• facebook
  • twitter
Saturday, 6 December, 2025

বিশ্বমানবতার সুরসাধক ভূপেন হাজারিকার জন্মশতবর্ষের সূচনা

আজ থেকে একশো এক বছর আগে ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামের তিনসুকিয়ার সাদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ভূবনজয়ী শিল্পী ভূপেন হাজারিকা।

আজ থেকে একশো এক বছর আগে ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামের তিনসুকিয়ার সাদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ভূবনজয়ী শিল্পী ভূপেন হাজারিকা। তাঁর পিতার নাম নীলকান্ত হাজারিকা ও মাতার নাম শান্তিপ্রিয়া হাজারিকা। দশ সন্তানের মধ্যে ভূপেন হাজারিকাই জ্যেষ্ঠ। তাঁর বাবা-মা উভয়েই শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ভূপেনের পরিবার সংস্কৃতি জগত বিশেষত সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেকারণে ভূপেন হাজারিকা জীবনে প্রথম গানের তালিম পান তাঁর পরিবার থেকেই। তাঁর মা সঙ্গীতের একজন শিক্ষিকা এবং মা শান্তিপ্রিয়া দেবীই তাঁর জীবনের প্রথম সঙ্গীত গুরু। পরিবারের এই সংস্কৃতি মনস্কতা তাঁর ভবিষ্যত জীবন গড়তে সাহায্য করেছে এব্যাপারে কোন ভুল নেই।
ধূপরীর সোনারাম বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু। এরপর আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে পড়াকালীনই প্রিয়ম্বদা পাটেলের সাথে পরিচয়। পরবর্তীকালে তাঁরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের একমাত্র সন্তান তেজ হাজারিকার জন্ম ১৯৫২ সালে।

ভূপেন হাজারিকা শুধু ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের সাংস্কৃতিক জগতের এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর সঙ্গীত, কবিতা, চলচ্চিত্র ও দর্শন আজও আমাদের মানবিক মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আজ এই শতবর্ষের দোড়গোরায় দাঁড়িয়ে বিশ্ব মাঝে তাঁর অবদানকে নতুন করে উপলব্ধি করা বিশেষ প্রয়োজন। যিনি শুধুমাত্র গানের মাধ্যমেই বিশ্বমানবতার ধ্বজা উড়িয়ে ছিলেন। ভূপেন হাজারিকা আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে বাংলা তথা ভারত তথা বিশ্ব জয় করলেন শুধুমাত্র তাঁর সাংস্কৃতিক মন দিয়ে। তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে বহুবিভক্ত সমাজ ব্যবস্থাকে বারবার আঘাত করেছেন। তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র ছিল ‘একাত্মতাবোধ’। তাঁর প্রতিটি গানে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর এই একাত্মতাবোধ আর ভাতৃত্ববোধ। অতি অল্প বয়সে তিনি শচীন দেববর্মণের সংগীতে গান রেকর্ড করেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

Advertisement

বিদেশে থাকাকালীন তিনি আফ্রো-আমেরিকান শিল্পী ও সমাজকর্মী পল রোবসন -এর সংস্পর্শে আসেন। রোবসনের ভাবাদর্শ ভূপেন হাজারিকার মনে গভীর ছাপ ফেলে, যা পরবর্তীতে তাঁর বহু গানে প্রতিফলিত হয়েছে। বলা যায় পল রোবসনই তাঁর সঙ্গীত জগতের গুরু। তাই ভূপেন হাজারিকার গানে ছিল সমাজচেতনা ও মানবতার মিশ্রণ। তাঁর জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মানুষ মানুষের জন্য’ মানবতাবাদের এক চিরন্তন মন্ত্র। ‘বিস্তীর্ণ দু’পারে’ ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও আসলে কিন্তু এটি সমাজ বিভাজন ও তার করুণ ফলের প্রতীক। ‘আজ জীবন খুঁজে পাবো কি’ অস্তিত্ব ও অর্থহীনতার প্রশ্ন তুলেছে বা ‘গঙ্গা তুমি গঙ্গা হও কেন’ নদীর সাথে মানুষের সম্পর্কের দার্শনিক উপলব্ধি। একারণেই তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু ‘ভূপেন হাজারিকার’ নামাঙ্কিত। এছাড়াও তাঁর অনেক গানে লোকসঙ্গীতের শক্তি ও উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। তাঁর রচিত প্রায় সব গানই মানবতার ধ্বজাধারী।

Advertisement

১৯৫৬ সালে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘Era Bator Sur’ আসামি সমাজে আলোড়ন তোলে। তিনি ২০ টিরও বেশি আসামি ও বাংলা ছবিতে কাজ করেছেন। হিন্দি ছবির মধ্যে ‘রুদালি’ (১৯৯৩)-র গান তাঁকে জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়। ‘দামান’ সিনেমার গানও বহুল জনপ্রিয়।
ভূপেন হাজারিকা ছিলেন এক বিশ্বভ্রমণকারী শিল্পী। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গান গেয়েছেন। প্রতিটি সফরে তিনি ভারতীয় লোকসঙ্গীত ও সাথে সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির যে মূল মন্ত্র সেই মানবতার সুর তুলে ধরেছেন। ১৯৬৭ সালে আফ্রিকা সফরে গিয়ে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীদের সাথে মিলিত হয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গান গেয়েছিলেন। তাঁর গান We are in the Same Boat, Brother-এর ভারতীয় রূপ ‘বিস্তীর্ণ দু’পারে’ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

তিনি সংস্কৃতির পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৭ সালে আসাম গণপরিষদের হয়ে নির্বাচনে জিতে বিধায়ক হন। তিনি একাধারে গায়ক, সুরকার, গীতিকার, সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত পরিচালক ও লেখক। তিনি সংস্কৃতি জগতের পারাপাশি রাজনীতির আঙিনাতেও পা রেখেছেন। তবে তা মূলত রাজনীতির জন্য নয়। তাঁর গান ও সংস্কৃতিকে মানুষের ঐক্যের হাতিয়ার হিসেবে আরও তুলে ধরতে। লেখক হিসেবেও ভূপেন হাজারিকা সফল। তিনি দু’বছর গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।

এহেন বহু প্রতিভার একজন মানুষ যে অজস্র পুরস্কারে ভূষিত হবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? ১৯৭৬ সালে তিনি বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর হিসাবে পুরস্কৃত হন ‘চামেলী মেমসাহেব’ ছবিতে মিউজিক দেওয়ার জন্য। ১৯৭৭ সালে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৯ সালে পার্শ্ববর্তী রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ সরকার ট্রাইবালদের উন্নতির জন্য কাজ করা এবং তাদের সংস্কৃতিকে সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য তাঁকে ‘গোল্ড মেডেল’ দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমি’ পুরস্কার পান।

পরবর্তীতে ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই সঙ্গীত নাটক একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি আসাম ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের এবং কেন্দ্রীয় ফিল্ম সার্টিফিকেট বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে তিনি ‘প্রসার ভারতী’ বোর্ডেরও সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। সিনেমা জগতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৯২ সালে। ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কারে পদ্মবিভূষণ’ উপধাতে ভূষিত হন ২০০১ সালে। তাঁর জন্মভূমি আসাম সরকার তাঁকে আসামের সর্বোচ্চ সম্মান ‘আসাম রত্ন’ উপাধি দেন ২০০৯ সালে। ২০১৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার মরণোত্তর ‘ভারত রত্ন’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন।

আজকের যুদ্ধবিধস্থ এবং ভাঙনময় পৃথিবীতে ভূপেন হাজারিকার গান আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত “মানুষ মানুষের জন্য”— এ এমন মন্ত্র যা আমাদের সমাজে সম্প্রীতি ও শান্তির সেতুবন্ধন ঘটাতে পারে। ভূপেন হাজারিকা ছিলেন স্রষ্টা, সমাজচিন্তক এবং বিশ্বমানবতার দূত। তাঁর গান নদীর মতো, যা দেশের সীমানা ভেঙে আর এক দেশে গিয়ে সেখানকার মানুষের মনে মিশে গেছে। জন্মশতবর্ষে তাঁর অমোঘ সৃষ্ট গান, সুর বা কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় — মানুষের ওপরে তার আর কোনো পরিচয় নেই। না ধর্ম, না বর্ণ না রাজনীতি। সেই ভারতরত্ন ভূপেন হাজারিকার জন্মশতবর্ষের শুভারম্ভ হতে চলেছে আজ ৮ সেপ্টেম্বর কলকাতায় যা সারা বছর চলবে।

‘বার্ড অফ ব্রহ্মপুত্র’ -র জন্মদিন সাড়ম্বরে পালন হতে চলেছে কলকাতা যাদুঘরে আসামের ‘ব্যতিক্রম গ্রুপ’ ও কলকাতার বিখ্যাত সংস্থা ‘জেএমবি হেল্থ কেয়ার’ এর যৌথ প্রয়োজনায়। ধন্যবাদ ‘ব্যতিক্রম গ্রুপ’ এবং ‘জেএমবি হেল্থ কেয়ার’ সংস্থাকে ভূপেন হাজারিকার চারণক্ষেত্র কলকাতাকে শততম বছরের ক্ষেত্রে বেছে নেওয়ার জন্য।

Advertisement