাঁতঘর একুশ শতকের সংগীত সংখ্যা এক কথায় অবশ্যপাঠ্য। পত্রিকার প্রতি পাঠকের এবং যাঁরা এই পত্রিকার বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁদের প্রত্যাশার পারদ বাড়িয়ে দিল, বলাই যায়।
তাঁতঘর একুশ শতক,
সংগীত সংখ্যা (ডিসেম্বর, ২০২৪)
সম্পাদক : অরূপ আস
মূল্য – ৩৭০ টাকা
Advertisement



