• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

কাজী নজরুল ইসলামের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে আজ আর চেনা যায় না

ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকা থেকে ১৯১৬-১৯১৮ কালপর্বে প্রকাশিত শপাঁচেক নামের মধ্যে থেকে সৈনিক নজরুলের হদিশ দিয়েছেন মুরশিদ।

ফাইল চিত্র

আদর্শ মেনে না চলায় স্বীকৃতিই অস্বীকৃতির কারণ হয়ে ওঠে। বর্তমান বাংলাদেশের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী শক্তির নৃশংসতার মধ্যেই কাজী নজরুল ইসলামের অস্তিত্ব গৌরবান্বিত হওয়ার অবকাশ পেলেও তা অচিরেই অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অবশেষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। ২০২৪-এ’ই তাঁর ১২৫ বছর পূর্তি সম্পন্ন হয়। দেরিতে হলেও ‘better late than never’-এ তা জরুরি ছিল। অবশ্য ২০২৫-এর নতুন বছরের সূচনায় বিদ্রোহী কবির এই স্বীকৃতি স্বাভাবিক ভাবে বেমানান মনে হয়। এদিকে এ বছর ২৪ মে কবির ১২৬ -এ পদার্পণ ঘটে, ২৮ আগস্ট তাঁর প্রয়াণ দিবসও চলে গেল। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নজরুলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ খুঁজে পাওয়া যায় না।

যে কবির বিদ্রোহী পরিচিতিতেই ছিল বৈষম্যপীড়িত সমাজের সমস্ত ধরনের অসাম্য দূর করার বার্তা, শোষিত-শাসিত মানুষের পাশে থাকার মানবিক দায়বদ্ধতা নিবিড় হয়ে ওঠে,তাঁর সেই আদর্শই আজ সে দেশে অমান্যে,অস্বীকৃতিতে ভূলুন্ঠিত মনে হয়। তাঁর কবি-পরিচিতিতেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনের আলোকদিশারি জেগে ওঠে, সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ সাম্যবাদী কবিকণ্ঠের পরিচয় মেলে। সেখানে ২০২৪-এর ৫ আগস্টে বাংলাদেশের পরিকল্পিত গণ অভ্যুত্থানের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই মৌলবাদীদের উত্থানে ভয়ঙ্কর ধর্মীয় বিদ্বেষ নিধনযজ্ঞে পরিণত হয়। সেখানে সাম্প্রদায়িক বিভেদকামী শক্তি বাংলার মানুষের মানবিক অস্তিত্বকেই নতুন করে বিপন্ন করে তোলে। সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর এ বছর সে দেশের নতুন করে স্বাধীনতা লাভের আয়োজনের নেপথ্যেই ছিল মৌলবাদী শক্তির আধিপত্য বিস্তারের ভয়ঙ্কর আয়োজন।

Advertisement

সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকারে সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যখন হিন্দুশূন্য মৌলবাদীদের নতুন দেশ গড়ে তোলার খবর দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন কাজী নজরুল ইসলামকে সে দেশের জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করার বিষয়টি আপনাতেই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যেখানে সে দেশে কাজী নজরুলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা অত্যন্ত জরুরি ছিল, সেখানে তাঁর আদর্শকেই অস্বীকার করে তাঁকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি প্রদানে রাষ্ট্রীয় মুখকে অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞাপনে উজ্জ্বল করার ব্যর্থ প্রয়াস আরও রহস্যময় মনে হয়। কেননা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতি তাঁর বিদ্রোহী পরিচিতিতেই সামনে চলে আসে। তাঁর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাই তাঁকে বাঙালির আপনজন করে তুলেছে। দুই বাংলাতেই তাঁর সমান সমাদর। কোনও মৌলবাদী দেশ তাঁকে আপন করতে পারে না। ফলে তাঁকে সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে নয়, তাঁর অসাম্প্রদায়িক আদর্শে সম্প্রীতি ফেরানোতেই তাঁকে যথার্থ সম্মান জানানো হবে।

Advertisement

সেই বাংলাদেশেই কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে যিনি তুলে ধরে অসাধারণ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, তিনি বাংলাদেশেরই ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে ওঠা একজন আন্তর্জাতিক মনের মানুষ তথা লন্ডন প্রবাসী স্বনামধন্য গবেষক ও প্রখ্যাত লেখক গোলাম মুরশিদ (১৮৫১-২০২৪)। ২০২৪-এ মৌলবাদীদের হাতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের মধ্যেই ২২ আগস্ট তাঁর প্রয়াণ ঘটে। তিনি জীবনের শেষ পর্বে এসে কাজী নজরুল ইসলামকে নতুন করে অসাম্প্রদায়িক মানবিক জীবনের পরিচয়কে নিবিড় করে তুলে ধরেছেন। এটিই ছিল তাঁর গবেষণার শেষ সোনালি ফসল। শুধু তাই নয়, তার জন্য শেষের দিকে জ্বলে ওঠার মতোই তাঁর বিভূতি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর নজরুল জীবনী ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’(২০১৮)। এই অসাধারণ জীবনী বইটির জন্যই তাঁর নাম ২০২৩ তথা ১৪২৯-এর আনন্দ পুরস্কারের জন্য আরও তিন জনের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার ও সুব্রত চট্টোপাধ্যায়) বিবেচিত হয়েছিল।

সেই পুরস্কার তাঁর না জুটলেও বইটির সমাদরের সূত্রে তাঁর পরিচিতি নতুন করে চর্চার অবকাশ লাভ করে। অন্যদিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনীর পর কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী লেখার বিষয়ে তাঁর লক্ষ্যভেদী প্রয়াসের মধ্যে তাঁর প্রগাঢ় ইতিহাসচেতনা ও উদ্ভাবনী গবেষণার পরিচয় সমুজ্জ্বল। বাঙালিমানসে উনিশ শতকে মধুসূদনের মতো বিশ শতকে নজরুলের প্রভাব অনস্বীকার্য। সেখানে প্রথম জনের বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী বিদ্রোহী প্রভাব যেভাবে নবদিগন্তের সূচনা করেছিল, পরের জনের মানবিক বিদ্রোহের প্রভাব সমাজ-সাহিত্য, ধর্ম-রাজনীতি থেকে সমাজের সাধারণ স্তরেও ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য গোলাম মুরশিদ নজরুলের আলোচনাতেও মধুসূদনের ফিরে গিয়েছেন এবং দুজনের বিদ্রোহী সত্তার পরিচয়ের ঐক্য লক্ষ করেছেন। ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র মধ্যেই তা প্রতীয়মান।

তাঁর কথায় : ‘কিন্তু বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে দেশ, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদিও সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে পরিণত হলো। এতে একটা বড়ো ভূমিকা পালন করেছিলেন নজরুল ইসলাম। তারও আগে বাংলা সাহিত্যের আসরে বিদ্রোহের জোরালো বাণী শুনিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। থীম এবং আঙ্গিকের দিকে তিনি প্রতিষ্ঠিত এবং পুরোনো সমস্ত নিয়মকানুন ভেঙে ফেলেছিলেন। সে জন্য বাংলা সাহিত্যে তাঁর চেয়ে বড়ো বিদ্রোহী আর কেউ নেই। কিন্তু নজরুল ইসলাম অন্য ধরনের বিদ্রোহ করলেন। তিনি ধর্ম, রাজনীতি, সরকার, সমাজ—যা কিছু ব্যক্তির মানবিক স্বাধীনতাকে খর্ব করে—তাকে ভেঙে তছনছ করার আহ্বান জানালেন ।‘

স্বাভাবিক ভাবেই মাইকেল মধুসূদনের জীবনীর মতো নজরুলের জীবনীর প্রতি গোলাম মুরশিদের দৃষ্টিনিবদ্ধ হয়েছিল। বিশেষ করে মধুসূদনের বেড়ে ওঠা, গড়ে তোলার জীবনের বিপরীতে নজরুলের দীনহীনের প্রান্তিক জীবনের উত্তরণ কম বিস্ময়কর নয়। বরং অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক, আরও বেশি রোমাঞ্চকর ঘটনাবহুল। অথচ নজরুলের জীবনীগুলোতে তথ্যের রহস্যভেদ করে তাঁর সেই উত্তরণের ছবি দুর্বোধ্য থেকে যায়। গোলাম মুরশিদের আগে নজরুলের জন্মের শতবর্ষের পরিসরে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে অরুণকুমার বসু ‘নজরুল-জীবনী’(২০০০) প্রকাশিত হয়। সেখানেও জীবনীকার নজরুলের জীবনের রহস্যভদের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন, ‘জন্মশতবর্শে সত্যের অনাবৃত প্রকাশই প্রত্যাশিত।‘ সেই ‘প্রত্যাশা’র মধ্যে যে নজরুলের জীবনের অনেক তথ্যই অজানা থেকে গেছে, তা সহজেই অনুমেয়। সেক্ষেত্রে গোলাম মুরশিদের নজরুল জীবনী রচনার দুরূহ পথের পথিক হয়ে ওঠাটা ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র।

সবদিক থেকেই প্রান্ত্রিক পরিসর থেকে দুখু মিঞা থেকে কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠাটা রহস্যাবৃত ও বিস্ময়কর। সেদিক থেকে নজরুলের জীবনের উত্তরণ স্বাভাবিক ভাবেই জীবনীকার কাছে যেমন অজানা খনির পরশমণি হয়ে ওঠে, তেমনই তাঁর জীবনীতে জনশ্রুতি, গালগল্প, কিংবদন্তি থেকে বীরপূজামূলক বানানো-ফেনানো-রাঙানো শোনাকথানির্ভর লোকরঞ্জন উপাদান ভর করে। সেই ভারে নজরুলের রক্তমাংসের সজীবতা চাপা পড়ে যায়, জেগে ওঠে তাঁর অসাধারণ মূর্তি থেকে প্রতিমা। সেখানে স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক ভাবমূর্তির অভাব অত্যন্ত প্রকট। সেখানে তথ্যের অপ্রতুলতা সময়ান্তরে কমে আসে ঠিকই, কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় থেকে যায় মেঘে ঢাকা তারায়। সেদিক থেকে নজরুলের জীবনী লেখার সময় গোলাম মুরশিদ তাঁর জীবনের আলোতেই জীবনী লেখায় সক্রিয় হয়েছিলেন। মাইকেল মধুসূদনের জীবনী লেখার মধ্যে তাঁর আত্মজৈবনিক সৃষ্টির ধারার মতোই নজরুলের জীবনের উত্তরণের সোপানে মনোনিবেশ করেছেন।

নজরুল জীবনী লেখার সময় তিনি যে-কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টিনিবদ্ধ করেছিলেন, বইটি সম্পর্কে তা অকপটে ব্যক্ত করে তাঁর লক্ষ্য স্পষ্ট করে তুলেছেন। প্রথমেই তাঁর লক্ষ্য ছিল দীনহীন অসহায়তার মধ্যেও প্রতিকূলতা জয় করে কী করে নজরুল অতবড় একজন কবি সঙ্গীতকার হলেন, সে-বিষয়ে আলোকপাত করা। ব্যর্থতার সোপানেই সাফল্যের দিশায় জীবনীর আবেদন আপনাতেই প্রকাশমুখর হয়ে ওঠে। সেখানে গোলাম মুরশিদের লক্ষ্যভেদী অর্জুনের ছায়া ক্রমশ কায়া লাভ করে। অন্যদিকে নজরুল পলটনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কলকাতায় ফিরে আসার এক বছর নয় মাস পরে কী করে ‘বিদ্রোহী’ লিখলেন, সে-বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লণ্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকা থেকে ১৯১৬-১৯১৮ কালপর্বে প্রকাশিত শপাঁচেক নামের মধ্যে থেকে সৈনিক নজরুলের হদিশ দিয়েছেন গোলাম মুরশিদ। তৃতীয়ত, তিনি নজরুলের আপাতবিরোধী ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোনও ঐক্যসূত্র আছে কিনা তার হদিশ দিতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নজরুলের লেখায় তাঁর অসম্প্রদায়িক প্রকৃতিতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কেউই তাঁকে মেনে নিতে পারেনি। এজন্য তাঁর বিরুদ্ধে দুই দিক থেকেই বিরূপ সমালোচনা নেমে আসে। আবার ধর্মীয় আধারে তীব্র সমালোচিত নজরুলকেই দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রহণে-বর্জনে মুসলিম সমাজই আপন করে নিয়েছে। তিনি যে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে মানবতাবাদী একজন মানুষ, সে-কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন গোলাম মুরশিদ।

অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর জীবনের যোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে তোলার দিকে গোলাম মুরশিদের দৃষ্টি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেখানে মধুসূদনের মতো নজরুলের সাহিত্যেও আত্মজৈবনিক পরিসর ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। সৃষ্টির অলৌকিক প্রকৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নজরুলের অসাধারণ প্রতিভার যোগসূত্রকে সময়ের ফসলে কীভাবে তাঁর বনেদি আভিজাত্য গড়ে উঠেছে, সে-বিষয়ে গোলাম মুরশিদ স্বাভাবিক ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এছাড়া ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত নতুন তথ্যের আলোকে তাঁর নজরুল জীবনীকে আরও বেশি বস্তুনিষ্ট করায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সেক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার জন্য যে জীবনীকারের নিরাসক্ত ও মুক্ত মন জরুরি, সে-বিষয়ে তাঁর আত্মসচেতনতাও শেষে বেরিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে।

শুধু তাই নয়, জীবনীটিতে কোনওভাবেই যাতে বীরত্বব্যঞ্জক বা অতিরঞ্জিত প্রভাবের লেশ না পড়ে, সেদিকেও তাঁর নির্মোহ প্রকৃতি প্রথম থেকেই সবুজ হয়ে উঠেছে। গোলাম মুরশিদের ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ বইটিতে দশটি অধ্যায়(‘জন্ম, পরিবার পরিবেশ’, ‘হাবিলদারের বিদ্রোহ’, ‘ক্ষণিকের ধূমকেতু, চিরদিনের আশা(লতা)’, ঘর বাঁধার পথে’, ‘রাজনীতির চোরাবালিতে’, ‘রণক্লান্ত’, ‘স্বপ্ন ও বাস্তবতা’, স্বেচ্ছানির্বাসন, ‘আধ্যাত্মিকার পথে’, ‘নীরব কবি !’ বর্তমান। সেখানে নজরুলের জীবনের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে তাঁর তথ্য ও যুক্তিনিষ্ঠতার প্রতি জীবনীকারের সজাগ দৃষ্টিই জীবনীটিকে বস্তুনিষ্ঠ করায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাতে নজরুলের কৃতিত্ব বা মহত্বকে নিবিড় করার চেয়ে তাঁর ব্যর্থতা ও অপারগতার সঙ্গে উত্তরণের সোপানে রক্তমাংসের মানুষের পরিচয়কে তুলে ধরার প্রয়াস বর্তমান।

সেখানে নজরুলের প্রেমিক সত্তায় অসংখ্য নারীর সম্পর্কের কামগন্ধ নাহি তায় বলে দৈহিক সম্পর্ককে অস্বীকার করা হয়নি, সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কবি হিসাবে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা সত্বেও ভোটে দাঁড়িয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথাও অকপটে প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে নতুন তথ্যের ক্ষেত্রেও গোলাম মুরশিদের সদর্থক প্রয়াস লক্ষণীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অরুণকুমার বসু তাঁর নজরুল জীবনীতে নজরুলের আকস্মিক ভাবে অসুস্থ হওয়ার পর বাকি জীবনভর যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগেছেন, তার নাম জানাতে পারেননি। গোলাম মুরশিদ সে-বিষয়ে ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত : নজরুল-জীবনী’তে পরিশিষ্টে স্বতন্ত্র ভাবে তার পরিচয় দিয়েছেন। তাতে দুটি স্বতন্ত্র লেখা বর্তমান। একটি ‘প্রমীলার প্রতীক্ষা’ এবং অন্যটি ‘নজরুলের কী রোগ হয়েছিলো?’ শেষেরটিতে ডাক্তার মহম্মদ নুরুল হকের সিদ্ধান্তকে গ্রহ্ণ করে গোলাম মুরশিদ সেই রোগের নাম জানিয়েছেন ‘ডিমনেশিয়া অব লিউয়ী বডিস’(DLB)।

জীবনের পরিচয়ে জীবনীর গুরুত্ব অপরিসীম। সেখানে খ্যাতির আলোয় জীবনের বর্ণরঙিন আলোর পরশ ছড়িয়ে পড়ে, প্রদীপের আলোর নীচে অন্ধকারে জীবনের মূলই অন্তরালে থেকে যায়। তাতে কল্পনার প্রসারিত আলোয় জীবনের আকাঁড়া সত্য কিংবদন্তি ও অতিরঞ্জনের শিকার হয়ে ওঠে। গোলাম মুরশিদ সেই সত্যের আলোতেই নজরুলকে জীবন্ত করতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয়েই নজরুলকে তিনি আবিষ্কার করতে গিয়ে বিতর্কেও জড়িয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নজরুল জীবনী লেখার জন্য গোলাম মুরশিদ দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। ২০১৮-তে বই প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগেই ২০১২-তেই তিনি সেই বিতর্কে জড়িয়েছেন। ১৬ সেপ্টেম্বরে সেটি প্রকাশ্যে আসে।

‘নজরুল ইসলাম : একটি আদর্শ জীবনীর খোঁজে’ শীর্ষক বক্তৃতায় গোলাম মুরশিদের নজরুল ও তাঁর মা জাহেদা খাতুন ও স্ত্রী প্রমীলার চরিত্র হনন করে ভিত্তিহীন আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের অভিযোগে বিচার চেয়েছিলেন নজরুলের নাতনী খিলখিল কাজী। সেক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদনের নিকট আত্মীয়-স্বজন না থাকলেও নজরুলের অনেকেই জীবিত থাকায় গোলাম মুরশিদকে অনেক বেশি সচেতন পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। এজন্য নজরুলের জীবনীটির প্রায় প্রতিটি পাতায় তথ্যসূত্রের পাদটীকার উপরে ভিত্তি করে তাঁর বস্তুনিষ্ঠ নিখাদ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে হয়েছে। এতে জীবনীটি প্রকাশের পর সেই বিতর্ক আর মাথাচাড়া দেয়নি। বইটি প্রকাশের একবছর আগে ২০১৭-তে ‘বইয়ের দেশ’-এর সাক্ষাৎকারেই গোলাম মুরশিদ তাঁর নজরুল জীবনীর স্বতন্ত্রতা বিষয়ে স্পষ্ট করে তোলেন : ‘আমার সার্বিক প্রয়াস কিংবদন্তি বর্জিত এবং নিরাসক্ত একটি নজরুল জীবনী রচনা করার, যার কোথাও বীরপূজার চিহ্নমাত্র থাকবে না। নজরুলের জীবন ঘিরে বহু মিথ, ভিত্তিহীন তথ্য –কাহিনি মিশে আছে। সেগুলি একে-একে ছাড়িয়ে এগোবে আমার জীবনী।‘

সেখানে গোলাম মুরশিদের নিরলস গবেষণার সোনালি ফসল হিসেবে তাঁর নজরুল জীবনীটিও তাঁর অসামান্য উপহার। বিশেষ করে বাঙালির প্রশংসা ও নিন্দার বেপরোয়া প্রকৃতিতে নজরুলের মতো আবেগমথিত জনপ্রিয় কবির জীবনী রচনার পর যেভাবে তা সুধীমানসে নীরবতার মান্যতায় গ্রহণ করা হয়েছে, তাতেই গোলাম মুরশিদের অনন্য প্রয়াস প্রতীয়মান। সেক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের মানবিক সত্তার আলোয় তাঁর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা আরও বেশি স্বচ্ছ ও তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে উঠেছে। আর সেখানেই গোলাম মুরশিদের অনন্য কৃতিত্ব আমাদের চোখ খুলে দেয়। সেখানে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় কবির স্বীকৃতির চেয়ে সে দেশে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আদর্শে বাস্তবায়িত করা জরুরি।

আদর্শের মধ্যেই তাঁর আসল স্বীকৃতি আপনাতেই আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। লোকে জানবে বাংলাদেশও কাজী নজরুল ইসলামের দেশ। যে দেশে তাঁর আদর্শকেই অমান্য করা হয়, সেখানে তাঁকে জাতীয় স্বীকৃতি প্রদানও পরিহাস মনে হয়। জাতীয় কবির স্বীকৃতির সঙ্গে সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুদের নির্বিচারে নিরন্তর ধ্বংস করার আয়োজন দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। সেক্ষেত্রে মনে হয়, কাজী নজরুল ইসলামের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অপমৃত্যু ঘটেছে!

Advertisement