• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা

গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন (১৮৯৯-১৯০৫) ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিস অ্যাক্ট পাশ করে অধিক সংখ্যক ইউরোপীয়দের নিয়োগের সংস্থান করেন।

বিমলকুমার শীট

ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৮৬৪-১৯২৫) এক স্মরণীয় নাম। উচ্চশিক্ষা বিস্তারের কাজে তিনি জীবনের সর্বাধিক সময় ব্যয় করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি কাঠামো ভেঙে তিনি তাকে যুগের উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি প্রথম পর্যায়ে ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯২১-১৯২৩ সাল পর্যন্ত দশ বছরকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য থেকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। এক কথায় সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বৎসরকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি এক জীবনদাত্রী শক্তিরূপে বিরাজ করেছিলেন। অপর দিকে ১৯০৩ সাল থেকে ১৯২৪ সাল অবধি কুড়ি বৎসর তিনি কলকাতা হাইকোর্টে অন্যতম বিচারপতি হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

Advertisement

ছাত্র অবস্থা থেকেই আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। তাঁর পিতা ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ (১৮৩৬-১৮৮৯) ও ছোট ভাই রাধিকাপ্রসাদের ১৮৮১ সালে সিনেটের সভ্য হওয়ার প্রস্তাব হয়। কাজকর্ম খুব বেশী থাকায় গঙ্গাপ্রসাদ সভ্যপদ গ্রহণ করলেন না। রাধিকাপ্রসাদ সিনেটের ‘ফেলো’ হলেন। তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কাগজপত্র, ‘মিনিটস’ প্রভৃতি আসতে থাকে। আশুতোষ সেই সব কাগজপত্র, মিনিটস নিভৃতে বসে এক মনে পড়তেন। সেই নীরস তথ্য ও বিবরণী পড়তে তাঁর বিন্দুমাত্র বিরক্তি বা ক্লান্তিবোধ হোত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মের বিধিনিয়মাবলীর সঙ্গে এইভাবেই হয় আশুতোষের প্রথম পরিচয়। তাঁর বয়স তখন ষোল বছর মাত্র। ইতিমধ্যে তিনি পরীক্ষায় পাশ করেছেন। ১৮৮৫ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ভাইস চ্যান্সেলর সিপি ইলবার্ট (১৮৮৬) তাঁর ভাষণে আশুতোষের প্রশংসা করলেন। পরের বছর মি. ইলবার্ট আশুতোষকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর জন্য কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আশুতোষ বিনীতভাবে জানান, আপনি ইচ্ছা করলে আমার অনেক উপকারই করতে পাবেন, কিন্তু আমি অন্য কিছু চাই না, দয়া করে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য করে দিন। ইলবার্ট সম্মতি জানিয়ে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ করে দেওয়ার কথা বললেন। কিন্তু তিনি ইংলণ্ডে চলে যাওয়ায় এবং অনেকে আশুতোষের বিরোধিতা করায় সে সময় তিনি সিনেটের সদস্য হতে পারলেন না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। ১৮৮৯ সালের ৩০ মার্চ আশুতোষ মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হলেন।

Advertisement

তারপর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে স্বাধীনচিত্তে সর্বতোভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলো’ হওয়ার কিছু পরেই একটি ঘটনায় তা প্রতিফলিত হয়। ১৮৯১ সালে জানুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রথম ভারতীয় ভাইস চান্সেলর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯০-১৮৯২) তাঁর ভাষণে মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন ও আবশ্যিক পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে সেই বছর ১ মার্চ আশুতোষ বিশ্ববিদ্যালয়ে একখানি চিঠি দিয়ে প্রস্তাব পাঠান, এণ্ট্রান্স থেকে এমএ পর্যন্ত সব পরীক্ষাতেই বাংলা-হিন্দি-উর্দু ভাষাও অন্যতম পরীক্ষণীয় বিষয়রূপে গ্রহণ করার ব্যবস্থা হোক। এই প্রস্তাবের আলোচনার জন্য ১১ জুলাই আলফ্রেড ক্রফটের সভাপতিত্বে Faculty of Arts-এর এক সভা হয়। সেখানে আশুতোষ প্রস্তাব উত্থাপন করলে মাসিক ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’র সম্পাদক উমেশচন্দ্র দত্ত তাঁকে সমর্থন করেন। সভায় প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা হয়। সাহেবরা ও তাঁদের সমর্থকরা বলেন, বাংলা একটা ভাষা নাকি? বাংলা ভাষায় পড়বার বই কোথায়? বাংলার আবার পরীক্ষা?

মুসলিম সদস্য ও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতরা বাঙলার বিরোধিতা করেন। আশুতোষ তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে এক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করেন এবং এই প্রস্তাব দেশের পক্ষে, জাতির পক্ষে, বাংলা ভাষার পক্ষে কী রকম কল্যাণকর ও একান্ত প্রয়োজন, তা বুঝিয়ে দেন। কিন্তু তাতে কোনও ফল হল না। কর্নেল জ্যারেট আশুতোষের বক্তৃতার ভূয়সী প্রশংসা করলেও তিনি নিজের অভিমত দিলেন আশুতোষের বিপক্ষে। তবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রনাথ বসু, মহেন্দ্রনাথ রায়, আনন্দমোহন বসু, ডা. ম্যাকডোনাল্ড এবং পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ মাত্র এগারজন সভ্য আশুতোষের মাতৃভাষা প্রবর্তনের প্রস্তাব সমর্থন করেন। তাতে আশুতোষ কিন্তু তাঁর উৎসাহ হারাননি । তিনি বুঝেছিলেন, বাংলা ভাষার যে দৈন্যের জন্য তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখান হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের পরীক্ষায় বাংলার স্থান না হলে, সে দৈন্য ঘোচারও সম্ভাবনা নেই।

গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন (১৮৯৯-১৯০৫) ১৯৪০ সালে ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিস অ্যাক্ট পাশ করে অধিক সংখ্যক ইউরোপীয়দের নিয়োগের সংস্থান করেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই নিয়োগের বিরোধিতা করেন কিন্তু এই আইনের প্রত্যেকটি ধারার বিরোধিতা করেননি। ইম্পিরিয়াল লেজিসলেচার গোপালকৃষ্ণ গোখলে কর্তৃক উত্থাপিত ‘আবশ্যিক প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত বিল’ও তাঁর অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয়। ১৯০৬ সালে আশুতোষই নতুন আইন অনুসারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পদে নিযুক্ত হন। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একজন বিচক্ষণ পরিচালক ও সুযোগ্য শিক্ষাবিদের হাতে ক্রমে ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। সেই সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিছক পরীক্ষা গ্রহণের সংস্থার পরিবর্তে উন্নত মানের পঠন-পাঠনের কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। শুধুমাত্র বিদেশি ভাষা শিক্ষাদানের স্থলে এখানে জ্ঞানের সার্বিক শাখায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয় এবং ‘বিমাতার কক্ষে’ মাতৃভাষার সম্মানজনক স্থান লাভ সম্ভব হয়। তাঁর পদাধিকারকালেই মাতৃভাষায় জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে বিধিনিয়ম রচিত হয়।

স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যায়ন এবং গবেষণার জন্য কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়। বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখায় প্রশিক্ষণের জন্য মেধাবী ছাত্রদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। ব্যবহারিক দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখে চিকিৎসাশাস্ত্র এবং আইন অধ্যয়ন সংক্রান্ত শিক্ষাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পূর্বে গবেষণা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনওরকম ব্যবস্থা ছিল না। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ব্যতিরেকে বিশ্ববিদ্যালয় অসম্পূর্ণ, এ সম্পর্কে তিনি দৃঢ় মত পোষণ করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে গবেষণা প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলা এবং এই বিষয়ে তাঁদের আনুকূল্য করার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সার্থকতা। আমাদের এই বিদ্যাপীঠ সকলরকম গবেষণার পথ প্রশস্ত করে দেবে— ইহাই আমার অভিপ্রায়।’ শিক্ষার উন্নত মাননির্ণয়ক সূচক— গবেষণার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মৌলিক গবেষণার জন্য ডক্টরেট অফ ফিলসফি এবং ডক্টরেট অফ সায়েন্স ডিগ্রি প্রদানের প্রথা প্রবর্তিত হয়। গ্রন্থাগার ও গবেষণা সংস্থাসমূহও প্রবর্তিত হয়। ১৯১৪ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন সেই সময়ের মধ্যেই ভারতীয় জীবন এবং কৃষ্টির ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় এক বাস্তবোচিত ও অভিনব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহণ করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ষোলআনা কৃতিত্ব আশুতোষ মুখোপাধ্যেয়ের।

Advertisement