• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

উমা নিরঞ্জনে ব্রহ্মপুত্র নদীর লাসিতঘাটে দর্শনার্থীদের ঢল

বাঙ্গালীদের পুজোর সংখ্যা অধিক হলেও নেপালি, বিহারী, মারোয়াড়ি ও অন্যান্যদের প্যান্ডেলে নবরাত্রি পুজো হয়ে চলেছে প্রথমা থেকেই ।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

হিমাংশু শেখর গুহ

আসাম ও মেঘালয়ের সর্বত্রই দেবী নিরঞ্জন এর এক অনন্য রূপ নজরে পড়ে, আসামিস বাঙালি সকলেরই যেমন ‘সিঁদুর খেলাটা’ পরম্পরাগত হলেও কাতারে কাতারে লাইন দিয়ে সিঁদুর নিবেদন এক একটা প্যান্ডেলের হাজারো মহিলার শক্তিরূপী উমার প্রতি শ্রদ্ধার কথা বলে। আবার পুরুষদের গালে সিঁদুর পরানো আনন্দের উচ্ছাস। আসামের প্রতিটি অঞ্চল সুচারু পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যে নিরঞ্জন যাত্রায় আবিরের ছড়াছড়ি, জুবিন গর্গের গান, ঢাকের তালে মহিলা সহিত সকলের নৃত্য, সারিবদ্ধ পুজো কমিটিগুলির সময়সীমার মধ্যে যাত্রা বা কাতারে কাতারে কয়েক কিমি ধরে ব্রহ্মপুত্র ঘাট অবধি রাস্তার দু’ধারে মায়ের শেষ দর্শনের প্রতীক্ষায় আবাল বৃদ্ধ মানুষের ভিড় যেন শ্রদ্ধার বার্তা দিয়ে যায় তা সে পাণ্ডব ৭৭তম রেলস্ট্যান্ড দুর্গাপূজা কমিটি, জয় হিন্দ ক্লাবের ৭৮তম শ্রী শ্রী সার্বজনীন দুর্গাপুজো বা রামকৃষ্ণ মিশন দুর্গাপুজো, ভারত সেবাশ্রম ও ভাস্কর নগর দুর্গাপুজো সমিতি হোক না কেন প্রায় প্রতিটি পুজোয় এখানে বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে করতে দেখা যায় চার দিন আসাম থেকে মেঘালয় সর্বত্রই নবরাত্রি পূজোর বিশেষ ব্যবস্থা দেখা যায়।

Advertisement

২০২৫ এর কলকাতায় যখন জলে ভিজে কিছু প্যান্ডেলের উদ্বোধন, ঠিক তখন পাহাড়-পর্বত নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা অসমের প্রায় চার হাজারেরও বেশি দুর্গাপুজোয় এক করুন আনন্দের মধ্যে প্রতিটি পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন তৃতীয় থেকেই। কিন্তু প্রতিবারের আনন্দ উদ্যমের মাঝে দেখা যায় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, রাস্তার দেওয়ালে, ক্লাবে ক্লাবে, অফিস কার্যালয়ে, ঘরে ঘরে ছবিতে ছবিতে এক নিরব শোকের ছায়ায় বিষাদের অনুভূতি সদ্য সংগীত জগত খ্যাত ‘জুবিন গর্গের আকস্মিক বিয়োগ স্মরণে’। প্রথমেই অসমের বড় পুজো বলতে রেস্ট ক্যাম্প কালিবাড়ির ৭৭ তম দুর্গাপুজোয়। ৬০ লক্ষ টাকার বাজেটে ‘ময়ূর মহল’ থিমে ও চন্দননগরের লাইটে, পঞ্চমীতেই স্থানীয় উদ্যোক্তা অসীত মোহন রায়, এনএফ রেলের জিএম এবং এমপি ভুবনেশ্বর কলিতার হাতে উদ্বোধন, সপ্তমীর সকাল থেকেই অগুনতি ভিড় অঞ্জলি দিতে, বেলা একটার থেকে সকলের জন্য প্রসাদ গ্রহণ চললো অষ্টমী নবমী দশমী।

Advertisement

আবার গৌহাটির পান্ডুর জয় হিন্দ ক্লাব এর ‘শ্রী শ্রী সর্বজনীন দুর্গাপূজা’ ১৯৪৭ থেকে হয়ে আসা ৭৮তম এক নতুন থিমে মডার্ন আর্কিটেকচারের সঙ্গে ট্র্যাডিশনালের সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা, থিম বুর্জ খলিফা আদলের প্যান্ডেল জানালেন রাজা দে এবং শুভঙ্কর দে । এখানকার বিশেষত্ব প্রতিবছর অগুণতি গরিব বস্ত্রহিনাদের বস্ত্রদান তবে এ বছর প্ল্যানটেশনের চিন্তাধারা।এছাড়াও হনুমান সিনেমার আদলে থিমের প্যান্ডেল ৩৬লক্ষ বাজেটের ভাস্করনগর দুর্গাপূজা সমিতির ৫৬ তম পূজো, অষ্টমী নবমী পাঁচ হাজার ভক্তের প্রসাদ গ্রহণ ও দেখা গেল প্রতিদিন জনস্বার্থে বিশেষ ব্যবস্থা মিনিমাম প্রাইসে ৫০ টাকার বিনিময়ে নিত্যনতুন খাবার হতদরিদ্রের সেবায়। ষষ্ঠীর সন্ধ্যা থেকেই হয়ে চলেছে পাশের মঞ্চে জুবিন গর্গের স্মরণে স্থানীয় অরকেস্টার গান।

তবে এ দৃশ্য প্রায় প্রতিটি প্যান্ডেলেই। এছাড়াও রিভার সাইড স্পোর্টিং ক্লাব, সুভাষ সংঘের দুর্গা পুজো, ভৈরবী মহিলা সমিতি সারদা সংঘের দুর্গাপুজো কাহিলীপাড়া বা বর্ষাপাড়া সর্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রায় একই দৃশ্য সকাল থেকেই বেলা বারোটার পর অঞ্জলি। টেম্পল ঘাটের নব যুবক সংঘ, সিনিয়র সুপারিনটেনডেন্ট অফ রেলওয়ে পুলিশ পান্ডু দুর্গাপুজো ও অন্যান্য আরো পাঁচশতর অধিক দুর্গাপুজোয় দেখা যায় বঙ্গের পুজো থেকে কোন অংশেই কম নয়। তবে রামকৃষ্ণ মিশন, উলুবারি দুর্গাপুজোয় দেখা যায় এক অনন্য চিত্র, সপ্তমীর সকাল থেকে ভিড় অঞ্জলি দিতে প্রতীক্ষায় ভক্তবৃন্দ আবার দুপুরের প্রসাদ খিচুড়ি বিতরণের সুচারু ব্যবস্থা। অষ্টমীতে বিশেষ কুমারী পূজো অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। অন্যদিকে সারদা সংঘের ভৈরবী মহিলা সমিতির জল বিতরণ স্টল, অন্যদিকে মাইকে হয়ে চলেছে স্বামীজী দিব্যাব্রতানন্দ মহারাজের কন্ঠে ‘ভালোবেসে হেঁসে হেঁসে ওই মা এসেছে …’ গান। সেখানেই বসে থাকা ৮২ বছরের মায়া রানী সেন ভোগ প্রসাদ গ্রহণের পর পান চিবোতে চিবোতে জানান ‘প্রতিবছর আসি, ভালো লাগে সকলের মাঝে ভক্তির পরিবেশে’। এদিকে ভারত সেবাশ্রম গৌহাটির পুজোয় বিধিসন্মত প্রতিদিন সকাল থেকে চণ্ডীপাঠ স্বামীজী শংকরানন্দ মহারাজের কন্ঠে,দুপুরে অঞ্জলি ভক্তদের ও ভোগ প্রসাদ গ্রহণের পর একটু অবসর।

ওদিকে মহাষ্টমীর সকাল থেকেই দেবী দুর্গার ঘরোয়া পূজোর আড়ম্বরে ব্যস্ত সুমনবাবুর ঘরের সকলে। সন্ধ্যায় হয় আরতি ।

ওদিকে মেঘালয়ের শিলং এ পর্যটকদের ভিড় থাকলেও দুর্গাপুজোয় এই ছোট্ট রাজ্যের শুধু শিলং এ প্রায় ৫৭ টা দুর্গাপুজো। বাঙ্গালীদের পুজোর সংখ্যা অধিক হলেও নেপালি, বিহারী, মারোয়াড়ি ও অন্যান্যদের প্যান্ডেলে নবরাত্রি পুজো হয়ে চলেছে প্রথমা থেকেই । উল্লেখনীয় দুর্গা পুজো ইস্ট খাসি হিলস ডি ই এফ পুলিশ রিজার্ভ ও নেপালি দুর্গাপূজা কমিটি পোলোর, আবার শিলং এরই শিলং হিন্দু ধর্ম সভার ১২৫ তম দুর্গাপুজো জগন্নাথ মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের কথায় দুর্গা ভক্তি তরঙ্গিনী গ্রন্থ অনুযায়ী দুর্গাপুজো। শিলং এর ঠান্ডা লাগা কন্ঠে সম্পাদক দীপক পাল ও অজিত ঘোষ জানালেন আমাদের চার দিনের পুজো প্রতিটি জাতি সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে ও সহযোগে পূর্ণ হয়ে থাকে। ওদিকে শিলঙের জেল রোড ১২৩ তম দূর্গা পূজা কমিটি মহিলারা পঞ্চমীতে লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে পালকিতে ও হাতে হাতে কলস নিয়ে চলেছে জল আনতে। ঝরনার জল মন্ডপে স্থাপনে।একই প্রথা সর্বত্র।সভাপতি জানান সকল জাতি সমন্বয়ের উপস্থিতির কথা।

এছাড়াও শিলংয়ে প্যান্থো উমুখরাহো দুর্গা পূজা কমিটি, মিলন সংঘের দুর্গাপূজা, মপ্রেমের হিন্দু মিশন দুর্গাপূজা, মাতৃমন্দির শারদোৎসব,লাইটু মকরার রামকৃষ্ণ মিশন দুর্গাপুজো, পুলিশ বাজারের ভারত সেবাশ্রমের দুর্গাপুজো ও অন্যান্য প্রতিটি শিলং পুজোয় উলু ধ্বনি, শঙ্খ, ঢাক ও কাঁসার তালে তালে ষষ্ঠীর সকাল থেকেই শক্তিরূপী দেবী দুর্গার বরণ,বোধন ও প্রতিদিন পুজো অঞ্জলীতে মেতে ওঠে।আবার লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে দেখা যায় মেঘালয়ের রিল বং এর স্বামী হৃদকামানন্দ মহারাজের হাতে উন্মোচিত ৯৯তম দুর্গাপূজা সমিতির সুদিপ্তা ভট্টাচার্য ও দেবী করের সঙ্গে, বলেন- ‘প্রথমা থেকেই হয়ে চলেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘আগমনী’, প্রতিযোগিতা, আলপনা বা ডান্ডিয়া ইত্যাদি।’ এখানেই বিশেষ প্রতিটি প্যান্ডেল ঢাকিকে নিয়ে প্রতিযোগিতা। মেঘালয়ে দুর্গাপুজো মানে লাইটিং,প্যান্ডেলের থিম নয় ছোটদের প্রেরণা দিতে প্রতিদিন প্রতিযোগিতা, সংগীত, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,প্রসাদ বিতরণ আর আনন্দে ভরিয়ে দেওয়ার পরিবেশ।আসাম ও মেঘালয় দুই রাজ্যেই পূজো সম্পন্ন শক্তিরূপী দেবী দুর্গার প্রণাম মন্ত্রে মন্ত্রে এই কটা দিন- ‘নমঃ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী, দুর্গা শিবা ক্ষমাধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্ততে।।’

Advertisement