• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 July, 2025

লাক্ষাদ্বীপ এক রূপকথার নাম

লাক্ষাদ্বীপ শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরই নয়, বরং প্রশান্তিরও এক অসাধারণ জায়গা। নির্জনতা আর প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার এক আদর্শ গন্তব্য। মালদ্বীপের সৌন্দর্য বহুল প্রচারিত। কিন্তু লাক্ষাদ্বীপও মালদ্বীপের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। লিখছেন আব্দুল নিস্তার।

ফাইল চিত্র

লাক্ষাদ্বীপ, ভারতীয় উপকূলের এক অপূর্ব সৌন্দর্যের দ্বীপপুঞ্জ, যা সমুদ্রের নীল জলরাশি, সাদা বালির বিচ এবং প্রবাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এটি একটি অন্যতম রহস্যময় এবং দর্শনীয় স্থান, যা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে যুগযুগ ধরে ধারণ করে আছে। সম্প্রতি আমি একটি চার দিনের সফরে লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই সফরটি ছিল একেবারে স্বপ্নের মতো, যেখানে একদিকে শান্ত সমুদ্র সৈকত, অন্যদিকে অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ।

লাক্ষাদ্বীপে পৌঁছনোর জন্য কোচি থেকে বিমানযাত্রা করে আগাত্তি বিমানবন্দরে নামতে হয়। তবে লাক্ষাদ্বীপে প্রবেশের জন্য বিশেষ পারমিট প্রয়োজন, যা সোসাইটি ফর প্রমোশন অফ নেচার ট্যুরিজম অ্যান্ড স্পোর্টস প্রদান করে। এই প্রক্রিয়াটি একটু সময়সাপেক্ষ হলেও, পৌঁছনোর পর লাক্ষাদ্বীপের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে রাখবে।

আমরা যে-দ্বীপটি পরিদর্শন করেছিলাম তা ছিল বাঙ্গারাম। এটি লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম সুন্দর দ্বীপগুলির মধ্যে একটি। বাঙ্গারাম দ্বীপে পৌঁছনোর জন্য আগাত্তি বিমানবন্দর থেকে স্পিডবোটে যাত্রা করতে হয়, যা এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। দ্বীপটি একটি অগভীর লেগুন। সাদা বালির বিচ এবং প্রবাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এখানকার সাদা বালি এবং স্বচ্ছ নীল জল মনমুগ্ধকর। দ্বীপে থাকার জন্য এসি কটেজ এবং উডেন হাট, দুটি আলাদা ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলি শুধু আরামদায়কই নয়, এক অসাধারণ অভিজ্ঞতাও বটে।

দ্বীপে পৌঁছে, আমরা প্রথম দিনটি সমুদ্রস্নান এবং স্নোর্কেলিংয়ে কাটালাম। স্নোর্কেলিংয়ের মাধ্যমে প্রবাল প্রাচীরের নিচে রঙিন মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী দেখতে পাওয়ার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতেই চায় না। পাফার ফিশ, সমুদ্রের এই বিরল প্রাণীটি ছিল আমাদের সবার কাছে এক আকর্ষণীয় দর্শনীয় জীব। সমুদ্রের শান্ত পরিবেশ এবং নিস্তব্ধতা ছিল অতুলনীয়। রাতে, বিচে ফসফোর্সেন্ট প্ল্যাঙ্কটনের ঝলকানিতে সমুদ্রের জলে এক নীলাভ আভা ছড়িয়ে যায়। প্রথমবার দেখে আমরা সবাই অভিভূত হয়ে পড়ি। এ যেন এক জাদুকরী পৃথিবী।

পরের দিন সকালে, আমাদের গন্তব্য ছিল থিনাকারা দ্বীপ, যা জল ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য একটি আদর্শ স্থান। এখানে সাঁতার, স্কুবা ডাইভিং এবং সেলিংয়ের মতো জলক্রীড়ায় অংশ নেওয়া যায়। দ্বীপের সাদা বালি এবং স্বচ্ছ জল এক অসাধারণ মুগ্ধতা সৃষ্টি করে। আমরা সাঁতার কাটতে গিয়ে এবং স্কুবা ডাইভিং করার সময়, ডলফিনের পালের দেখা পেলাম। এটি আমাদের সফরের আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে রইল। এমন অভিজ্ঞতা যে জীবনে খুব কমই পাওয়া যায়!
যাত্রার শেষ দিনটি ছিল বাঙ্গারাম দ্বীপেই অবসর যাপনের। সেদিন রাতে, বিচের মাঝখানে টেবিল সাজানো হয়েছিল।

সাদা কাপড়ে এবং মোমবাতির আলোয় এক অনবদ্য নৈশভোজের আসর বসেছিল। স্থানীয় খাবারের স্বাদ ছিল একেবারে অনন্য। তৃপ্তি করে খেয়ে আমরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যাই। তারায় ভরা আকাশের মাঝখানে শোভা পাচ্ছে মিল্কিওয়ের রেখা। এ যেন এক অলৌকিক দৃশ্য। সমুদ্রের গর্ভের নীলাভ ফসফোর্সেন্ট প্ল্যাঙ্কটনের ঝলকানি আর তারার মায়াবি আলো দেখতে দেখতে, রাতটা যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেল।

শেষদিনে আমরা পারালি দ্বীপে যাই। সেখানে হার্মিট কাঁকড়া এবং কচ্ছপ দেখা একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। এই দ্বীপের অপরূপ সৌন্দর্য, শান্ত পরিবেশ এবং স্থানীয়দের আন্তরিকতা আমাদের সফরকে আরও স্মরণীয় করে তোলে। একযোগে আমরা সকলেই অনুভব করি যে, লাক্ষাদ্বীপের সৌন্দর্য সত্যিই অমূল্য। এখানেও সাদা বালি, স্বচ্ছ জল, প্রবাল প্রাচীর—এগুলি সবই মিশে তৈরি করেছে এক স্বর্গীয় পরিবেশ।

সফর শেষে মনে হল, লাক্ষাদ্বীপ শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই নয়, বরং প্রশান্তিরও এক অসাধারণ জায়গা। নির্জনতা আর প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার এক আদর্শ গন্তব্য। মালদ্বীপের সৌন্দর্য বহুল প্রচারিত। কিন্তু লাক্ষাদ্বীপও মালদ্বীপের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য, সরকার আরও উন্নত পরিকাঠামো তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে, যাতে এটি একটি গর্বের পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

পর্যটকের ভিড় এখন তেমন নেই কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, প্রকৃতির এই সোনালি রত্নটি আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর যোগ্য। লাক্ষাদ্বীপের সৌন্দর্য আমাদের সকলের জন্য এক অনন্য উপহার, যা শুধু আমাদের নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও অমূল্য পর্যটন স্থান হয়ে থাকবে।