• facebook
  • twitter
Tuesday, 19 August, 2025

মহান আলেকজান্ডারের মোহময়ী আলেকজান্দ্রিয়া

ভুমধ্যসাগরের তীরে হওয়ায় শহরটি সত্যি মোহময়ী। আলেকজান্দ্রিয়া নামটি এসেছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর নাম থেকে...লিখেছেন সুদর্শন নন্দী।

আলেকজান্দ্রিয়া মিশরের এক মিষ্টি শহর। আগে ছিল মিশরের রাজধানী, এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ভুমধ্য সাগরের তীরে (দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত) হওয়ায় শহরটি সত্যি মোহময়ী। আলেকজান্দ্রিয়া নামটি এসেছে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বা মহান আলেকজান্ডার নাম থেকে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বা মহান আলেকজান্ডার ছিলেন প্রাচীন গ্রিক রাজ্য ম্যাসিডনের রাজা, যিনি ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ম্যাসিডনের পেল্লা শহরে। তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুর পর ম্যাসিডনের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন, যা গ্রীস থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পিতা ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ। মাতা অলিম্পিয়াজ।

তিনি গ্রিক শহর-রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করেন এবং পারস্য সাম্রাজ্য, মিশর এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ জয় করেন। তার বিজয়ের মধ্যে ছিল আনাতোলিয়া, সিরিয়া, ফিনিসিয়া, জুডিয়া, গাজা, মিশর, মেসোপটেমিয়া, পারস্য।

আলেকজান্ডারের রাজত্ব ইউরোপ এবং এশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। মাত্র ৩০ বছর বয়সে, তিনি গ্রীস থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত ইতিহাসের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। আলেকজান্ডারের সামরিক অভিযান এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত।

মহান আলেকজান্ডারের জীবনী অনুসারে, তিনি তার বেশিরভাগ যুদ্ধে অপরাজিত ছিলেন এবং ইতিহাসের সবচেয়ে সফল সামরিক কমান্ডার হয়ে ওঠেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে, গাজা অবরোধের পর, আলেকজান্ডার মিশরে প্রবেশ করেন এবং উত্তর উপকূলে, তিনি আলেকজান্দ্রিয়া শহর প্রতিষ্ঠা করেন, যা তাঁর নির্মিত সবচেয়ে সফল শহর।

প্রায় ৮০০০ বছরের মিশরের ইতিহাস বিশ্বের সবচেয়ে সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস রোমাঞ্চে ভরা। নীলনদ, পিরামিড, মমি এসব শব্দগুলি আজ মিশরের সমার্থক বললে ভুল হবে না। মিশর সারা বিশ্বের পর্যটকদের কৌতুহলের শহর। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে নীল নদীর উপত্যকায় প্রথম মানব বসতি স্থাপিত হয়। মিশরের স্থানীয় আদিবাসীদের শাসন খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতক অব্দি বজায় ছিল।

আগেই বলেছি, আলেকজান্দ্রিয়া আজ মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, শহরটি মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে ২২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আলেকজান্ডারের আগমনের আগে আলেক-জান্দ্রিয়া শহরের নাম ছিল রাকোটিস।

৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিশর রোমান সাম্রাজ্যের হাতে আসে। আর ৬৪১এর পর মুসলিম শাসকদের হাতে রোমানদের পতনের মাধ্যমে মিশরে মুসলিম শাসন শুরু হয়। রোমান শাসনকাল থেকেই আলেকজান্দ্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ বণিজ্যিক কুঠিতে পরিণত হয়। মিশর থেকে তখন মালবাহী জাহাজ নিয়মিত ভারত, ইথিওপিয়াসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক নৌবন্দরে যাতায়াত শুরু করে।

মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেকজান্দ্রিয়া শুধু বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবেই নয়, এখানকার মন্তাজ শাসন ব্যবস্থার স্মৃতি, বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ, দুর্গ, বিশ্ববিখ্যাত লাইব্রেরী এসবের জন্যও বিখ্যাত।

এককথায়, শহরের লাইটহাউস তথা বাতিঘর প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি ছিল। লাইব্রেরী তথা গ্রন্থাগারটি প্রাচীন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার জন্য বিখ্যাত ছিল। সারা বছর ধরে পর্যটকদের আনাগোনা।

আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণ মিশর ভ্রমণের সাথেই সেরে নেন পর্যটকেরা। শহরটির আয়তন প্রায় সাড়ে তিনশ বর্গ কিলোমিটার এই শহরের লোকসংখ্যা এখন ৪৫ লাখে উপর। ঘণ্টা তিন বাসযাত্রার কায়রো থেকে আলেকজান্দ্রিয়া শহর। পরিচ্ছন্ন শহর। কখনো ভূমধ্যসাগরের তীর বেয়ে বাস ছুটছে, কখনও ধু-ধু বালি। ভূমধ্যসাগর দর্শনও কম রোমাঞ্চের নয়। আমরা প্রথমে গেলাম মন্তাজা রাজপ্রাসাদে। মন্তাজা আলেকজান্দ্রিয়ার জেলা শহরের নামে পরিচিত। ১৮৯২ সালে এটি তৈরি হয় ভুমধ্যসাগরের গায়ে। তৈরি করেন খেদিভ আব্বাস-২ যিনি মহম্মদ আলি বংশধরের শেষ উত্তরাধিকারি। প্রাসাদ চত্বরের বাগানটি খুবই সুন্দর। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ নিষিদ্ধ। বাগান ঘুরে, সাগরের পাশে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে এবার গেলাম বিখ্যাত লাইটহাউসে।

আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর ছিল প্রযুক্তিগতভাবে বিশাল নির্মাণ। এর স্থাপত্যকলা এমনই ছিল যে একে মডেল মেনে অন্য সকল বাতিঘর তৈরি হত। বাতিঘরটি তৈরি করা হয়েছিল ফারোস দ্বীপে। দ্বীপটি মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল। আলেকজান্দ্রিয়াতে জাহাজ চলাচলের পথ সঠিকভাবে দেখানোর জন্য এই বিশাল বাতিঘর নির্মিত হয়। জানা যায় যে, বাতিঘরটিকে মোট তিনটি ধাপে বানানো হয়েছিলো, যার সবগুলোই কিছুটা ঢালু হয়ে বাতিঘরের ভেতর দিকে চলে যায়। দ্বিতীয় পর্যায় তৈরি হয়েছিল অষ্টকোণাকৃতি করে। বাতিঘরটির তৃতীয় পর্যায় তৈরি হয় চোঙের আকারে। বাতিঘরটির শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। রাস্তাটি ছিল আঁকাবাঁকা। নির্মাণের চূড়ায় সারারাত ধরে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত নাবিকদের দিক নির্ণয়ের জন্য। এই আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য প্রচুর কাঠ সবসময় বাতিঘরের প্রথমতলায় মজুত রাখা হত। প্রায় ৫০ কিলোমিটার অঞ্চল পর্যন্ত দৃশ্যমান ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার এই বাতিঘরটির। ১৩৩০ সালের এক ভূমিকম্পে ধ্বংস হয় এটি। বাতিঘর অঞ্চলে চল্লিশটিরও বেশি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। এখন বাতিঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। ১৪৭৭ শতাব্দীতে মামলুক সূলতান এই ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি দুর্গ তৈরি করেন। বন্দর রক্ষার জন্য বিশাল দুর্গটির নির্মাণ। ভূমধ্যসাগরের তীরে এই দুর্গটিও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। এবার সেখান থেকে গেলাম বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত লাইব্রেরি দেখতে। নাম লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া। বিশ্বের বিখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিকদের পদধূলি পড়েছে এই বিখ্যাত লাইব্রেরিতে। দুঃখের বিষয় বহিরাগত আক্রমণে সেটি নষ্ট হয়ে যায় এবং এখনো চলেছে লাইব্রেরির নির্মাণ।

আলেকজান্ডার মিশর দখল করেন এবং প্রথম টলেমী ও দ্বিতীয় টলেমী আলেকিজান্দ্রিয়াকে একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩ সালে মিশরের দ্বিতীয় টলেমির শাসনের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার এই লাইব্রেরির জন্ম হয়। প্রাচীন বিশ্বের বিখ্যাত সব চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞানী যেমন আর্কিমিডিস, অ্যারিস্টটল, ইউক্রিড, হাইপেশিয়া সহ অনেকেই বিজ্ঞানচর্চা ও লাইব্রেরির সঙ্গে গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। সেই গবেষণা এবং গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফল নিখুতভাবে সংরক্ষণ করা হত লাইব্রেরিতে। বিখ্যাত মহিলা গণিতবিদ হাইপেশিয়া ছিলেন এখানকার শেষ গবেষক। বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার বিস্তার দেখে হাইপেশিয়াকে খ্রিস্টান যাজকরা হত্যা করেন তাঁদের ধর্মের ব্যবসা বন্ধ হবে ভেবে।
প্রায় ৫০ লক্ষ প্যাপিরাস এবং চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা স্ক্রল সংরক্ষিত ছিল এই লাইব্রেরিতে। সেই স্ক্রলগুলোই ছিল মিশরীয় সভ্যতার জ্ঞানের আলো। সেসময় খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার দ্রুতগতিতে এগোচ্ছিল। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে ধর্মান্ধ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা বেশ খারাপ চোখেই দেখতো, বিজ্ঞানের চর্চাকারীদের তারা ধর্মদ্রোহী এবং নাস্তিক আখ্যা দিত। আর তাই সমূলে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিকে। আগুনে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হল লাইব্রেরির দশ লক্ষেরও বেশি বই। সেই ভগ্ন এবং নির্মীয়মাণ লাইব্রেরি চত্বর ঘুরলাম। লাইব্রেরির বাইরের চত্বরে বীরযোদ্ধা আলেকজান্ডারের আবক্ষ মূর্তিটি দেখে উচ্ছ্বসিত সবাই। অতএব স্মার্ট ফোনে শুরু হল ছবিশিকার। সেসব পাট চুকিয়ে এবার শহর ঘুরলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছিন্ন শহর। মাঝে দেখলাম বিখ্যাত আবু আব্বাস আল মুরসি মসজিদ। অনেকেই ভেতরে ঢুকলেন।
আবু আল-আব্বাস আল-মুরসি মসজিদ আলেকজান্দ্রিয়া শহরের বিখ্যাত মসজিদ। এটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মার্সিয়ান সুফি সাধক আবুল আব্বাস আল-মুরসির উদ্দেশে উৎসর্গ করে তৈরি। তাঁর সমাধি রয়েছে এখানে। মসজিদটি মিশরের পুরানো কায়রো ভবনের মতো দেখতে অনেকটাই। এরপর খাওয়া দাওয়া সেরে কায়রোতে ফেরার পালা। প্রায় তিন ঘণ্টার জার্নি শেষে পৌঁছে গেলাম কায়রোতে। সাক্ষী রইলাম এক বিখ্যাত ঐতিহাসিক শহর দেখার।

যাওয়া-আসা বিষয়ে বলি। সাধারণত মিশর ভ্রমণের সময় আলেকজান্দ্রিয়া ঘুরে নেন সবাই। আলাদা করে যেতে চাইলে কায়রো বিমানবন্দরে নেমে সড়ক ধরে তিন ঘণ্টার পথ। বিশ্বমানের হোটেল রয়েছে এখানে। আলেকজান্ডারের হাতে তৈরি মোহময়ী আলেকজান্দ্রিয়া পর্যটক ও ঐতিহাসিকদের কাছে সত্যি রোমাঞ্চের।