নববর্ষের আলোকে বাংলার ফুটবল আসুক প্রাণ

Written by SNS April 15, 2024 2:35 pm

রনজিৎ দাস

FROM THE OCEAN TO THE SKY…নীল রঙ্গের হুডখোলা দোতালা বাসটা রেডরোডের ধারে ১৩৩বছরের ঐতিহ্যের মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পাশে এসে দাঁড়ালো৷ ঝিরিঝিরি বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কয়েকশো ক্লাব সমর্থক নামী ব্যান্ডের তালে বাসকে ঘিরে নিজেদের দুলিয়ে নিচ্ছেন৷ এরপর ফুটবলাররা একে একে বাস থেকে নামা মাত্রই,সমর্থকদের কাঁধে চেপে ক্লাবটেন্টে পৌঁছে গেলেন৷ আইলিগ জয়ী ফুটবলারদের নিয়ে আসা নীলরঙের বাসটার সামনের বড় কাচের স্ক্রিনে লেখাটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলো–From the ocean to the sky !!

নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী স্যর এডমন্ড হিলারির সেকেন্ড এ্যডভেঞ্চার ছিল–সমুদ্র থেকে আকাশ৷ প্রথম মাউন্ট এভারেস্ট জয়ী স্যর এডমন্ড হিলারির ৫ বছরের স্বপ্নের পবিত্র গঙ্গা যাত্রার বাস্তবায়ন৷ যাত্রা শুরুর আগে প্লেন দুর্ঘটনায় তার প্রিয় স্ত্রী লুইস ও মেয়ে বিলান্ডা মারা যায়৷ তবুও তার জীবনবাজির যাত্রায় ২২বছরের ছেলে পিটারকে সাথী করে নিতে তিনি পিছপা হননি৷ প্রজ্বলিত প্রদীপে ও ঘন্টা বাঁজিয়ে তার জেট বোর্টের যাত্রা শুরুর আগে হিন্দুমতে পুজোপার্বন করা হয়৷ ১৫০০মাইলের কঠিন চ্যালেঞ্জের যাত্রাপথ ছিল৷

গঙ্গাসাগর থেকে বৈদ্যনাথ মন্দিরের কাছাকাছি আকাশ পর্বত–নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তাকে যেতে হয়েছে৷ ভারতে তার ৭০দশকের যাত্রাপথের নানা কাহিনী নিয়েই ঐ শিরোনামে সিনেমা হয়েছে৷ গভীর জঙ্গলে বাঘের দেখা কিংবা গঙ্গার নানা ঘাটে তার বোর্ট পৌঁছে যেতেই সাধারণ মানুষের প্রবল উচ্ছ্বাস যেমন ছিল, তেমনই গঙ্গা নদীকে ঘিরে মানুষের জীবনজীবিকার বর্ননাও তাতে আছে৷ ছোট ছোট গ্রাম থেকে বড় শহরের কোলাহল৷ প্রকৃতিকে জয় করে আকাশ পর্বত পৌঁছনোর কঠিন চ্যালেঞ্জ জিতেছিলেন স্যর এডমন্ড পার্সিভাল হিলারি৷ এরপর তিনি ভারতে নিযুক্ত নিউজিল্যান্ডের হাইকমিশনার হয়েছিলেন৷

নানা প্রতিকুলতার মধ্যে আইলিগ জয়ীদের স্যর এডমন্ড হিলারির এই ‘‘সমুদ্র থেকে আকাশ’’ নামাঙ্কিত বাসে ক্লাবটেন্টে নিয়ে আসায় কোন পূর্বপরিকল্পনা ছিল কিনা জানা নেই৷ কিন্ত্ত মহামেডান স্পোটিং ক্লাবের ঐতিহ্যের পরম্পরার সাথে স্যর এডমন্ড হিলারির ৮৮বছরের অ্যাডভেঞ্চার জীবন দারুনভাবে মিলে যায়৷

পবিত্র গঙ্গার সামনে ক্রিকেটের মরুদ্যান ইডেন গার্ডেন৷ তার পাশেই মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব৷ যার সামনে রেডরোড৷ রেসকোর্সের কাছাকাছি এই রেডরোডে একসময় যুদ্ধবিমান ওঠানামা করতো৷ এখন প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ হয়৷ স্বাধীনতা দিবসে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়৷ ২০১৬ সাল থেকে বাঙালির শ্রেষ্ঠ দুর্গোৎসবের বিসর্জনের কার্নিভাল হয়৷ পবিত্র ঈদ উৎসব পালিত হয়৷ নতুন করে এখন দাবী আদায়ের ধর্নাও হয়৷
বিদ্রোহী কবির তো জিজ্ঞাসা ছিল…
ওরা হিন্দু না মুসলিম,এই জিজ্ঞেসে কোনজন হে–কান্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র!!

কুচকাওয়াজ থেকে ধর্না–রেডরোডের ইতিহাসে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে৷ রেডরোডের আশেপাশের গড়েরমাঠের বিভিন্ন ক্লাবেরও অবস্থান বদলেছে৷ ১৯১১ সালে ইষ্ট ইয়ার্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে মোহনবাগানের শিল্ড জয় পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে জোশ বাড়িয়ে দেয়৷ ১৯৪০সালে মহামেডান ক্লাবও কিন্ত্ত রয়্যাল ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে ডুরান্ড কাপ জয়ে নজির গড়ে৷ অবশ্য তার আগেই ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত পরপর ৫বার মহামেডান স্পোটিংয়ের কলকাতা লিগ জয়ে, পরাধীন ভারতের অনন্য নজির ছিল৷ এই সাফল্যের পিছনে তৎকালীন মহামেডান ক্লাবের কর্তা সিএ আজিজের অবদান অনস্বীকার্য৷ নিজেদের লড়াইয়ে টিকে থাকতে বুট পরে খেলা কিংবা টিম গঠনে সারা ভারতের থেকে তরুন ফুটবলার তুলে আনাতে তিনি জোর দিয়েছিলেন এবং সাফল্য এসেছে৷ মাসুম, মাহিউদ্দিন, ওসমান জান, রহিম, হাফিজ রশিদ, রহমতসহ অনেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন৷ যাদেরকে মুসলিম কোরের সাফল্যের এক একজন রূপকার বলা হতো৷ স্বাধীন ভারতে সেই মহামেডান স্পোটিং ক্লাব বিক্ষিপ্ত সাফল্য পেয়েছে বটে৷ কিন্ত্ত সাফল্যের ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি৷ এইসময়ে বাংলার অপর দুই ক্লাব মোহনবাগান এসি ও ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব তাদের সাফল্য ও আধিপত্য পর্যায়ক্রমে বজায় রেখেছিল৷

২০০০ সালের পর থেকেই মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মত ইষ্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান ক্লাবদেরও সাফল্যে ভাটা শুরু হয়ে যায়৷ সর্বভারতীয় স্তরে বাংলার আধিপত্য কমতে শুরু করে৷ বাঙালি নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর হাত ধরে যে ফুটবল ভারতে প্রতিষ্ঠা পেল, সেই বাংলা ও বাঙালি কিনা ভারতীয় ফুটবলে ক্রমশঃ কোনঠাসা হয়ে পড়লো? ব্যর্থতার দায় স্বীকারে কারুর দায়বদ্ধতা প্রত্যাশা করাই যেন অন্যায়৷

এমন যুগ সন্ধিক্ষণে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরপর তিনবার কলকাতা লিগ জয় এবং আইলিগ জিতে আইএসএলের প্রমোশনে তাদেরকে নতুনরূপে দেখা যাচ্ছে৷ নানা প্রতিকুলতা অতিক্রম করে যারা এই সাফল্য অর্জন করলো৷ মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাফল্যে বাংলা আবার ভারতীয় ফুটবলে কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা সময়ে উত্তর দেবে৷

বাংলার শুভ নববর্ষে কলকাতার বিভিন্ন ক্লাবের বারপুজো হবে৷ সেই বারপুজোয় হয়তোবা ৬০/৭০ দশকের উন্মাদনা থাকবেনা৷ কিন্ত্ত আনুষ্ঠানিক বৈচিত্র্য থাকবে৷ বারপোষ্টকে ঘিরে গোল না খাওয়ার শপথ থাকবে৷ নবীনদের মাঝে প্রাক্তন বাঙালি ফুটবলারদের উপস্থিতিতে আধিপত্য থাকবে৷ কিন্ত্ত আরও শুভাশীষ ও শৌভিকদের উপস্থিতির দৈন্যতা কাটবে কি?
স্যর এডমন্ড পার্সিভাল হিলারির প্রতিকুলতার মধ্যে পর্বতশৃঙ্গ জয়ের অনুপ্রেরণা থাকুক৷

কিন্ত্ত আমরা বাঙালি তো কবিগুরুর বংশধর৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়…
“এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ৷
মুছে যাক গ্লানি,ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা৷ “