• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

এক দাবিহীন বাঁশিওয়ালা

আমরাও যেন আমার আমিকে বাংলাতেই খুঁজে পাই!

ফাইল চিত্র

সৌরাংশু

যে লোকটা সারা বছর বাংলাকে ভুলে থাকতে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হিন্দি বা ইংরাজিতেই কথা বলেন, যে মহিলা বাংলা গানের অনুষ্ঠানে চিৎকার করে বলেন ‘হিন্দি! হিন্দি!’, যে ছেলেটা প্রেমদিবসে নিবেদনের ভাষা যুৎসই ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’য় খুঁজে পায়। যে মেয়েটা ‘ইউ নো’ ‘লাইক’ দিয়ে ইংরাজিতে মেহতাব-আফতাব এক করে, সেই প্রবাসী, সেই বৃত্তের বাইরের জন্মসূত্রের বাঙালিও যখন পাড়ার উইকএন্ডের পুজোর মঞ্চে ৫ লাখি কলকাত্তাইয়া শিল্পীর চটুল হিন্দি এবং ভাবহীন রবীন্দর সংগীতের শেষে ‘আমি বাঙালি’ মার্কা র‍্যালায় গেয়ে ওঠা যে গানটায় গলা মেলায়, সেই গানটি সৃষ্টি করেছিলেন যিনি তিনি ছোট্টখাট্টো চেহারার এক প্রায় অপাঙ্‌ক্তেয় চেহারার এক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কে কাজ করা মানুষ।

Advertisement

উল্টোডাঙার রাস্তায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে একটা ছোট্ট বাজারের থলি হাতে, আনমনে সরু গলায় গান গাইতে গাইতে ঢোলা শার্ট বা পাঞ্জাবি আর পাজামায় সকাল সকাল কতজনই যে দেখেছি। পালটে যাওয়া সময়ে তখন সুমন নচিকেতা অঞ্জন বাজার মাত করে আছেন। হঠাৎ প্রতুলবাবুর একটা ক্যাসেট সমস্ত হিসাবেও কেমন জানি না ঠাণ্ডা বাতাস বইয়ে দিয়েছিল।

Advertisement

হতে পারে যে গানটার কথা বলছি, অথবা ‘আমি এতো বয়সে গাছকে বলছি’ অরুণ মিত্র অথবা ‘লং মার্চ’ কিংবা ‘ডিঙ্গা ভাসাও’। বিশেষত অরুণ মিত্রের কবিতার সুর দেওয়া গানটা আমার নিজেরই সবথেকে পছন্দের ছিল।

তবুও কেমন করে জানি না, একটা ফসিল হবার পথে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া ভাষার আপামর মরণশীল জনগোষ্ঠীর আত্মার আত্মিক সঙ্গীত হয়ে দাঁড়াল গানটা। বাংলার মুখ সেই এক কবি দেখে গেছিলেন তারও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, তাঁর আকস্মিক মৃত্যু ঘটে ট্রাম দুর্ঘটনায়ই। আর সেই কথাগুলোই এক নীরব ভাষাকর্মীর কলম ছুঁয়ে তারও পঞ্চাশ পঁচাত্তর বছর পর বাংলার মুখ খুঁজে চলি আমরা।

পচনশীল সমাজ, যেখানে রাজনীতি এবং ধান্দাবাজি ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সমগ্র সংস্কৃতিকে, সেই মরা খাতেও স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পরি নাচাতে এসেছিলেন এক দাবিহীন বাঁশিওয়ালা। তাঁর আড়বাঁশিতে ছিল না হ্যামলিনের টান, ছিল না অমরত্বের প্রত্যাশা অথবা লাল ফিতে সাদা মোজার ইউনিফর্ম। তবু কেমন করে যেন বাংলাকে একবার দেখার আশায় বাংলাকে ভুলে থাকা লোকগুলোও ওই একটা গানেই নিজেকে খুঁজে পেল, এবং এখনও পায়।

বিবিসি একটা র‍্যাঙ্কিং করেছিল সেরা বাংলা গানের। সেখানে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ষষ্ঠ স্থান পেয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে সর্বকালের ষষ্ঠ জনপ্রিয় বাংলা গান বাঙালির জনমনের সঙ্গীত সেটি।

বর্তমানে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’-কে বাঙালির ‘জাতীয়’ সঙ্গীত করে তোলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু গোকুলে যে অন্য গান বেড়ে উঠে হৃদয়াসন আগেই দখল করে নিয়েছে!

ভদ্রলোক মারা গেলেন এসএসকেএম হাসপাতালে। সাধারণ জীবন, সাধারণ যাপনের ঊর্ধ্বে উঠেও তিনি অমর হয়ে গেলেন। এক নজরে যাঁকে চোখে পড়ে না, এক নিঃশ্বাসে যাঁর ঘ্রাণ আসে না, তিনিই পঞ্চভূতে বিলীন হবার আগেই আপামর বাঙালির মনের মধ্যে জায়গা করে নিলেন।

বিদায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আপনার দৃপ্ত শ্লোগান আপনার তৃপ্ত শেষ চুমুকই আমাদের আশার আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলতে থাকুক। আমরাও যেন আমার আমিকে বাংলাতেই খুঁজে পাই! এক সাধারণ ভাষা সৈনিকের সশ্রদ্ধ প্রণাম!

Advertisement