সোমনাথ ব্যানার্জি
গঙ্গার ধারে সুন্দর পরিচ্ছন্ন ও শান্তিময় ছোট্ট শহর চন্দননগর। চন্দননগরের সুদর্শন যুবক যদুনাথ পালিত তিনি কয়েকজন যুবককে নিয়ে তৈরি করলেন নাটকের দল। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই কোন এক
অজ্ঞাত কারণে বন্ধ
Advertisement
হয়ে গেল থিয়েটার। গতানুগতিক জীবনযাত্রার দিন না কাটিয়ে তিনি ১৮৭৩ সালের পয়লা অক্টোবর থিয়েটার দলের আসবাবপত্র বিক্রির টাকা এ কিছু নতুন বই কিনে বন্ধুবান্ধবদের কিছু পুরাতন বই নিয়ে চন্দননগরে উর্দি বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাড়ির দোতলায় শুরু করলেন একটি সাধারণ গ্রন্থাগার যার নাম চন্দননগর পুস্তকাগার।
Advertisement
প্রতিষ্ঠালগ্নে যদুনাথ পালিতের সহযোদ্ধারা হলেন হরিমোহন সুর, মহেন্দ্রনাথ নন্দী, প্রমথনাথ মিত্র, প্রমথনাথ বিশ্বাস, মতিলাল শেঠ, প্রমুখ। সেদিনের প্রতিষ্ঠাতারা ভাবতেও পারেননি যে এই পুস্তকাগার সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে সমৃদ্ধির শিখরের দিকে এগিয়ে চলবে নিজের ছন্দে ও গতিতে।
চন্দননগর পুস্তকাগার প্রথমে উর্দিবাজার এলাকার একটি ভাড়া বাড়ির দোতলায় প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী পরিস্থিতিতে পাঁচবার ঠিকানা বদল করতে হয়েছে। ১৮৮৯ সালে নিচুপটির অদৈত্ব প্রেসের দোতলায়, পরে কাঁসারিপটির অন্য একটি বাড়ির দোতলায়। ১৮৯৯ সালের উর্দি বাজার এলাকার প্রজাবন্ধু অফিসে চন্দননগর পুস্তকাগারের স্থানান্তর হয়। আবার ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। চন্দননগর নিবাসী তিনকড়িনাথ বসুর তত্ত্বাবধানে জি টি রোডের ধারে একটা প্রশস্ত বাড়িতে ঠাঁই হল পুস্তকাগারের। চন্দননগরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ দানবীর দেশশ্রী হরিহর শেঠের বদান্যতায় ১৯২০ সালে ২৩ শে মে চন্দনগর পুস্তকাগারের নিজ বাড়ির শুভ উদ্বোধন হলো। গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। বাড়িটি দুটি অংশের একটি অংশে নিত্যগোপাল স্মৃতি মন্দিরে সভা সমিতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য অডিটোরিয়াম অপর অংশটি চন্দননগর পুস্তাগার। সেই গ্ৰন্থাগার ১৫২ বছর অতিক্রম করল। আজ প্রায় সত্তর হাজার বই যেখানে ফরাসি সাহিত্য, তুলোট কাগজের পুঁথি, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সম্ভারের সমৃদ্ধ চন্দননগর পুস্তাকাগার। বর্তমানে সাধারণ বিভাগ, কিশোর বিভাগ, রেফারেন্স বিভাগ, গবেষণা বিভাগ, প্রকাশনা বিভাগ, চন্দননগর উপ সংশোধনাগারে গ্রন্থাগার পরিষেবা বিভাগ ইত্যাদির মাধ্যমে চন্দননগর পুস্তকাগার জ্ঞান এবং তথ্য সরবরাহ পরিষেবায় নিয়োজিত।
এই পুস্তকাগার যাদের পদার্পণে ধন্য তাঁরা হলেন বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, স্যার যদুনাথ সরকার, শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডাক্তার প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, ড দীনেন্দ্রনাথ সেন, সরলা দেবী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং আরো অনেক জ্ঞানীগুণী সাহিত্যিক।
২০১৭ সালে চন্দননগর পুস্তকাগার পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মডেল লাইব্রেরী হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়— এই মহকুমা গ্রন্থাগারটিতে বর্তমানে প্রচুর বই এবং অ- বই সংগ্রহ করা হচ্ছে। ক্রয় এবং দানের মাধ্যমে নথির বিকাশ অব্যাহত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক গত ৩১/৮/২০১৯ তারিখে কলকাতা নজরুল মঞ্চে মহকুমা/শহর গ্রন্থাগার হিসাবে হুগলি জেলার সেরা গ্রন্থাগার সম্মান ২০১৯ পুরস্কার লাভ করে। বাৎসরিক পত্রিকা প্রতি বছর ১লা অক্টোবর প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি গ্ৰন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম – রবীন্দ্রনাথ ও চন্দননগর, চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, চন্দননগর দর্পণ এবং বাংলা সাহিত্যের নবীন প্রবীণের যুক্তবেণী।
গ্রন্থাগার পরিষেবার স্বার্থে বিভিন্ন সক্রিয় সদস্য সদস্যদের নিয়ে উপসমিতি গঠন এর মাধ্যমে গ্রন্থাগার পরিষেবা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে আমরাই প্রথম লাইব্রেরী লাভার্স গ্রুপ (এল এল জি) গঠন করা হয়েছে, যারা স্বেচ্ছায় গ্রন্থাগার পরিষেবায় নিয়োজিত আছেন। দেবদত্তা রায় ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার পরিষেবা চালু হয়েছে গত কোভিডের সময়। বর্তমানে দেবদত্তা রায় আর্কাইভস চালু আছে। চন্দননগর উপ-সংশোধনাগারে গ্রন্থাগার পরিষেবা চালু করা হয়েছে। ১৫ দিন ছাড়া উপ সংশোধনাগারের আবাসিকদের চাহিদা অনুযায়ী বই সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে তাদের মনের বিকাশ ঘটতে পারবে এটাই চন্দননগর পুস্তকাগারের লক্ষ্য। সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে চন্দননগর পুস্তকাগারের উদ্যোগে অনেকগুলি কর্মসূচি গ্ৰহণ করা হয়েছিল। একুশে জানুয়ারি ২০২৩ সকাল নটায় চন্দননগর পুস্তকাগারের সার্ধশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে চন্দননগর পুস্তকাগার ভবন থেকে বইয়ের জন্য হাটুন এই ডাক দিয়ে পদযাত্রা সংগঠিত হয়। চন্দননগর পৌর নিগমের মহানাগরিক শ্রীরাম চক্রবর্তী, চন্দননগরের মহকুমা শাসক শ্রী অয়ন দত্তগুপ্ত এবং অন্যান্য আধিকারিক ও জনপ্রতিনিধিরা এই পদযাত্রায় পা মেলান। চন্দননগর এলাকার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, এলাকার আপামর জনসাধারণ সহ প্রায় এক হাজার জন গ্রন্থ প্রেমিক মানুষজন এই পদযাত্রায় সামিল হয়েছিল। এই পথযাত্রার ফলে অনেকেই পরবর্তীকালে চন্দননগর পুস্তকাগারের সদস্যপদ গ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। ২৩ এপ্রিল ২০১ বিশ্ব বই দিবস উপলক্ষে একটি মনোগ্য আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভার বিষয় ছিল একটি বই। ২৮ মে ২০২৩ পঞ্চ কবিকে স্মরণ এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। বাংলা চির স্মরণীয় পঞ্চ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেনকে শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ করা হয়। ২৩-২৫ জুন ২০২৩ শিশুদের জন্য বইমেলা, লিটিল ম্যাগাজিন মেলা এবং দেড়শ বছরের ইতিহাস সমন্বিত দুষ্প্রাপ্য বই, পুঁথি-নথির একটি সুন্দর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। জুলাই আগস্ট ২০২৩ অনিমা দাস স্মৃতি সারা বাংলা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় চন্দননগর পুস্তকাগারের উদ্যোগে প্রায় ৮৫৬ জন প্রতিযোগী এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৩ই আগস্ট ২০২৩ চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে ভারতের গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের জনক ডক্টর এস আর রঙ্গনাথনের জন্ম জয়ন্তী সাড়ম্বরে পালিত হল গ্রন্থাগারিক দিবস হিসেবে। ইয়াসলিক, বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ এর আয়োজনে ও রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরী ফাউন্ডেশন-এর সহযোগিতায় চন্দননগর পুস্তকাগার এবং চন্দননগর পৌরনিগমের ব্যবস্থাপনায় এই গ্রন্থাগার দিবস উদযাপিত হয়। গ্রন্থাগারিক দিবসে আলোচনার বিষয় ছিল শিশু মনের বিকাশে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের ভূমিকা। বক্তা ছিলেন শিশু সাহিত্যিক ডঃ প্রার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, অধ্যাপক সত্যাজিৎ গোস্বামী এবং প্রাবন্ধিক দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়। ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ গ্রন্থ গ্রন্থাগার ও অরবিন্দ শীর্ষক একটি মূলজ্ঞ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এই আলোচনা সভার বক্তব্য রাখেন বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, মহানগরিক শ্রী রাম চক্রবর্তী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী অলকানন্দ রায় ও তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটি অসামান্য নৃত্যানুষ্ঠানও ওই অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। অক্টোবর ২০২৩ চন্দননগর রবীন্দ্রভবনে প্রদীপ প্রজননের মধ্য দিয়ে সার্ধশতবর্ষ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি অনুষ্ঠান শুরু হয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহানগরিক শ্রীরাম চক্রবর্তী, জেলা গ্রন্থাগারের আধিকারিক ডক্টর ইন্দ্রজিৎ পান সহ আরো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। উপস্থিত ছিলেন বি এল এ-র কর্মসচিব জয়দীপ চন্দ। জেলা গ্রন্থাগারিক তাপস চক্রবর্তী, মধুসূদন চৌধুরী এবং শমিক বর্মন রায় সহ বিশিষ্টরা। বক্তৃতা অনুষ্ঠানে গ্রন্থাগার পরিষেবা বিষয়ক দেবদত্তা স্মারক বক্তৃতা প্রদান করা হয়। সেরা পাঠক পাঠিকা ও জেলার বিভিন্ন গ্রন্থাগারিক এবং পুস্তাগারের প্রাক্তন কর্মীদের সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।
চন্দনগর পুস্তকাগার তার সার্ধশতবর্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মহকুমা ছাড়িয়ে জেলা তথ্য সারা রাজ্যে নানা পরিষেবায় সমৃদ্ধ অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থাগার হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। এই ভাবেই এলাকার জনসাধারণের মধ্যে পঠনপাঠন ও তথ্য চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। প্রাচীন গ্রন্থাগার হিসাবে চন্দননগর পুস্তকাগার আগামী দিনে শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে শুধু চন্দননগরে নয় একদিন দেশের অন্যতম সেরা গ্রন্থাগার হিসাবে স্বীকৃতি পাবে এই আশা রাখি।
Advertisement



