রম্যাঁ রলাঁ
পূর্ব প্রকাশিতর পর
Advertisement
স্বাধীন বুদ্ধিজীবী হিসাবে আমাদের কর্তব্য এই নৈতিক শক্তিগুলিকে রক্ষা করা; প্রয়োজন হইলে এমন কি বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াও রক্ষা করা; প্রয়োজন হইলে এমন কি বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াও রক্ষা করা। কারণ বিপ্লবের জন্যই ইহাদের প্রয়োজন। ইতিপূর্বে ক্লেরাঁবোল পুস্তকে আমি বলিয়াছি, ‘‘সবার বিরুদ্ধে একের অর্থই সবার জন্য এক। এই একের কর্তব্য সংগ্রামের উন্মাদনার মধ্যে ধ্বংসের হাত হইতে সর্বমানুষের সম্পদকে রক্ষা করা।’’
Advertisement
১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমার জবাবে আমি খানিকটা উল্লাসের সঙ্গেই বিপ্লবের শিবিরে আমার স্থান করিয়া লই। এই বিপ্লবের শিবিরে আমার প্রবেশ তাহারা বন্ধ করিয়া দিতে চাহিতেছিল। আমি বলিলামঃ ‘‘তোমার সহিত যাহার চিন্তার ও মতের মিল নাই বিপ্লবের মধ্যে তাহার স্থান নাই, তোমাকে এ বিধান দিবার অধিকার কে দিল? বিপ্লব কোনো বিশেষ দলের সম্পত্তি নহে। যে মানুষই বৃহত্তর ও মহত্তর ভবিষ্যতকে কামনা করে—বিপ্লবের শিবিরে সেই স্থান পাইবে। আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যাহারা বিপ্লবের মধ্যে থাকিতে চাহেন স্বাধীনভাবে।’’ এইখানে আলোচনার ক্ষেত্র বিস্তৃত হইয়া পড়িল। রম্যাঁ রলা এখন আর নিজের জন্য কথা বলিতে ছিলেন না। তাচ্ছিল্য করিয়া যাহাদের রলাঁপন্থী বলা হইত তাহাদের সকলের হইয়াই তিনি কথা কহিলেন। চিন্তার স্বাধীনতাকে অটুট ও অক্ষুণ্ণ রাখার অধিকার এবং শুধু অধিকার নহে, কর্তব্য বলিয়া যাহারা দাবী করেন, তাহাদের সকলের পক্ষ লইয়া তিনি দাঁড়াইলেন। কারণ, ‘‘যে চিন্তাধারা কোনো দলের পায়ে আত্মবিক্রয় করিয়া নিজের স্থান পরিত্যাগ করে তাহার কি মূল্য আছে।’’
কেবলমাত্র রাশিয়া ছাড়া সমগ্র ইউরোপ সম্পর্কেই আমার চিঠির শেষাংশে গভীর হতাশার অভিব্যক্তি ছিল। ঐ কয়েকমাস আমার ডায়েরীতে এই হতাশা আরও পরিষ্কারভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। ঐ সময়টাতে আমি যেন ভবিষ্যদদর্শনের একটা মর্মান্তিক ক্ষমতা লাভ করিলাম। অত্যন্ত স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম মুষ্টিমেয় পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদের যুগ পৃথিবীকে গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছে। দেখিলাম স্বার্থপর ঔদাসীন্যের ফলে ফ্রান্সে আসিতেছে চরম সংকটের দিন। ভীষণ ভবিষ্যৎকে এত স্পষ্টভাবে দেখা সত্ত্বেও ভবিষ্যতে বিশ্বাস আমার শিথিল হইল না; বর্তমানের গণ্ডী ছাড়াইয়া আমাদের কর্মক্ষেত্র আমি প্রসারিত করিয়া চলিলাম। আমাদের প্রস্তাবিত কর্মসূচী প্রকাশ করিতে বারবুস্ আমাকে অনুরোধ জানাইয়াছিলেন, উত্তরে দুইটি মূল বিষয় তাহাকে জানাইলামঃ
(১) ইউনিয়ন অব ডেমোক্রেটিক কন্ট্রোল সঙ্ঘের বীর বন্ধুগণের মত শাসকশ্রেণীর কার্যাবলীর পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ পরীক্ষা করা ও নির্ভীক অভিমত ব্যক্ত করা; ভলতেয়ার ও এনসাইক্লোপিডিস্টদের তিক্ত বিদ্রূপ ও নিষ্ঠুর সমালোচনার ঐতিহ্য অনুসরণ করিয়া সর্বপ্রকারের কলঙ্ক রটনাকে নির্মমভাবে আঘাত ও আক্রমণ করা। এই দুই ব্যাপারে নিরলসভাবে সমস্ত আত্মিক শক্তি প্রয়োগ করিয়া সংগ্রাম চালান।
(২) অহিংস প্রতিরোধ। (ইহা নূতন, আমার বিশ্বাস ফ্রান্সে সাধারণ আলোচনায় গান্ধীর নাম এই সর্বপ্রথম, আমি তখন গান্ধীর জীবনী লিখিতেছি) অহিংস প্রতিরোধ বলিতে আমি ‘‘প্রতিরোধহীনতা’ বুঝাইতে চাহি নাই। পরন্তু বলিতে চাহিয়াছিলাম ইহাই চরম প্রতিরোধ, পাপসক্ত রাষ্ট্রের সহিত সহযে়াগিতা করিতে তাহার ইচ্ছা পূরণ করিয়া চলিতে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি।
কেবলমাত্র আত্মিক বল ও বিবেকনিষ্ঠার সাহায্যে এই অস্ত্র কার্যকরী হইতে পারে, সমাজসংগ্রামে এই অস্ত্রের যথোপযুক্ত মূল্য স্বীকার না করিবার জন্য বারবুস ও তাহার বন্ধুদের আমি তিরস্কার করি। আমি লিখি, ‘‘সমষ্টিগত শক্তি লইয়া তোমরা এতদূর মাতিয়া আছ যে, ব্যক্তিগত বিবেকের উপযুক্ত মূল্য দিতে চাহ না। অবশ্য সমষ্টিগত শক্তির যে ভীষণ আকর্ষণ আছে তাহা কাহারও অপেক্ষা আমি কম জানি না।
(ক্রমশ)
Advertisement



