• facebook
  • twitter
Sunday, 21 December, 2025

অঙ্গবাণিজ্য: মানুষের অসহায়তার ফায়দা

২০২৩ সালে গোটা দেশে জীবিত মানুষ দ্বারা দানের মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ১১৭৯১। বিপরীতে মরণোত্তর দানের মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৬৩৫ জন। আবার ধরা যাক আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। ২০২৩ সালে মরণোত্তর অঙ্গদান হল মাত্র ১৬টি। অথচ জীবিত দাতার সূত্রে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছিল ১০২১টি।

প্রতীকী চিত্র

সুজন ভট্টাচার্য

সংবাদ মাধ্যমেই জানা কয়েকদিন আগের ঘটনাটা। হাওড়া জেলার একজন অধিবাসী দ্বারস্থ হলেন হাইকোর্টের। তার আবেদনটি শুনলে মাথা খারাপ হবার উপক্রম হবে। ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন তিনি। যে কোনো কারণেই হোক সংসার চলছে না। স্ত্রীর পরামর্শে কিডনি বেচে দিলেন। হাতে এল দশ লাখ টাকা। স্বপ্ন দেখছেন, সুস্থ হবার পর এই পুঁজি নিয়ে নতুন করে বাঁচবেন। অকস্মাৎ মাথায় বজ্রাঘাত। পুরো টাকাটা মেরে দিয়ে স্ত্রী পালিয়ে গেলেন অন্য একজনের সঙ্গে। থানার শরণাপন্ন হলেন ভদ্রলোক। এখন তাঁর অভিযোগ, বারবার পুলিশ তাঁকেই বিরক্ত করছে। অথচ যারা টাকা মেরে পালাল, তাদের টিকিটিও ছুঁয়ে দেখছে না। সব শুনে মহামান্য হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে বক্তব্য জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

Advertisement

অভিযুক্ত ভদ্রমহিলার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু সমস্যার মূলে পৌঁছতে হলে নজরটা অন্যদিকে দেওয়া প্রয়োজন। টাকা মেরে দেবার ঘটনাটা ঘটতে পারল কেন? অভিযোগ সত্যি হলে অভিযোগকারী কিডনি বেচতে পেরেছেন বলেই হাতে নগদ মিলেছিল। কাকে বেচেছেন? নিঃসন্দেহে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়েছে, এমন কাউকেই। কিন্তু এ তো আর বাড়ির পুরনো আলমারি কিংবা ফ্রিজ বিক্রি নয় যে ঠেলাগাড়ি ডেকে তুলে দিলাম! কিডনি শরীর থেকে অপারেশন করে বের করতে হয়। তার জন্য উপযুক্ত হাসপাতাল লাগে, প্রশিক্ষিত চিকিৎসক লাগে। সবথেকে বড় কথা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাই। আর সেই অনুমতি দেওয়া হয় ভারতের অঙ্গদান আইনের ভিত্তিতে। সেই আইনে স্পষ্টভাষায় বলা আছে, অঙ্গদানের ক্ষেত্রে কোনো আর্থিক লেনদেন চলবে না। তাহলে? কিভাবে কিডনি বিক্রি হতে পারল?

Advertisement

এইখানেই যাবতীয় রহস্য। অবশ্য রহস্যটিও খুব মারাত্মক রকমের জটিল নয়। যার কিডনি খারাপ হয়ে গেল, ডায়ালিসিসের ভরসায় অনন্তকাল কাটানো সম্ভব নয়। প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি প্রয়োজন। হয়তো বাড়িতে, পরিবার বা আত্মীয়বন্ধুদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে পারেন। মরণোত্তর অঙ্গদান হলে কিডনি মেলবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তার সংখ্যাও তো হাতে গোনা। কবে পাওয়া যাবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। অসুস্থ মানুষটিরও বাঁচবার স্বপ্ন রয়েছে, অধিকারও আছে। তাই তিনি বা তার পরিবার লেগে গেলেন ঘুরপথে কিডনি দাতা যোগাড়ের কাজে। কিন্তু তিনি এমন দাতা পাবেন কোথায়? সংবাদপত্রে কিংবা সমাজমাধ্যমে তাই এমন বিজ্ঞাপন মাঝেমধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়।

আবার উল্টোদিকে বেশকিছু মানুষও আছেন যারা মোটা টাকার বিনিময়ে একটা কিডনি বেচে দিতে রাজি। কারণ দারিদ্রের সাময়িক অবসান। কিন্তু এই ক্রেতাবিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেবে কে? আছে, আছে। দালালচক্র এখানেও আছে। খবরের কাগজেই মাঝেমধ্যেই দেখবেন পুলিশি হানার সংবাদ, গ্রেপ্তারের গল্প। তারপর অবশ্য কী হল, কেউ জানে না। যাই হোক, দালালরা নাহয় যোগাযোগ করিয়ে দিল। তারপর? বিস্তর কাগজপত্রের ঝামেলা আছে, আছে নির্ধারিত অথরাইজেশন কমিটির সম্মতির প্রশ্ন। সেগুলো তো হাসপাতালকেই ব্যবস্থা করতে হয়। কাগজ সামলানোর সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি টের পান না এখানে টাকাপয়সা লেনদেনের গল্প আছে! কিংবা অথরাইজেশন কমিটি? অবশ্য গতবছর রাজস্থানে তদন্ত্রের সূত্রে জানা গিয়েছিল, অথরাইজেশন কমিটির মিটিং ছাড়াই নাকি একের পর এক কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে।

মোদ্দা বিষয়টা হল আইন যাই থাক, প্রয়োগ তো কর্তার মর্জিসাপেক্ষ। সমাজের সবক্ষেত্রেই সেটাই হয়। তাহলে অঙ্গদানই বা বাদ যাবে কেন? একটা মানুষের বাঁচামরার প্রশ্ন আর আরেকজনের ফুটো পকেট সামলানো। মিঞাবিবি রাজি তো ক্যায়া করেগা কাজি! সাহেব সিনেমাটার কথা মনে পড়ছে? উঠতি গোলকিপার সাহেব বোনের বিয়ের জন্য কিডনি বেচে দিয়ে এল। প্রচুর দর্শক সিনেমাহলে চোখের জল দান করে এসেছিলেন। তখনো অবশ্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ভূমিষ্ঠ হয়নি। ধরা যাক নেপাল। কাব্রে জেলার নামই তো হয়ে গেছে কিডনি উপত্যকা। অসংখ্য দরিদ্র গ্রামবাসী টাকার বিনিময়ে কিডনি বেচে দিয়েছেন। আর সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী সেই দানসাগর যাত্রার লক্ষ্য অবশ্যই এই দেশ।

বলতেই পারেন, কেউ স্বেচ্ছায় বিক্রি করছে, আর কেউ কিনছে স্বেচ্ছায়। তাহলে আপনার মাথাব্যথার কারণ কী? আছে, অবশ্যই আছে। প্রথমত যিনি বিক্রি করছেন, অভাবের কারণেই তিনি আগ্রহী হয়েছেন। ধরে নেওয়াই যায় দারিদ্রের কারণে তার শারীরিক হাল ততটা ভাল নয়। তার কিডনিও তাই একজন সক্ষম মানুষের কিডনির তুলনায় খারাপই হবে ধরে নিতে মেডিকেল বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। ফলত সেই কিডনি যিনি কিনে নিজের শরীরে বসাচ্ছেন, তার পরিণতিই বা কত ভাল হতে পারে? তার থেকেও বড় কথা, কিডনি গ্রহীতাকে যেমন নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়, কিডনিদাতারও থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অভাবের কারণে যিনি কিডনি বেচে দিলেন, তার সুযোগ কোথায় নিয়মিত ডাক্তার দেখানোর? এইজন্যই ইদানিংকালে জীবিত দাতার ওকালতি (Living Donor Advocacy)-র প্রসঙ্গ বারবার আলোচনায় উঠে আসছে। যদিও সেই আলোচনা নিতান্তই সেমিনার রুমের চার দেওয়ালেই আবদ্ধ থাকবে। বাস্তবে প্রয়োগ কোনদিনই সম্ভব নয়, অন্তত বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে।

কিন্তু এই সুযোগ হাতের নাগালে সবাই পাচ্ছে কি করে? ঐ যে, মরণোত্তর অঙ্গদানের ঘাটতি। ভারতে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা নোটো-র হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে গোটা দেশে জীবিত মানুষ দ্বারা দানের মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ১১৭৯১। বিপরীতে মরণোত্তর দানের মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৬৩৫ জন। আবার ধরা যাক আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। ২০২৩ সালে মরণোত্তর অঙ্গদান হল মাত্র ১৬টি। অথচ জীবিত দাতার সূত্রে অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছিল ১০২১টি। তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে মরণোত্তর অঙ্গদান যতই বাড়ূক, জীবিত অবস্থায় কিডনি দান বাড়ছে তার থেকেও চড়া হারে। মরণোত্তর অঙ্গদানের উপযুক্ত প্রসার না ঘটলে তাই অঙ্গবাণিজ্যের অবসান সম্ভব নয়।

Advertisement