রণজিৎ দাস
এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যখন দলের সেরা ফরোয়ার্ড হিসেবে একজন বর্ষীয়ান খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, তখন তা দেশের ফুটবল কাঠামোর দুর্বলতাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভারতীয় সিনিয়র পুরুষ ফুটবল দলের এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে খেলার জন্য ভারতীয় দল ঘোষণা হওয়ার পর একটি নামই আবারও আলোচনায়— সুনীল ছেত্রী।
Advertisement
কিন্তু এই আলোচনা তাঁর দুর্দান্ত ফিটনেস বা খেলার প্রতি তাঁর নিবেদন নিয়ে যতটা, তার চেয়ে বেশি তাঁর বয়স এবং এর গভীর প্রভাব নিয়ে। ৪১ বছর বয়সী সুনীল ছেত্রীকে আন্তর্জাতিক অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে দলে নেওয়াটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, ভারতীয় ফুটবল গভীর সংকটে ভুগছে।
Advertisement
ইন্ডিয়ান সুপার লিগ শুরু হয়েছিল ভারতীয় ফুটবলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু এক দশক পার হওয়ার পরেও, দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন সেন্টার-ফরোয়ার্ডে সুনীল ছেত্রীর বিকল্প তৈরি না হওয়াটা আইএসএল-এর ইউথ ডেভেলপমেন্ট এবং প্রতিভা অন্বেষণ প্রোগ্রামের ব্যর্থতা প্রমাণ করে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশি কোচ, খেলোয়াড় ও পরিকাঠামো আনা হয়েছে। কিন্তু সেই টাকা বিদেশি খেলোয়াড়দের পেছনে বেশি খরচ হয়েছে। যার ফলে ভারতীয় তরুণ ফরোয়ার্ডরা মাঠে যথেষ্ট খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না। একজন তরুণ স্ট্রাইকারকে বেঞ্চে বসিয়ে একজন বিদেশি ফরোয়ার্ডকে সুযোগ দেওয়ায় দেশের ফুটবল ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হচ্ছে।
আইএসএল-এর দলগুলিতে বেশিরভাগ গোল আসে বিদেশি স্ট্রাইকারদের কাছ থেকে। এর ফলস্বরূপ, জাতীয় দলের কোচ যখন একজন বিশ্বস্ত গোলদাতার খোঁজ করেন, তখন তাঁকে ৪১ বছরের সুনীল ছেত্রী ছাড়া আর কারো ওপর ভরসা রাখা যাচ্ছে না। এই নির্ভরতা দেশের ফুটবলের জন্য বিপজ্জনক।
সুনীল ছেত্রী একসময় অবসর নেবেন, এটা জানা সত্ত্বেও সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন বা ক্লাবগুলি তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করার জন্য কোনও সুসংগঠিত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে পারেনি। একজন খেলোয়াড়ের খেলার ধরন বা শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী তাকে প্রস্তুত করা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা শুরুই হয়নি।
প্রাক্তন কোচ এবং বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও, কেন এখনও একজন গোল-মেশিন তৈরি হলো না? এর মূল কারণ হলো, তাৎক্ষণিক ফলাফলের উপর অতিরিক্ত জোর। ক্লাবগুলি শুধু লিগ জেতার কথা ভাবে, আর জাতীয় দল কোয়ালিফায়ার পেরোনোর কথা। কিন্তু আগামী ১০-১৫ বছরের জন্য জাতীয় দলের ভিত্তি কী হবে, সে বিষয়ে কারও স্পষ্ট ধারণা নেই।
জাতীয় দলের দুর্বলতা শুধু আই এস এল-এর উপর চাপানো সঠিক নয়। ভারতের তৃণমূল স্তরের ফুটবল এবং কোচিং মান এখনও আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
কম্পিটেন্ট কোচিংয়ের অভাব আছে। সঠিক পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাবে তরুণ খেলোয়াড়দের মধ্যে শৈশবেই ফুটবলীয় বুদ্ধিমত্তা এবং স্কিল ডেভেলপমেন্ট হয় না। ফলে তারা সিনিয়র স্তরে এসে আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়।
ভারতের ঘরোয়া ফুটবল কাঠামো খুবই এলোমেলো। আই-লিগ বা সন্তোষ ট্রফির মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিযোগিতাগুলি দুর্বল হয়ে যাওয়ায়, নতুন খেলোয়াড়রা উচ্চ-স্তরের প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা পাচ্ছে না।
সুনীল ছেত্রীর প্রত্যাবর্তন, ক্ষণিকের স্বস্তি, দীর্ঘমেয়াদী বিপদ ডেকে আনছে।
সুনীল ছেত্রীর দলে ফেরা ভারতীয় ফুটবলের জন্য এক সাময়িক স্বস্তি এনে দিতে পারে, বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের খেলা জেতার চেষ্টায়। কোচের কাছে যখন ম্যাচ জেতাটাই মূল লক্ষ্য, তখন তাঁর মতো একজন অভিজ্ঞ এবং প্রমাণিত গোলদাতাকে বাদ দেওয়া কঠিন মনে হতেই পারে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তটি একই সঙ্গে ভারতীয় ফুটবলের ব্যর্থতার স্মারক। এই ভাবনা তরুণ খেলোয়াড়দের কাছে একটি ভুল বার্তা দেয় যে, দেশের সেরা খেলোয়াড় হতে হলে ৪১ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যতদিন না একজন ২৫-২৬ বছরের ফরোয়ার্ডকে নিয়ে দেশ গর্ব করতে পারে, ততদিন ভারতীয় ফুটবলকে তার ‘স্লিপিং জায়ান্ট’ উপাধি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
সুনীল ছেত্রীর মতো তারকা উপর জাতীয় দলের এমন জরুরি নির্ভরতা প্রমাণ করে যে, ভারতীয় ফুটবলের ইউথ ডেভেলপমেন্ট মডেলটি ব্যর্থ হয়েছে এবং পুরো ফুটবল কাঠামোতে একটি আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি।
Advertisement



