রণজিৎ দাস
ভারতীয় ফুটবলের বর্তমান পরিস্থিতি গভীর সংকটে পড়েছে এবং ফেডারেশন আইএসএলের পাশাপাশি আইলিগ নিয়েও স্থির কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। একের পর মিটিংয়ে ক্লাবের সিইওদের ডাকলেও তারা ফেডারেশনকে সঠিক সহযোগিতা করছে না। আইএসএল ও আইলিগের মধ্যে প্রমোশন ও রেলিগেশন নিয়ে ক্লাবগুলোর মধ্যে মতবিরোধ চলছিল। আইএসএলের ডামাডোলের প্রভাবে আইলিগের খেলা বন্ধ হয়ে আছে। ইন্ডিয়ান সুপার লিগে ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল এবং তার হাই-প্রোফাইল বিপণনে এশিয়ার অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাণিজ্যিক ক্রীড়া উদ্যোগে পরিণত হয়ে গেছে। যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর্পোরেট পুঁজিকেও বিনিয়োগে আনতে সমর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, এই অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক বৃদ্ধি ও তার চাকচিক্যের প্রতিফলন আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় ফুটবল দলের পারফরম্যান্সে অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স জঘন্য হয়েছে। যার ফলস্বরূপ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৩৬ থেকে ১৪২-এর আশেপাশে নেমেছে। এই অবস্থান, গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন র্যা ঙ্কিং যা অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোগত উন্নতির প্রয়োজনীয়তাকেই অস্বীকার করে না।
Advertisement
আইএসএলের মডেলটি প্রাথমিকভাবে স্বল্পমেয়াদী চিন্তাভাবনা ও বিনোদন এবং মালিকদের কর্পোরেট অগ্রগতির প্রতি নজরে ছিল। এই ইউটিলিটি-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তায় খেলোয়াড় উন্নয়ন বা যুবকাঠামোর জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং লিগের কাঠামোগত স্থায়িত্বে প্রমোশন ও রেলিগেশন প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
Advertisement
সেখানে কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের আর্থিক ঝুঁকি কমানোর উদ্বেগের দিকে সর্তকতা প্রাধান্য পেয়েছে। জাতীয় স্তরে প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো সংস্কারের পথে তারা হাঁটেনি। জাতীয় দলের জঘন্য পারফরম্যান্সে সরাসরি ঘরোয়া লিগের দুর্বল ভিত্তি এবং তরুণ খেলোয়াড়দের যথেষ্ট ম্যাচ টাইম না পাওয়াটাই চিহ্নিত হয়েছে। এই কারণে, বাণিজ্যিক বিনিয়োগকে কার্যকরভাবে জাতীয় ফুটবল দর্শনের সঙ্গে সমন্বিত করার জন্য অবিলম্বে নীতিগত ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
অবশ্য ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগের উদাহরণ টেনে আনা যায়। যেখানে ঘরোয়া লিগ বিশ্বের সবচেয়ে দামী হওয়া সত্ত্বেও ইংল্যান্ড ১৯৬৬ সালের পর আর বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। এই তুলনা ভারতীয় ফুটবলের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি প্রমাণ করে যে একটি লিগের উচ্চ আর্থিক মূল্য বা বাণিজ্যিক সাফল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক সাফল্য নিশ্চিত করতে পারেনা। আইএসএলের ক্ষেত্রেও একই অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এশিয়ার অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষী লিগ হওয়া সত্ত্বেও, ভারতের আন্তর্জাতিক ফলাফল সন্তোষজনক নয়।
ইপিএল-এর আর্থিক আধিপত্যের বিশ্লেষণে,প্রিমিয়ার লিগ বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের একটি অর্থনৈতিক শক্তিঘর। তবে জানা গেছে ইপিএল ব্রিটিশ অর্থনীতিতে প্রতি বছর ইতিবাচক অবদান রাখে। এই পরিসংখ্যান অন্যান্য ইউরোপীয় লিগ যেমন বুন্দেশলিগা এর তুলনায় যথেষ্ট বেশি।
ইপিএলের বিশ্বজুড়ে প্রভাবও বিশাল। ১৮৮টি দেশে এ খেলা দেখানো হয়, যা এই লিগকে বাজারের নেতা করে তুলেছে। এই লিগ এমন সম্প্রচার রফতানি করেছিল, যা বিবিসি, আইটিভি, চ্যানেল ৪, চ্যানেল ৫, স্কাই সহ স্বাধীন সেক্টরের মোট রফতানিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই পরিমাণ রাজস্বের মাধ্যমে কেবল একটি লিগ নয়, এটি ব্রিটিশ ‘সফট পাওয়ার’ প্রতীকে পরিণত করেছে।
ইংল্যান্ডের সিনিয়র পুরুষ দল গত ৬০ বছর ধরে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি, তবুও আন্তর্জাতিক ফুটবল অবকাঠামোতে ইংল্যান্ডের কৌশলগত বিনিয়োগ থেকে ভারতের অনেক কিছু শেখার আছে। সিনিয়র দলের আন্তর্জাতিক ট্রফি খরা সত্ত্বেও, ইংল্যান্ডের যুব ও নারী দলগুলি সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে, যা ভারতের ক্ষেত্রেও একই ফলাফল দিচ্ছে। আমাদের সারা দেশেই সাঁইয়ের মতন পরিকাঠামো থাকতেও দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে উন্নত করা যায়নি। কৌশলগত বিনিয়োগে ভুবনেশ্বর ও হায়দরাবাদে কোচিং প্রোগ্রাম এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের জোর দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক পুরুষ ও মহিলা দলের ক্যাম্প চলছে। একই উদ্দেশ্যে আইএসএলের বাণিজ্যিকীকরণের সাফল্যকে কেবল ক্লাবগুলির লাভের জন্য ব্যবহার না করে, ইংল্যান্ডের মডেল অনুসরণ করে এটিকে জাতীয় দলের উন্নয়নে একটি অনুঘটক হিসাবে ব্যবহার করা উচিত।
ভারতীয় ফুটবল ইকোসিস্টেমের আর্থিক কাঠামো ও স্থিতিশীলতা এবং ভারতীয় ফুটবল ইকোসিস্টেমের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আইএসএলের বাণিজ্যিক মডেল তার কাঠামোগত দুর্বলতা এবং সীমিত আর্থিক স্থিতিশীলতার কারণে সমালোচিত হচ্ছে।
আইএসএলের বাণিজ্যিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের মূল লক্ষ্য ছিল ফুটবলকে জনপ্রিয় করা এবং দেশে এর বিস্তার বাড়ানো। ক্লাবগুলিকে অংশগ্রহণের জন্য ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড-কে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি দিতে হয়, যা ২০২৩-২০২৪ সাল থেকে ক্লাবের মোট বার্ষিক আয়ের ২০% হিসাবে ধার্য করা হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে, রাজস্বের উৎস ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি-এর উপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল ছিল। প্রথম সিজনে, এই ফি মোট টার্নওভারের প্রায় ৭৫% তৈরি করেছিল। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সম্প্রচার মানি বিতরণের কারণে এই নির্ভরশীলতা হ্রাস পেয়ে প্রায় ৩৩%-এ দাঁড়িয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি এখনও আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
আইএসএলের এই বিতরনের মডেল,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেশাদার দলীয় খেলাধুলোর মডেলকে অনুসরণ করে। যেখানে লিগ প্রতিটি দলের মধ্যে সমানভাবে সম্প্রচার মানি বিতরণ করে। তবে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাণিজ্যিকীকরণের চিত্র সত্ত্বেও, লিগের অভ্যন্তরীণ আর্থিক স্বাস্থ্য এখনও দুর্বল।
ক্লাবের আর্থিক দুর্বলতা এবং বিনিয়োগের প্রকৃতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, আইএসএল এবং এর ক্লাবগুলি উল্লেখযোগ্য আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।
ক্লাবের মালিকদের বিপুল বার্ষিক লোকসান বহন করার প্রবণতা থেকে বোঝা যায় যে, তাদের বিনিয়োগ মূলত মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে চালিত নয়। বরং, এটি মালিকদের ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট স্বার্থে চালিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্র্যান্ড দৃশ্যমানতা, সামাজিক প্রভাব, কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব, বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা অর্জন।
এই অসঙ্গতি আইএসএলের বাণিজ্যিক লক্ষ্য এবং ক্রীড়াবিষয়ক নীতির মধ্যেকার মৌলিক পার্থক্যকে তুলে ধরে।এর অর্থ হল,আইএসএলের বর্তমান সংকট ও ভারতীয় জাতীয় দলের বর্তমান পারফরম্যান্স পৃথক নয়।
Advertisement



