পণ্ডিতস্যারের পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ, কিন্তু তাতে পাণ্ডিত্যগর্বী আত্মপরিচয়ের সংকট ছিল না। তাঁকে দেখে কখনওই মনে হয়নি তিনি পণ্ডিতম্মন্য। শুধু তাই নয়, তিনি সংস্কৃতের পাশাপাশি ইংরেজি-বাংলা তো জানতেনই, সেইসঙ্গে অঙ্কেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। মাইনের টাকায় সাংসারিক দায় নির্বাহ হত না বলে তাঁকে নিয়মিত টিউশন করতে হয়েছে। সেখানে নাইন-টেনের অঙ্ক-ইংরেজির টিউটরের ভূমিকায় তাঁকে কত সাবলীল মনে হয়েছে, তা ভাবলে আজও বিস্ময়বোধ করি। সময়ের অগ্রগতিতে বিশেষীকরণের যুগে যেখানে বিশিষ্ট ভাবনার উৎকর্ষে আভিজাত্যবোধ বনেদি হয়ে ওঠে, সেখানে পণ্ডিতস্যার কত অনায়াসেই জ্ঞানের বহুমুখী চলনকে অনায়াসেই সংশ্লিষ্ট করে তাঁর সব্যসাচী প্রকৃতিকে নিবিড় করে তুলেছিলেন, তা ক্রমশ আমাকে নাড়া দিয়েছে। সেই টিউশন করার সূত্রেই স্যারকে আমি আমাদের চড়কডাঙা কলোনিতে দেখেছিলাম।
মহেশপুর স্কুলে যেতে গেলে কলোনির উপর দিয়ে যেতে হয়। স্যার কলোনিতে টিউশন শুরু করেন এবং প্রথম দিকে আমাদের বাড়িতেই পড়াতেন। তখন আমার বাবা জীবিত। তাঁর সঙ্গে আমার বাবার ছিল পারস্পারিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক। বাবা ছিলেন কলোনির জনপ্রিয় অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল। শুধু তাই নয়, তিনি তখন কলোনির বিকাশে আলোকিত ব্যক্তিত্ব। স্বাভাবিকভাবেই চৌত্রিশ বছর বয়সে বাবার অকালপ্রয়াণে (১৯৮৪-এর ১৬ মে) স্যার খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। সেজন্য বোধহয় আমার প্রতি তাঁর করুণাও জেগেছিল। চড়কডাঙা কলোনির বাড়ির সামনে দিয়ে আমি তাঁকে সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতে দেখতাম। শুধু তাই নয়, ‘পণ্ডিতমাস্টার’ নামে তাঁর নামডাক তখনও সচল।
Advertisement
তখন অবশ্য ‘পণ্ডিতমাস্টার’ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকাই বাঞ্ছনীয়। এজন্য তাঁকে কেন ‘পণ্ডিতমাস্টার’ বলা হয়, তা না বুঝলেও তাঁর পরিচ্ছন্ন ভাবকান্তি অনুভব করতে অসুবিধে হয়নি। আরও ভালো করে বুঝতে পারলাম মহেশপুর স্কুলে ভর্তি (১৬ জানুয়ারি ১৯৮৫) হওয়ার পর। স্কুলের বাইরে আমিও তাঁর টিউশনে ছাত্র হয়ে গেলাম ক্লাস সিক্সে। তাঁর সান্নিধ্যে যত এসেছি, ততই তাঁকে অসাধারণ মনে হয়েছে। অধিকাংশ মানুষেরই ভেতর ও বাইরে মুখ ও মুখোশের সম্পর্ক। পণ্ডিতস্যারের মুখোশের চেয়ে মুখটি আরও সুন্দর, আরও মাধুর্যময়, আরও মনীষাদীপ্ত। তাঁর বাকসংযমী প্রকৃতি বিস্ময়াবহ। কখনও তাঁকে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি। যেখানে মানুষের আত্মজাহির প্রকৃতির সজীবতা প্রতিটি মুহূর্তে প্রকাশউন্মুখ, সেখানে স্যারের অবিসংবাদিত পাণ্ডিত্য কখনওই অপরকে মূর্খ বা হেয় প্রতিপন্ন করায় সক্রিয় হয়নি, ভাবলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। এরূপ স্যারের সান্নিধ্যে কিছুকাল আমি পড়েছিলাম। রামকৃষ্ণ পরমহংসের গল্পের আটা-ঘিয়ের চটপটানির শব্দ কীভাবে নীরব হয়ে যায়, তা পণ্ডিতস্যারেই প্রতীয়মান মনে হয়।
Advertisement
স্যার রোজ সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতেন। স্কুল থেকে তাঁর বাড়ির দূরত্ব দশ কিলোমিটারেরও বেশি। মালদার সবচেয়ে দীর্ঘ রুট মালদা-নালাগোলা, ৬২ কিলোমিটার। সেই রুটে যানবাহনের অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও স্যার প্রতিদিন যেভাবে সাইকেলে সওয়ার হয়ে যাতায়াত করতেন, তা ভাবলে তাঁকে আপাতভাবে কৃপণ মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি আদৌ কৃপণ ছিলেন না, ছিলেন মিতব্যয়ী। হয়তো তাঁর আর্থিক দৈনই তাঁকে সংযমী জীবনে অভ্যস্ত করে তুলেছিল। কিন্তু একথা স্মরণীয়, ধনের অভাববোধ সাময়িকভাবে মনের লাগাম ধরে রাখতে পারে, সংযমের অধিকারী না হলে তা সময়ান্তরে লাগামহীন হয়ে পড়ে। স্যার কিন্তু মহেশপুর স্কুলের শেষ দিন পর্যন্ত সাইকেলকেই বাহন করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রয়োজনে পায়ে হেঁটেও স্কুলে গিয়েছেন। আবার আমার মতো অভাজনকেও তিনি সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছেন স্কুলে।
নয়-দশ বছরের ছাত্রটি সাইকেলে ওঠা শেখেনি বলে তিনি অনায়াসেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আমায় উপেক্ষা করতে পারতেন। অথচ তারপরেও তিনি আমায় দিনচারেক সাইকেলে করে স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন। সেকথা ভাবলে আজও কৃতজ্ঞতার অশ্রু আপনাতেই গঙ্গার ন্যায় পবিত্র হয়ে ওঠে। তাঁর ভাষায় ছিল বাঙাল টান। ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে তাঁর সরস বাচনভঙ্গি ‘রামা-শ্যামা-মাইনক্যা-গোদা’তো ব্র্যান্ড হয়ে রয়েছে। ‘তুই সাইকেলেও উঠতে পারস না’ বলে ভর্ৎসনা করার পরেও তিনি যেভাবে হাত বাড়িয়ে আমায় সেদিন সাইকেলে ওঠা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে তাঁর দরদি মনের পরিচয় শুধু উঠে আসেনি, সেই সঙ্গে তাঁর মহত্ত্বের পরিচয়টিও সংগুপ্ত থাকেনি। পিতৃহারা দীনহীন অতি সাধারণ মানের একটি ছাত্রকে তাঁর মতো একজন উচ্চমানের শিক্ষক কেন নিজের সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাবেন এবং তাও আবার একাধিক দিন ধরে, বিষয়টি এতদিন পরেও মেলাতে পারি না। তখন সামনে ভগবান, পিছনে ভাগ্যবান। সেই সৌভাগ্য যে আমার মহার্ঘ সঞ্চয়। স্যারের সেই সহজতার মধ্যেই তাঁর মহত্ত্ব আমি পরবর্তীতেও লক্ষ্য করেছি। অন্যদিকে তিনি বাইরের কোনো খাবার কখনওই মুখে তুলতেন না। এতে অবশ্য তাঁর ব্রাহ্মণত্ব জাহিরের পরিচয় ভাবলে ভুল হবে। এও তাঁর স্বরচিত খাদ্যাভ্যাস।
আমাদের বাড়িতে একদিন দুধ-বিস্কুটও খেয়েছিলেন। অন্যদিকে স্যার ছিলেন ভোজনরসিক। যে মানুষটি দীর্ঘপথ সাইকেলে বা পায়ে হেঁটে পাড়ি দেন, সেই তিনিই আবার কলোনি থেকে খাঁটি দুধ কিনে নিয়ে যেতেন। তাঁর বাড়িতে গিয়ে পেয়েছি ফলাহারসহ সমাদর। আবার এই শ্রদ্ধেয় মানুষটিকেই কতভাবেই না ভুল বোঝার মাশুল গুনতে হয়েছে। কিছু মুখে না তোলার জন্য তাঁকে স্কুলের সহকর্মীদের কাছে অপ্রিয় হতে হয়েছে, ব্যঙ্গের খোরাকও কম হতে হয়নি। সামজিকভাবে অভ্যস্ত মানুষ ব্যতিক্রমীকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে কখনওই ভালো চোখে দেখে না। শুধু তাই নয়, তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবোধে অসামাজিক বলে দেগে না-দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তিবোধ করে না! অথচ সেই কতিপয় ব্যতিক্রমী মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দিশারি হয়ে ওঠে।
স্যার ছিলেন স্কুলঅন্তপ্রাণ। শুধু তাই নয়, তাঁর স্কুলের প্রতি দায়বোধ আমি অনেক শিক্ষকের মধ্যেই লক্ষ্য করিনি। ব্যক্তিগত স্তরে শিক্ষক হিসাবে সংযুক্ত হয়ে স্কুলকেই ধন্য করে তুলেছেন, এরকম একটা ধারণা অধিকাংশ শিক্ষাগর্বী শিক্ষকের থাকে। স্যারের মধ্যে তা ছিল না। একদিন কলোনির পীরতলায় প্রাইভেট পড়ার সময় আমি সখেদে মহেশপুর স্কুলের হীনতা নিয়ে সরব হতেই স্যারের তীব্র ভর্ৎসনা আমায় বাণবিদ্ধ করে তোলে— ‘যে-স্কুলে পড়িস, তারই দুর্নাম করছিস! লইজ্জা করে না।’ এই একবারই স্যারের রোষের পরিচয় পেয়েছি এবং তার বর্ষণে আমার অশ্রু বেয়ে মনের গ্লানি সেদিন ধুয়ে গিয়েছিল। ক্লাস সিক্সে স্যার আমাদের জীবনবিজ্ঞান পড়াতেন । স্যারের পড়ানো আমার মনে নেই। তবে তা যে মনোহারী ছিল না, তাও স্বীকার্য। ক্লাস সেভেনে তাঁর সংস্কৃত পড়ানোয় আমি বিশেষ কিছু শিখতে পারিনি। বরং সংস্কৃতেই আমি সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছি।
স্যারের পড়ানো ভালো না লাগলেও তাঁর ফল্গুধারার ন্যায় ভালোবাসা আমার খরতপ্ত জীবনে শীতলতা প্রদান করেছে। আসলে পড়ানোর উপরেই শিক্ষকদের ভূমিকা নিঃশেষ হয়ে পড়ে না। তাঁদের দরদি মনের পরশ যেমন সেখানে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনই ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল উদার হাতছানিও আবেদনক্ষম মনে হয়। এজন্য পড়ার বইয়ের বাইরের পড়া, তথা জীবনবোধের পাঠ সেখানে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে। ক্লাস সিক্সে যখন আমার পড়াশোনার জীবনে মোড় ফেরার পালা, তখন স্যারের আন্তরিক পরশ আমাকে প্রথম রোমাঞ্চিত করেছিল। ফণীস্যার তাঁর ভূগোল ক্লাসে একদিন পড়া না পারায় স্টাইপেন্ড পাওয়ার তুলনা প্রসঙ্গে ব্যঙ্গ করে বলেন— ‘পড়া পারে না, কিচ্ছু পারে না। আবার স্টাইপেন্ড পাবে!’ পরে জেনেছি পিতৃহীনতার প্রতি করুণা প্রদর্শন করে স্যারদের সুপারিশে আমার মাসিক ষাট টাকা করে সরকারিভাবে স্টাইপেন্ডের বন্দোবস্ত হয়েছিল।
জানি না তাতে পণ্ডিতস্যারের হাত ছিল কিনা। এনিয়ে কোনোদিন কিছু বলেননি তিনি। তবে যেদিন তিনি কলোনিতে সাইকেল থেকে নেমে আমায় বললেন, ‘তুই বিজ্ঞানে ৫৮ পাইছিস, সেকেন্ড হইছিস’, সেদিন বুঝেছি স্যারের মনটি কত নরম, কত মরমী। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্টের পূর্বে এভাবে নম্বর বলা সমীচীন নয়। অথচ স্যার তাঁর অনাদৃত অনাথ ছাত্রটির মনে একটু প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করতেও দ্বিধা করেননি। স্যারের এরূপ মহার্ঘ স্মৃতি অনেক ছাত্রছাত্রীদের অমূল্য সঞ্চয় হয়ে রয়েছে। আসলে স্যার জীবনকে কৃত্রিমতার আভিজাত্যে নয়, সহজতার বনেদিয়ানায় অনাবৃত করার মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছিলেন যা সময়ান্তরে অতিদ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। জেনেছিলাম স্যার প্রতিদিন মর্নিংওয়াক করেন। তাঁর বাড়ির সামনে কোনও মাঠ বা ফাঁকা রাস্তা না থাকায় কীভাবে তিনি হাঁটেন তা আমার বড়ই কৌতূহল জাগে। স্যার বলেন, বাড়ির সামনে একচিলতে ফাঁকা জায়গায় বিশ পাক দিলেই তো মাইলখানেক হাঁটা হয়ে যায়। তাঁর সহজতার মধ্যেই রয়েছে গণেশের পিতা-মাতার মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দর্শনের ধারণা।
স্যার কত সহজে তাঁর পাণ্ডিত্যের গুরুভারকে লঘু করে নিতে পেরেছেন, তা যত ভাবি, ততই বিস্ময় জাগে। রসসাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর স্বসম্প্রদায়কে তিন ফুঁ-এ চিহ্নিত করেছেন। যথা, শাঁখে ফুঁ অর্থাৎ পূজারী ব্রাহ্মণ, কানে ফুঁ অর্থাৎ গুরুদেব ব্রাহ্মণ এবং উনুনে ফুঁ অর্থাৎ পাচক ব্রাহ্মণ। স্যার সেগুলিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে শিক্ষকতার মহানব্রতে আজীবন নিমগ্ন ছিলেন। অবসর জীবনেও টিউশনি পড়িয়েছেন, আমৃত্যু কষ্টে জীবন নির্বাহ করেছেন, কিন্তু কোনোরকম ফুঁ-তে আত্মনিয়োগ করেননি। তাঁর আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রখর। স্কুলের কৃত্রিমতামণ্ডিত সংবর্ধনাকেও তিনি উপেক্ষা করেছিলেন। অথচ আমাদের প্রাণের ডাকে সাড়া দিয়ে কলোনিতে এসেছিলেন বিদায় সংবর্ধনা নিতে। তাঁকে সংবর্ধনা প্রদানে আদতে আমরাই সংবর্ধিত হয়েছিলাম। তাঁকে সংবর্ধিত করার সাধ্য আমাদের নেই, তা তিনিই সংগোপনে বুঝিয়ে চলেছেন। কেননা তিনি যে আমাদের মনেই ক্রমবর্ধমান।
Advertisement



