কুমারেশ চক্রবর্তী
উত্তমকুমারের বাড়ি। ময়রা স্ট্রীট। বসে আছি। আমি, সঙ্গে পঞ্চাদা মানে শ্রীপঞ্চানন। হ্যাঁ, সত্যিই উত্তমকুমারের বাড়ি! বসে আছি প্রায় ১৫ মিনিট। টুকটাক কথা বলছি। তবে আমার চোখ এই ঘরের সমস্ত কিছু সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। একবারও বিরক্ত মনে হয়নি, কারণ এই ঘরের সবকিছুই দেখার মত। বিশাল রাজকীয় সাজ সজ্জা নেই, ছিমছাম রুচি সম্মত ব্যবস্থা। ভেতরের দিকে দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রথম স্থানটি উত্তমকুমারের নির্দিষ্ট সোফা। তার সামনে একটা টেবিল, সেই টেবিলের পেছনে একটি তিন জনের বসার সোফা,সোফার ডানদিকে ও বাম দিকে একটি করে সিঙ্গেল সোফা। কিছুটা দূরে আর একটা বড় সোফা, একেবারে পেছনদিকে দেয়াল ঘেসে একটা লম্বা বেঞ্চের মত সোফা। আমরা বসে আছি উত্তমকুমারের একেবারে সামনের সোফায়। বলে রাখা ভালো এখানে কেউ তার নিজের ইচ্ছে মত জায়গায় বসতে পারেন না। এই ঘরের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি তাকে নিয়ে যেখানে বসাবেন তাকে সেখানেই বসতে হবে, এটাই অলিখিত নিয়ম। স্বাভাবিকভাবে উত্তমকুমারের সামনের সোফায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বসেন, যেটায় আমরা বসে আছি। দেখলাম একেবারে দেয়াল ধারে শেষ সোফায় চারজন বসে আছেন যার মধ্যে এক যুবতী। আরো লক্ষ্য করলাম এই ঘরের দায়িত্বে যিনি তিনি কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর মাঝে মধ্যেই দেয়াল ধারের শেষ সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিদের কাছে যাচ্ছেন এবং তাদের হাতে একটা করে খাম তুলে দিচ্ছেন। তারা যথারীতি চলে যাচ্ছেন। এইভাবে চারজনেই চলে গেলেন, শেষে গেল মেয়েটি। তার কিছুক্ষণ পরেই মহানায়কের আবির্ভাব, যেন স্বর্গ থেকে নেমে এলেন দেবদূত। পরনে ঘরোয়া পোষাক হাতে সিগারেট। তিনি আসতেই আমরা সকলেই উঠে দাঁড়ালাম, তিনি হাতজোড় করে বললেন, বসুন বসুন উঠে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই। তারপরেই পঞ্চানন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, পঞ্চাদা বুকলেটটা তৈরি হয়ে গেছে? উত্তরের অপেক্ষা না করেই হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হাতে একটা চিরকুট দেখে বললেন, আপনি কুমারেশ– ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি! তার পরেই হঠাৎ পেছনের সোফার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে তার সহকারীকে ডেকে বললেন, ওই মেয়েটি চলে গেছে? চলে গেছে শুনে আবার খুব উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ও হো ওর বাবা কেমন আছেন জানা হলো না– তোরা খবর নিয়েছিস?
সহকারী বলল, না জিজ্ঞেস করা হয়নি।
— কি যে করিস তোরা, জানিস উনি কি বিখ্যাত শিল্পীর মেয়ে? আজকে এই অবস্থা এককালে আমরা ওনার বাবাকে প্রণাম জানাতাম– — দেখি আমি ফোন করছি।
তারপর নিজেই বলে উঠলেন, ও হো ওদের বাড়িতে তো ফোন নেই। সহকারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আজই খবরটা নিয়ে আমাকে জানাবি।
Advertisement
এরপর এক অফিস স্টাফ কিছু ফাইল নিয়ে এলো। তাতে সই -সাবৎ করলেন, ডায়েরিতে কিছু শুটিংয়ে ডেট দিলেন একইসঙ্গে সেগুলো নিজের কাছের ছোট্ট ডাইরিতে লিখে রাখলেন। এইসব কাজকর্ম সেরে তিনি হেলান দিয়ে বসে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, যাক তোদের সব শেষ হয়েছে তো, আর আমাকে ডিস্টার্ব করবে না, আমি একটু এদের সঙ্গে আড্ডা দেবো। যদিও বললেন আড্ডা দেবো কিন্তু সেই আড্ডা স্থায়ী হলো মাত্র সাড়ে ৪ মিনিট। তারপর আমার সঙ্গে কথা শুরু করলেন। আমি প্রথমেই বললাম, আমাকে আপনি আপনি করে বলবেন না তুমি বললেই খুশি হব। উনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ তা ঠিক তুমি বয়সে অনেক ছোট তবে মাস্টার ডিগ্রী পড়ছো– ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্র, এর সম্মানে আলাদা– তোমার সাবজেক্ট কি– পল সাইন্স, পলিটিকাল সাইন্স– মডার্ণ সাবজেক্ট– আমি অবশ্য… আমি মাঝপথে বললাম, কমার্স, গোয়েঙ্কা কলেজ!
Advertisement
উনি একটু অবাক হয়ে পঞ্চাননদার মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটু হেসে মুখভঙ্গি করলেন যার অর্থ, বাহ! ছেলেটি বুদ্ধিমান, ছোকড়া হোমওয়ার্ক করে এসেছে। এমন অদ্ভুত অসাধারণ মুখের অভিব্যক্তি আমি কখনো দেখিনি! কথা বলতে বলতে দারোয়ান এসে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিল উত্তমকুমারের হাতে। উনি দেখে বললেন ডেকে দাও। ভদ্রলোক ঢুকলেন উনি তাকে বললেন, আপনি তো মশাই বড্ড দেরি করে ফেলেছেন, আমার লোকেরা তো সবাই চলে গেল,এখন আমি কি করি– আচ্ছা বলুন আপনার কি বলার আছে, ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করছেন দেখে উত্তমকুমার উঠে ওনাকে এক ধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে শুনলেন তার কথা। তারপর এসে আবার নিজের সোফায় বসে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। পঞ্চাদা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, আমি ডেকে দেবো। উনি বললেন, তাহলে ভালো হয়।
পঞ্চাদা উঠে গিয়ে ভেতর থেকে একজনকে ডেকে নিয়ে এলেন উত্তমকুমার তাকে চুপিচুপি কি যেন বললেন সে চলে গেল। আবার ডাকলেন তাকে বললেন, দেখ ভদ্রলোকের চটি ছিড়ে গেছে। তুই এখান থেকে কাজ চালাবার মত একজোড়া চটি দিয়ে দিস। আর নতুন চটি কেনার টাকাটাও দিয়ে দিস। আর হ্যাঁ, বেনুকে বলিস ইউনিভার্সিটি থেকে ছাত্ররা এসেছে ওনাদের তো কিছু ডোনেশন দিতে হবে— আমি ওনার কথার মাঝেই বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না আমি কিন্তু ডোনেশন নিতে আসেনি।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন– জানি কিন্তু ওটা তো ভাই অসম্ভব, আমি তোমাদের অনুষ্ঠানে গেলে তোমাদের সমস্ত অনুষ্ঠানটাই পণ্ড হয়ে যাবে। তাই এই পরিকল্পনা ছাড়ো। তারপর আমি এবং পঞ্চাদা অনেক বোঝালাম। উনি শেষে বললেন, দেখো যেতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না– ঠিক আছে, বলে পঞ্চাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি অমুক দিন ওকে নিয়ে একবার এসো স্টুডিওতে। ব্যাস। খেল খতম, করে পয়সা হজম।উনি উঠে পড়লেন, আমরাও উঠে পড়লাম।
এখানে আসার আগে অনেকের অনেক আবদার চাহিদা পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু কিছুই হলো না। অথচ অনেক কিছুই আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধু বান্ধবীরা অনেকেই বলেছিল উত্তমকুমারের অটোগ্রাফ আনতে, কেউ কেউ আবদার করেছিল অন্তত একটা ছবি তুলে আনিস। তখন আমি যুগান্তরের সাংবাদিকতাও করি। এক সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন, এই সুযোগ, একটা ইন্টারভিউ নিয়ে নিস, খুব কাজে লাগবে। যদিও অনেকক্ষণ ছিলাম উনিও অনেকক্ষণ সময় দিয়েছিলেন। কিন্তু ইন্টারভিউ হলোনা। সই চাইতেও পারলাম না। ছবি তোলার প্রশ্নই নেই। কারণ তখন মোবাইল ছিল না। অর্থাৎ এক অর্থে কিছুই পারলাম না। তবুও যা পেলাম, যা দেখলাম, যা জানলাম সেটাই তো অনেক! কি হবে মহানায়ক উত্তমকুমারের ইন্টারভিউ নিয়ে? আমি তো স্বচক্ষে দেখলাম একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, মানুষ উত্তমকুমারকে। এর থেকে বাধা ধরা গতে কতগুলো প্রশ্ন উত্তর কি খুব গুরুত্বপূর্ণ! খুব বেশি কিছু জানা যেত? মনে হয় না । তবে হ্যাঁ কথা প্রসঙ্গে আমি একবার হঠাৎ বলে ফেলেছিলাম, রাতে আপনার ঘুম হয়? উত্তমকুমার চমকে উঠেছিলেন! তার থেকে বেশি ভয় পেয়ে গেছিলেন পঞ্চাদা। উনি তাড়াতাড়ি আমাকে থামিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাবার চেষ্টা করলেন! উত্তমকুমার একটু থেমে আমার দিকে না ফিরেই বললেন, এটাই তো সমস্যা।
এবার আসল ব্যাপারটা বলি ১৯৭১-৭২ এর ঘটনা। তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী মেলা ও যুব উৎসব করার আয়োজন করেছিলাম রেলের শিয়ালদা ডিভিশনে ক্লেমব্রাউন ইনস্টিটিউট এর মাঠে। সাত দিন ধরে এই উৎসব করা হয়। তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ডঃ সত্যেন্দ্রনাথ সেনের সভাপতিত্বে একটা কমিটি গঠিত হয়েছিল, দুজন সম্পাদকের একজন ছিলাম আমি। সেই অনুষ্ঠানেই উত্তমকুমারকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা আমার মাথায় আসে! তার প্রধান কারণ পঞ্চাদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। পঞ্চাদা অর্থাৎ পঞ্চানন দত্ত। চলচ্চিত্রের প্রচার জগতে শ্রীপঞ্চানন নামে খ্যাত। উত্তমকুমারের প্রায় সব সিনেমায় তিনি প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে প্রচারের দায়িত্বে থাকতেন। তাই তাকে ধরেই উত্তম কুমারের কাছে পৌঁছানো। যাইহোক শেষ পর্যন্ত উত্তম কুমার এসেছিলেন। তবে একটা শর্ত ছিল। উত্তম কুমার আসবেন এটা প্রচার করা যাবে না, এমনকি নির্দিষ্ট দিনক্ষণ সময় চূড়ান্ত হলেও তা বলা যাবে না। কোন মতেই প্রচার করা যাবে না। আমরা খুব কঠোরভাবেই এই শর্ত সততার সঙ্গেই পালন করেছিলাম। উত্তমকুমার শুধু নিজে এলেন তা নয়, সঙ্গে এনেছিলেন বিকাশ রায় কে। তাঁরা দুজনে মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা নকশা পরিবেশন করেন। সম্ভবত বিনা টিকিটে খোলা মাঠের মঞ্চে উত্তমকুমারের এটাই একমাত্র অনুষ্ঠান, যার রেকর্ড আজও অটুট।
গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে উত্তমকুমারের প্রাক শত বর্ষের সূচনা। পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতেই এমনকি বাংলাদেশ এবং বিদেশেও কোটি কোটি উত্তম অনুরাগী শতবর্ষ পালনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন কারণ উত্তমকুমার তো শুধু অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা, চিত্রপরিচালক, সংগীত পরিচালক, গায়ক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক প্রভৃতি নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। উত্তম সুচিত্রা জুটি আজও রোমান্টিকতার শেষ কথা। উত্তমকুমার বহু নায়িকার সঙ্গেই জুটি বেঁধেছেন। দেবী রায়, কানন দেবী, সাবিত্রী চ্যাটার্জী,মালা সিনহা, সুপ্রিয়া চৌধুরী, অরুন্ধতী দেবী, অপর্ণা সেন, সুস্মিতা মুখার্জি, অঞ্জনা ভৌমিক, শর্মিলা ঠাকুর, আরতি ভট্টাচার্য, আশা পারেখ, তনুজা, বৈজয়ন্তিমালা ও আরও অনেক নায়িকার সঙ্গেই তিনি অভিনয় করেছেন কিন্তু উত্তম সুচিত্রার রোমান্টিক জুটি সারা বিশ্বের দর্শক হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে সপ্তপদীর উত্তম-সুচিত্রার মোটর বাইক সফরের দৃশ্যটি আজও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে উত্তমকুমারের অবদান অবিস্মরণীয়। প্রযোজনা, পরিচালনা, চিত্ররূপ প্রভৃতি নানা ভূমিকায় তাঁর অবদান এক দুই তিন চার করে লিখলে এক ডজন পয়েন্ট খুব সহজেই এসে যায়। আমি এত বিস্তৃত আলোচনা করব না। শুধুমাত্র দুটি বিষয়ের উল্লেখ করব, যার একটি হচ্ছে মুখাভিনয় অন্যটি স্বর। যা বাংলা চলচ্চিত্রে ছিল না বললেই চলে, যা উত্তমকুমার অতি নির্দিষ্টভাবে উপস্থিত করলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে যার চূড়ান্ত সফলতা আমরা দেখলাম সত্যজিৎ রায়ের নায়ক এবং চিড়িয়াখানা তে। অনেক সমালোচক লেখক এমনকি দর্শক মাঝেমধ্যেই বলে থাকতেন যে, উত্তমকুমার ঈশ্বরদত্ত অভিনেতা। তাঁর নিজস্ব তেমন কোন পড়াশোনা এবং প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু এটা যে কত বড় মিথ্যে এবং অজ্ঞতা বলে বোঝানো যাবে না। এটা হয়তো ঠিক যে উত্তমকুমারের প্রথম কয়েকটা ছবিতে তিনি বিষয়গুলিকে ঠিকঠাক রপ্ত করতে পারেননি। সেটা তিনি নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন। এই আত্ম উপলব্ধি তাঁকে সফলতার চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে গেল। তিনি রীতিমতো পড়াশোনা এবং প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলেন। না, সবসময় সবাইকে দেখিয়ে লাইব্রেরী রুমে বই নিয়ে বসে থাকা বা কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে ট্রেনিং নেননি। উত্তমকুমার যখন ফ্লপ মাস্টার হিসেবেই ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিত হয়ে গেছেন, তখন থেকেই তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। গোপনে লোকচক্ষুর আড়ালে প্রচুর পরিমাণে বিখ্যাত হলিউড ছবিগুলো দেখতে লাগলেন, বিশেষ করে নাইট শোয়ে তিনি যেতেন। আর এ ব্যাপারে তাঁর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ছিল বসুশ্রী। তাছাড়া তিনি কিছু বাছাই করা বই পড়তে শুরু করলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করলেন রিচার্ড বার্টান, মার্চেল্লো এবং মারলান ব্র্যান্ডর ডায়লগ ও তাদের মুখভঙ্গি। অত্যন্ত মন প্রাণ দিয়ে দেখা ও বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। যদিও প্রথম থেকেই তিনি মুখভঙ্গিমা এবং কণ্ঠস্বর সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। তিনি মনে করতেন অভিনয় হাত পা নেড়ে করলেই তা অভিনয় হয় না। অনেক কথা না বলে চোখ মুখ ব্যবহার করে গলার স্বরকে নিয়ন্ত্রণ করে অভিনয়ের সাফল্যে পৌঁছানো যায়। অর্থাৎ বলা যায় উত্তমকুমারই হচ্ছেন বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র অভিনেতা যিনি অভিনয়ে মগজ অস্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করলেন। চলচ্চিত্রে মুখ চোখ প্রভৃতির সঠিক ব্যবহার এবং সুনির্দিষ্ট স্বরক্ষেপণ উত্তমকুমারের শ্রেষ্ঠ অবদান। তার আগে বাংলার বিখ্যাত বিখ্যাত অভিনেতারাও এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না, তাই মঞ্চের নায়ক শম্ভু মিত্র এবং এবং মঞ্চের সর্বাধিনায়ক শিশির ভাদুড়ি সিনেমায় ‘উত্তমকুমার’ হতে পারলেন না। অথচ উত্তমকুমারও মঞ্চ থেকে এসেই সফলতা পেলেন। মঞ্চেও তিনি সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ শ্যামলী নাটক, উত্তমকুমার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই নাটক একটানা ৪৮৪ দিন হাউসফুল হয়েছিল। আসলে যাত্রা, নাটক, চলচ্চিত্র– অভিনয়ের আলাদা আলাদা মঞ্চ এবং মাধ্যম এবং এই সবগুলোর থেকেই সবগুলোই একেবারে সম্পূর্ণ পৃথক, তাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সব সময় রয়েছে। এটা অনেক বড় অভিনেতা গুলিয়ে ফেলেছিলেন। উত্তমকুমার সেই ভুল করেননি। নাটকের মঞ্চে অনেক জোরে ডায়লগ বলতে হয় কারণ হলে শেষ সারির মানুষও যাতে তা শুনতে পায়। তার থেকেও অনেক বেশি চিৎকার করেও অভিনয় করতে হয় যাত্রার মঞ্চে, কারণ সেটা চারধার খোলা মাঠের মঞ্চে চলে! কিন্তু চলচ্চিত্রে তার প্রয়োজন হয় না কারণ যন্ত্র! যন্ত্র সেখানে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই সত্যটা সিনেমায় উত্তমকুমার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
উত্তম সৌমিত্রের পরে প্রায় অর্ধশতক হতে চলল বাংলায় অনেক ‘ভালো ভালো’ অভিনেতার আবির্ভাব হয়েছে। অনেকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিন্তু একজনও নায়ক কে আমরা পেলাম না, তার কারণ, এখন সবাই প্রথম থেকেই নায়ক হতে চায়। অভিনেতা হওয়ার পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ কেউ করতে চায় না। কেউ খবর রাখে না উত্তমকুমারের সিনেমা জগত শুরু হয়েছিল এক্সট্রা বা অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে, একটি নয় পরপর দুটি সিনেমাতেই তিনি এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অরুনকুমার কোন শর্টকাট পথে উত্তমকুমার হননি।
Advertisement



