চ্যাম্পিয়ন মহমেডান স্পোটিং ক্লাব আরও সাফল্যের প্রেরণা দেবে

Written by SNS April 8, 2024 2:07 pm

রনজিৎ দাস

মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আইলিগ জিতে সামনের মরশুমে আইএসএলে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো৷ মহামেডান স্পোটিং ক্লাবের এই জয়ে বাংলার ফুটবলে নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে৷ মহামেডান ক্লাবের আইলিগ জয়ের ক্ষেত্রে কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়৷ একঝাঁক অনামী ফুটবলারদের নিয়ে টানা ১১টা মাস এভাবে সাফল্যের মধ্যে থাকা মুখের কথা নয়৷ প্রথমে কলকাতা লিগে তারা চ্যাম্পিয়ান হয়৷ তারপর ডুরান্ড কাপে ভালো পারফরম্যান্স করেছে এবং আইলিগের এই ঐতিহাসিক জয়৷

অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে যেমন মহামেডান ক্লাবকে এবছর যেতে হয়েছে৷ তেমনিই অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত তাদেরকে নিতে হয়েছে৷ দর্শকশূন্য মাঠে হোম ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত সবচাইতে বেদনাদায়ক ছিল৷ কলকাতা লিগে আর্মি রেড দলের বিরুদ্ধে নৈশালোকের উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে শেখ সিরাজউদ্দিনের হূদয়বিদারক মৃতু্যকে পর্যন্ত সইতে হয়েছে৷ আইলিগের প্রস্তুতিতে কলকাতা লিগের চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলাতেও নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় থাকা আরও কঠিন ছিল৷ কলকাতা লিগের সেরা প্লেয়ারকে নিয়েও দলবদলের জন্য টানাটানির মধ্যে পড়তে হয়েছে৷ কলকাতা লিগের ভারতীয় ফুটবলারদের প্রতি বিশ্বাস রেখে আইলিগে খেলতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে৷ বিদেশি ফুটবলারদের স্কোয়াডে মুন্সিয়ানা ছিল৷ মণিপুরের জাতি দাঙ্গার সময়ে উত্তর-পূর্বের খেলোয়াড় ও তাদের আর্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর কঠিন দায়বদ্ধতা ছিল৷ ব্যাঙ্কারহিলের মত স্পনসর পাশে থাকায় অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়েছে৷ কিন্ত্ত সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রয়োজন হয়৷ ক্লাব প্রশাসন দৃঢ়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করেছে৷ খেপের মাঠের অযাচিত ঘটনাকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা গেছে৷ ক্লাবের পরিবেশটাই বদলে গেছে৷ দীপেন্দু বিশ্বাসের মত প্রাক্তন ফুটবলার, তার টাটা ফুটবল আকাদেমির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাচ্ছেন৷ এত সফল্যের পরেও শরীরের ভাষায় কোনও বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই৷ সর্বত্র যেন–একে অন্যের তরে৷ এই শৃঙ্খলা ও সংযমটাই বাংলার ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে৷

মহামেডান স্পোর্টিং কলকাতা লিগ, ডুরান্ড কাপ ও আইলিগ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৩টা ম্যাচ খেলে ৪০টা ম্যাচে অপরাজিত থেকেছে৷ আইলিগে তারা নিজেদেরই টানা ১১টা ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভাঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ পরের দিল্লি এফসির বিরুদ্ধে ম্যাচে অপরাজিত থাকলে, তারা টানা ১২টা ম্যাচ অপরাজিত থাকবে৷ আর ২টো গোল করলে মরশুমে ৪৪ ম্যাচে ১০০ গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করবে৷ ম্যাচ প্রতি ২য়ের অধিক গোল৷ ২৫/২৬ জনের স্কোয়াড একটা মরশুমে ৪০ এর বেশি ম্যাচ খেললো৷ এখনো টিমটাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছেনা৷ বর্তমানে সময়ে টোটাল টিমের এমন ফিট থাকাটাই সাফল্যের চাবিকাঠি৷ অপেশাদার কঠামোয় এমন নজির খুব কম থাকে৷ যেখানে টিমের গড়বয়স ২৬ পেরিয়ে যায়নি৷ শ্রীনিধি ডেকান, গোকুলাম কেরল, রিয়েল কাশ্মীর ও ইন্টার কাশির মত একাধিক শক্তিশালী দল চ্যাম্পিয়ানশিপের জন্য গায়েগায়ে লড়াই করেছে৷ এছাড়া, চার্চিল ব্রার্দাসের বিরুদ্ধে ২টো ম্যাচই কঠিন ছিল৷ রিয়েল কাশ্মীর ছাড়া আইলিগের সব দলের বিরুদ্ধেই জয় এসেছে৷ দূরন্ত লড়াই হয়েছে৷ এই লড়াইয়ে ৩৯টা হলুদ কার্ড ও ৩টে লাল কার্ড টিমের দেখতে হলেও, টিম মহামেডানের পার্সিং ফুটবল ছিল দৃষ্টিনন্দন৷ মাঝমাঠের সব প্লেয়ারাই আইলিগে গোল পেয়েছে৷ মাঝমাঠে কাশিমভ ও গোমসের সাথে আঙ্গুসানা, বিকাশ, ফানাই ও ডেভিডদের অসাধারণ লড়াই ছিল৷ গোল করা ও গোল করানোর ক্ষেত্রে কেউ স্বার্থপর হয়নি৷

গোমস,আঙ্গুসানা ও ফানাইরা যেমন গোল করেছে, তেমনি সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছে৷ খুব ইন্টারেস্টিং যে কোচ চের্নিশভ ডেভিডকে দারুণভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উইং, এ্যটাকিং মিডফিল্ডে ব্যবহার করেছেন৷ ডেভিড কলকাতা লিগে ২০টা গোল করেছিল৷ আইলিগে ওর ৫টা গোল আছে৷ বিদেশি স্টাইকার এডি হার্নান্দেজ ১৩টা গোল করেছেন৷ মাঝমাঠের বিদেশি খেলোয়াড় কাশিমভও ৩টে গোল করেছে৷ কিন্ত্ত সবার অলক্ষ্যে মিজোরামের লালরেনসাঙ্গা ফানাই উইং থেকে তার সতীর্থ ডেভিডের মত ৫টা গোল করে গেছেন৷ কোচ কিন্ত বিকাশ, ফানাই ও ডেভিডকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দারুণ ব্যবহার করেছেন৷ ইষ্টবেঙ্গল থেকে আঙ্গুসানাকে মহামেডানে যোগ করানো মহামেডান কর্তাদের সফলতা বলা যায়৷ মহামেডান মাঝমাঠে কাশিমভ, গোমস ও আঙ্গুসানা যেন তেল দেওয়া মেসিন৷ ডিফেন্সে আদজেইর সাথে ইরশাদের জুটি সফল৷ সাইডব্যাকে সামাদ, জাসিম, রালতেরা যে যখন সুযোগ পেয়েছে, দারুনভাবে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়েছিল৷ প্রত্যেকেই তাদের সেরাটা দিয়েছেন৷ এককথায় দলগত সংহতিতে জয় এসেছে৷ যাকে তারুণ্যের জয় আখ্যা দেওয়া যায়৷ এই জয়টাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখতে চেয়েছিলেন৷ তিনি চেয়েছিলেন বাংলার অপর দুই বড় ক্লাব ইষ্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মত মহামেডান স্পোটিং ক্লাবও দেশের সবোর্চ্চ লিগে অংশগ্রহণ করুক৷ বাংলার দলগুলো ভারতীয় ফুটবলে শুধু রাজত্ব করা নয়, তার অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাক৷ মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই স্বপ্নকেও বাস্তব করলো৷ মহামেডান স্পোটিং ক্লাবের এই সাফল্য তাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ মনে রাখা দরকার, ইষ্টবেঙ্গলের মত শক্তিশালী দলও কিন্ত্ত আইলিগে দীর্ঘদিন খেলে চ্যাম্পিয়ান হতে পারেনি৷

২০২৪/২৫ মরশুমে আইলিগের প্রথম বিভাগে বাংলার কোনো দল থাকবেনা৷ ফলে আইলিগ থেকে আইএসএলের প্রমোশনে বাংলার কোনো দল লড়াইয়ে থাকলো না৷ এই মরশুমে আইলিগের দ্বিতীয় বিভাগে ইউনাইটেড স্পোর্টসের লিগ টেবিলের যে অবস্থান, তাতে দ্বিতীয় দল হিসেবে আইলিগের প্রথম বিভাগে ওঠার সম্ভাবনা আপাততঃ খাতায় কলমে থাকলেও, বাস্তবে প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে আছে৷

দেশের সবোর্চ্চ লিগ অর্থাৎ আইএসএলে একমাত্র বাংলা থেকেই পরের মরশুমে ৩টে দল খেলবে৷ ভারতবর্ষের আর কোনো রাজ্য থেকে এমন প্রতিনিধিত্ব নেই৷ পরের মরশুমে আইলিগের প্রথম বিভাগে কোনো দল না থাকলেও ২য় ও ৩য় বিভাগে বাংলার প্রতিনিধিত্ব থাকবে৷ সর্বভারতীয় স্তরে বাংলার দলগুলোর প্রাধান্য থাকলেই ভারতীয় ফুটবলে বাংলা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে৷ অনেক সমলোচনা শুনেও আইএফএ কিন্ত্ত মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রস্তুতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷ আইএফএ কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলা– মহামেডানের আইলিগ ক্রীড়াসূচিকে মান্যতা দিয়েছে৷ এভাবেই আইএফএর এখন থেকেই সামনের মরশুমে যারা আইলিগের ৩য় বিভাগে খেলবে,তাদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা করা উচিত৷ আজ ব্যাঙ্গালরু ও গোয়ার দলগুলো যে সুযোগ পাচ্ছে,তা বাংলার দলগুলো পাবে না কেন? আইলিগের ৩য় বিভাগের প্রাথমিক ও চুড়ান্তপর্বের খেলা বাংলায় হোক৷ এবছর ডুরান্ড কাপ,সুপার কাপ ও আইলিগে বাংলার দলগুলো চ্যাম্পিয়ান হলো৷ আইএসএলের লিগ-শিল্ড ও প্লে-অফের কাপ কিন্ত্ত বাংলার দরজায় কড়া নাড়ছে৷ চরম মুহূর্তের সেই সাফল্য ছিনিয়ে আনতে বাংলার অপর দুই বড় ক্লাব মহামেডান স্পোর্টিংয়ের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হোক৷