• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বাংলা বলে কোনও ভাষা নেই, দাবি অমিত মালব্যর, ধিক্কার বিদ্বজ্জনেদের

অমিত মালব্য সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘বাংলা নামে কোনও ভাষা নেই।’ তৃণমূল কংগ্রেস এর পাল্টা জবাব দিতে দেরি করেনি।

একদিকে ভিনরাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের উপর আক্রমণ, অন্যদিকে এবার বাংলাভাষার উপর আক্রমণ। এটা যে বিজেপির সুপরিকল্পিত কর্মসূচি, তা এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। প্রত্যেকদিনই প্রকাশ্যে আসছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে কীভাবে বাংলার শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এই শ্রমিকরা অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান হলেও নির্যাতিতদের মধ্যে হিন্দু শ্রমিকও আছেন। দিল্লি, হরিয়ানা, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী শ্রমিকদের পুলিশ যখন ইচ্ছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে বয়ান দিতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

কিন্তু একজন ভারতীয় নাগরিক কেন নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক বলবেন? শ্রমিকরা তাঁদের সমস্ত রকম পরিচয়পত্র দেখালেও সেসব ধর্তব্যের মধ্যে না এনে, কখনও বা সেসব ছিঁড়ে ফেলে তাঁদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও দাবি করা হচ্ছে। টাকা পেলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ছেড়ে দিচ্ছে পুলিশ। আর তা না পেলে কিংবা নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবে বয়ান না দিলে তাঁদের উপর রীতিমতো শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ। উত্তরবঙ্গের গোয়ালপোখরের দুই শ্রমিকের পা মেরে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অনেককে বাংলাদেশের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে। পরে তাঁরা বাংলার স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ঘরে ফিরতে পেরেছেন।

Advertisement

এতসব ঘটনার পরেও বাংলার বিজেপির শীর্ষ নেতারা এইসব ঘটনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে চলেছেন। তাঁদের দাবি, অন্য রাজ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশি নাগরিকদেরই ধরা হচ্ছে। কখনও কখনও বাংলাদেশি নাগরিক ধরা পড়ছে ঠিকই কিন্তু পশ্চিমবাংলার এত যে শ্রমিক ভিনরাজ্যে নির্যাতিত হচ্ছেন, তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে বিজেপি। বরং তাঁদের দাবি, ১ কোটি ২৫ লক্ষ রোহিঙ্গা শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই ঢুকে পড়ে বসবাস করছে। প্রকৃত তথ্য হল, সারা পৃথিবীতে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মাত্র ১৬ লক্ষ। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি ২৫ লক্ষ রোহিঙ্গা কোথা থেকে এল? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনও মাথাব্যথাই বিজেপি নেতাদের নেই। অদ্ভুতভাবে তাঁরা ক্রমাগত এই মিথ্যাটি প্রচার করেই চলেছেন। আর তাঁদের সমস্ত প্রচার এতটাই ব্যাপক যে, অনেক সাধারণ মানুষ তাঁদের কথায় প্রভাবিতও হচ্ছেন। আসলে, এ সেই গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারের তত্ত্ব। যে কোনও মিথ্যাকেই বড় আকারে ক্রমাগত বলে গেলে মানুষ তা বিশ্বাস করে নেয়।

Advertisement

এবার সেই মিথ্যাকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন বিজেপি নেতা অমিত মালব্য। সম্প্রতি দিল্লির লোদি কলোনি থানার পুলিশ অফিসার অমিত দত্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গভবনের অফিসার ইনচার্জকে। সেখানেই বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি’ ভাষা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে রাজ্যের কংগ্রেস ও বামপন্থী নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। প্রথমেই সেই বিতর্কে এবার ঘি ঢাললেন বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য।

তিনি সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘বাংলা নামে কোনও ভাষা নেই।’ তৃণমূল কংগ্রেস এর পাল্টা জবাব দিতে দেরি করেনি। তৃণমূল জানিয়েছে, ‘কড়ায় গণ্ডায় বিজেপি এর জবাব পাবে।’ অমিতের বক্তব্য, অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার জন্য দিল্লি পুলিশ বাংলাদেশি ভাষা উল্লেখ করে ঠিক কথাই বলেছে।’ অমিতে বক্তব্য, ‘বাংলাদেশের সরকারি ভাষা কেবল ধ্বনিগতভাবেই আলাদা নয়, বরং সিলেটির মতো উপভাষাও রয়েছে যা ভারতীয় বাঙালিদের কাছে বোধগম্য নয়। আসলে, বাংলা নামে কোনও ভাষা নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বাঙালি একটি জাতির নাম কোনও ভাষা নয়।’

এদিকে পশ্চিমবঙ্গেও একই সুরে কথা বলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, ‘দিল্লি পুলিশ একদম ঠিক শব্দ প্রয়োগ করেছেন। বাংলাদেশের একটা বই পড়ুন আর পশ্চিমবঙ্গের একটা বই পডুন। কোনটা সুবোধ সরকার লিখেছেন আর কোনটা শফিকুল ইসলাম লিখেছেন সেটা পড়লেই বোঝা যায়। সুতারাং বাংলায় কথা বললেই যে সে ভারতীয় হয়ে যাবে এমন কথা নেই।

বাংলাভাষা সম্পর্কে অমিত মালব্য ও শমীক ভট্টাচার্যের অজ্ঞতা যে কত গভীর তা বোঝার জন্য ভাষাতাত্ত্বিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবুও এই প্রসঙ্গে ভাষাতাত্ত্বিক পবিত্র সরকারের মতামত দেখে নেওয়া যাক। তিনি বলেছেন, ‘মুর্খতার কোনও বিকল্প হয় না। আমি এই ধরনের অশিক্ষিত কথাবার্তা একজন আইটি সেলের প্রধানের কাছে আশা করিনি।’

বাংলাভাষা সম্পর্কে অমিত মালব্য তথা বিজেপির এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃত পক্ষে বাংলা ভাষা সম্পর্কে বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। হাজার বছরের প্রাচীন বাংলা ভাষা ভারতের একটি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং ভারত সরকার স্বীকৃত ধ্রুপদী ভাষা। তাকে এইভাবে অস্বীকার করতে চাওয়া আসলে বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি বাঙালি জাতিসত্তাকেই অস্বীকার করতে চাইছে বিজেপি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের জাতীয় সংগীতকে ‘সংস্কৃতায়িত বাংলা’ বলে বাংলাভাষাকেই অস্বীকার করতে চাওয়ার অমিত মালব্য তথা বিজেপির এই অপচেষ্টাকে ধিক্কার জানিয়েছেন বাংলার অধিকাংশ বিদ্বজ্জনেরা।

Advertisement