শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়
১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর দিনটি ভারতের ইতিহাসের পাতায় আজও স্মরণীয় একটি দিন। এই দিনটি একটি অভূতপূর্ব ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। কারণ এই বিশেষ দিনটিতেই ভারতীয় সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল এবং সংবিধানকে স্বীকৃতি দিয়ে গণপরিষদ তৈরি করা। ভারতীয় নাগরিকরা যাতে স্বাধীন ভোটাধিকার পায়। তাদের হাতেই সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা আসে। আইনের আওতায় যাতে সকলেই সমান ভাবে গৃহীত হয়। সেই জন্যই সংবিধান তৈরি করা হয়েছে। এই সংবিধানের প্রধান মন্ত্র ফর দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। এই সংবিধান হিসেবে ভারতীয় নাগরিকদের ছয়টি মৌলিক অধিকার প্রদান করা হয়েছে এবং সেগুলি হল: স্বাধীনতার অধিকার, সমতার অধিকার শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষাগত অধিকার এবং সবশেষে সংবিধানিক প্রতিকারের অধিকার। ভারতের সংবিধানে এক ধরনের মৌলিক কাঠামো গঠন করা হয়েছে যা কাঠামো ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়। এই কাঠামোকে ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে অভিহিত করা হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে মৌলিক অধিকার, প্রস্তাবনা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নির্দেশমূলক নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ফেডারেলিজম, উদার গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং রিপাবলিকানবাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
Advertisement
ভারতের সংবিধান আবার ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হিসাবেও পরিচিত রয়েছে। এই সংবিধানে বহুকক্ষবিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা গঠন, কার্যপদ্ধতি, আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ, গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্যবাদ, সমকামী অধিকারত্ববাদ, ক্ষমতা ও কর্তব্য নির্ধারণ; মৌলিক অধিকার, নির্দেশমূলক নীতি, এবং নাগরিকদের কর্তব্য নির্ধারণের মাধ্যমে দেশের মৌলিক রাজনৈতিক আদর্শের রূপরেখাটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে ২৮৪ জন সই করলে গৃহীত হয় এবং এই দিনটি জাতীয় আইন দিবস হিসেবে পরিচিত। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই সংবিধান জোরদারভাবে কার্যকরী হয়। ১৯৪৯ সালের এই দিনটির উপর ভিত্তি করেই পরের বছর ২৬ জানুয়ারি দিনটি ভারতের নাগরিক দিবস অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়
Advertisement
ভারত সরকার একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উনিশে নভেম্বর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ২৬ নভেম্বরকে সংবিধান দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১১ অক্টোবর ২০১৫-তে মুম্বইতে বি আর আম্বেদকরের স্ট্যাচু অফ ইকুয়ালিটি মেমোরিয়ালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় এই ঘোষণা দেন। এই দিনটি ছিল আম্বেদকরের ১৩১ তম জন্মবার্ষিকী, যিনি গণপরিষদের খসড়া কমিটির সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং সংবিধানের খসড়া তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আগে এই দিনটি ভারতের জাতীয় আইন দিবস হিসেবে পালিত হত। সংবিধানের গুরুত্ব প্রচার করতে এবং আম্বেদকরের চিন্তা ও ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ২৬ নভেম্বর বেছে নেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর জাতীয় আইন দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তৃতা এবং রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং লোকসভার স্পিকারও এই অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন। ভারতের সংবিধানে মূলত ৩৯৫টি ধারা ছিল। বর্তমানে সংবিধানের একটি প্রস্তাবনা এবং ৪৭০টি ধারা রয়েছে যা ২৫টি অংশে এবং ১২টি তফসিলে বিভক্ত। দুই হাজার কুড়ি সালে সর্বশেষ সংশোধনী সহ এটি ১০৪ বার সংশোধন করা হয়েছে।
সংবিধানে প্রত্যেক ২৫টি ভাগে মোট ৪৭০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ভারতের সংবিধানকে বিশ্বের সবচেয়ে জটিলতম এবং দীর্ঘতম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত ভারতের গণপরিষদ সংবিধানের খসড়াটি রচনা করে। জওহরলাল নেহরু, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নলিনীরঞ্জন ঘোষ এরাই ছিলেন এই গণপরিষদের প্রধান ব্যক্তিত্ব। যাদের দ্বারা পরিচালিত হতো এই সংবিধান। তফসিলি শ্রেণীগুলি থেকে ৩০ জনেরও বেশি সদস্য ছিলেন। ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্টনি ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের, এবং এইচ. পি. মোদী ও আর. কে. সিধওয়া ছিলেন পারসি সম্প্রদায়ের সদস্য। সেই সময় সংখ্যালঘু কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়। অরি বাহাদুর গুরুং ছিলেন তৎকালীন গোর্খা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। বিশিষ্ট জুরি আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী আইয়ার,
বিআর আম্বেদকর, বেনেগাল নরসিং রাউ এবং কেএম মুন্সি, গণেশ মভলঙ্কার প্রমুখেরাও গণপরিষদের সদস্য হিসাবে ছিলেন। আম্বেদকারকে সেই সময় সংবিধানের কর্তা বা জনক বলা হয়।
গণপরিষদের বিশিষ্ট মহিলা সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সরোজিনী নাইডু, হংস মেহেতা, দুর্গাবাই দেশমুখ ও রাজকুমারী অমৃত কৌর। সচ্চিদানন্দ সিনহা ছিলেন গণপরিষদের প্রথম সভাপতি। পরে রাজেন্দ্র প্রসাদ এর নির্বাচিত সভাপতি হন। ভারতের এই সংবিধান তপশিলি জাতি অর্থাৎ সিডিউল কাস্টদের জীবনে এক অন্য মাত্রা এনেছিল। তারা আর প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে পড়তো না। বি আর আম্বেদকর নিজে একজন প্রান্তিক মানুষ বা তপশীল জাতিভুক্ত মানুষ ছিলেন তাই তিনি তপশিলি জাতির উন্নতির সঙ্গে যাতে তারা সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পায় যাতে তারা সাধারণ মানুষের মতো জীবন পায় তার জন্য সংবিধান রচনা করেছিলেন। যে সংবিধান ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিক মেনে চলে। সংবিধানের উপর ভিত্তি করেই স্বাধীন ভারতে দেশের সরকার নির্বাচিত হয়ে আসছে।
Advertisement



