অর্থনীতিতে মেয়েরা : ইতিহাসের চূর্ণচিত্র

Written by SNS April 7, 2024 1:59 pm

ইতিহাসের ধূসর পৃষ্ঠা ওল্টালে দেখা যায় সভ্যতার বিভিন্ন কালখণ্ডে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন মহিলারা৷ কিন্ত্ত পুরুষদের জাঁকজমকপূর্ণ শাসনের আড়ালে থেকে গিয়েছে তাঁদের যাবতীয় উদ্যোগ ও কৃতিত্ব৷ এরকম কয়েকজন নারীকে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে তুলে এনেছেন  সুপর্ণা দেব

দৃশ্য এক
মিশরের ফ্যারাও তৃতীয় থুটমোস প্রচুর খাটছেন৷ বিকৃত করে ফেলা হচ্ছে মূর্তি ও ছবি এমনকি নথিপত্র৷ ভাঙচুর করতে করতে তার মনে হল আরে! আসল কাজটাই তো করা হয়নি৷ দের এল বাহরি মন্দিরের ওই দেওয়াল ছবিগুলো! ওগুলোকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলব৷ কোথাও থাকবে না হাটশেপসুট৷ কোথাও থাকবে না তাঁর কোনো কীর্তি কাহিনির মহিমা৷

দের এল বাহরি মন্দিরে কী ছবি আঁকা ছিল যা তৃতীয় থুটমোস খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন?
মহিলা ফ্যারাও হাটশেপসুট (খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯৩) আফ্রিকার পূর্ব উপকুল বরাবর এক উচ্চাশী জলযাত্রা, পুন্ট অভিযান শুরু করেছিলেন৷ এই অভিযান নিয়ে এতো উত্তেজিত ছিলেন হাটশেপসুট যে, তিনি তাঁর নৌ-সেনাপতিকে এই অভিযানের বর্ণনা বিস্তারিত লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ না, যুদ্ধভেরী নয়, দীর্ঘ শ্রমসাধ্য এই অভিযানের প্রধান কারণ বাণিজ্য৷ অর্থনীতি৷ পুন্ট এক রহস্যময় দেশ৷ ঈশ্বর ঢেলে দিয়েছেন সম্পদ, যার মধ্যমণি সুগন্ধ! ফ্যারাও শুধু সম্পদ জাহাজে ভরে ভরে মিশরে নিয়ে আসেননি, উপড়ে নিয়ে আসা হয়েছিল তিরিশটি সুগন্ধি রজনের গাছ! সুগন্ধ, মিশরের প্রাণ৷ অর্থনীতির প্রধান সম্পদ! এই মহিমময় কীর্তি অক্ষয় করে রাখতে চেয়েছেন মহিলা ফ্যারাও হাটশেপসুট৷ মন্দিরে তাই আঁকা হয়েছিল পুন্ট অভিযানের অজস্র দেওয়াল চিত্র!

দৃশ্য দুই
রানি এসেছেন, রানি এসেছেন৷ রানিকে দেখতে জড়ো হয়েছে শহরের যত লোক৷ মুখে তাদের কৌতূহল৷ রানি কেন আসছেন তাদের দেশে? শুনেছি বহুদূর থেকে বহুদিন ধরে দক্ষিণের এক দেশ থেকে তিনি আসছেন৷
রানি আসছেন মারিব শহর থেকে৷ মারিব এক উছলে ওঠা ধনী শহর৷ লোকসংখ্যাও জেরুজালেমের থেকে অনেক বেশি৷

১৫০০ মাইল, সেতো অনেক পথ৷ বাহাত্তর দিন লেগেছিল পৌঁছতে৷ স্বচ্ছ লিনেনের পর্দার ঘেরাটোপে গনগনে রোদ্দুর, ধুলো ঝড়, বিষাক্ত বিছে কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে ইয়েমেনের (মতভেদে ইথিওপিয়া) শেবার রানি এক বিশাল বাহিনি নিয়ে প্রচুর উপঢৌকন সঙ্গে করে চলেছেন লম্বা মরুপথ পেরিয়ে, চলেছেন ইস্রায়েল!
রাজা সলোমনের কাছে শেবার রানির আগমন, হিব্রু বাইবেলের এই আখ্যান রহস্যে ও হেঁয়ালিতে ভরা৷ রানির ছিল বিশাল বাণিজ্য৷ বণিক নেতা তামরিন তাঁকে বলেছিল, আহা কী রাজা দেখে এলাম! জ্ঞানসমুদ্র যেন! রানি অমনি সেই সমুদ্রের জলের ঠাহর করতে ও পরখ করতে এক দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়লেন! কিন্ত্ত আসল কথা ছিল আরও জলের গভীরে৷ সমুদ্র ছিল ঠিকই তবে তা সমুদ্রবাণিজ্য৷

রাজা ও রানির এই সাক্ষাৎ বাণিজ্যের প্রথম বা আদিতম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বলা যায়৷ তার কারণ বাণিজ্য নির্ভর রানির সামনে বড় বাধা হয়ে উঠেছিলেন ইস্রায়েলে ডেভিডপুত্র সলোমন৷ লোহিত সাগরে ফিনিশিয় দক্ষ নাবিক ও টায়ারের রাজার সাহায্যে বণিকের থাবা লম্বা করে চলেছেন সলোমন৷ শেবার স্বচ্ছন্দ বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা চলে এসেছে৷ এসেছে চড়া শুল্কের দাবি৷ স্থলে বা জলে শেবার বণিকেরা আগের মত দূর দূরান্তে চলে যেতে পারছে না৷

কাজ হাসিল করে নিজের দেশে ফিরেছিলেন রানি৷ ধর্ম, প্রেম, চাতুরী নানান ধোঁয়াশায় কুহেলিমাখা এই বিবরণ একটি সত্য তুলে ধরেছে তা হল অদম্য এক নারীর দেশের সমৃদ্ধি বাঁচানোর জন্য অর্থনৈতিক আপোষ৷ এবং সেই পথটি ছিল অতিশয় জটিল ও কৌশলী!

দৃশ্য তিন
সবে বর্ষা শেষ হয়েছে৷ সুরাট বন্দর থেকে একটি বাণিজ্যপোত লোহিত সাগরের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ সুরাট থেকে লোহিতসাগরের মোখা বন্দরে নিয়মিত যাতায়াত করে এই জাহাজ৷ বাণিজ্যপোতটি আকারে বিশাল, আড়ে বহরে অতিকায়, পেটের খোলে হাজার হাজার মণ মাল বইতে পারে৷ সেকালে মানে ১৬১৩ সাল নাগাদ এতো বড় বাণিজ্যপোত ভারতে আর ছিল না৷ শুধু সওদাই নয় মক্কার তীর্থযাত্রীদেরও নিয়ে যেত এই জাহাজ৷ ষোড়শ সপ্তদশ শতকে বিশ্ববাণিজ্যে ভারতের বেশ রমরমা অবস্থা ছিল৷ কিন্ত্ত ইতিমধ্যে ইওরোপ থেকে পর্তুগিজরা এসে গেছে৷ এসে গেছে ডাচ আর ইংরেজরাও৷ সকলের উদ্দেশ্য একটাই ব্যবসা, ব্যবসা আর ব্যাবসা৷

বাণিজ্যপোতটির নাম রাহিমি৷ রাহিমি বিদেশে বয়ে নিয়ে যায় তুলো, নীল, রেশম, চামড়া, ধাতু, গালিচা, আফিম আর রত্নরাজি৷ বিনিময়ে সে এদেশে নিয়ে আসত সোনা রুপো হাতির দাঁত মুক্তো অম্বর, সুরা, সুগন্ধি, মহার্ঘ বস্ত্র ও কাচের জিনিস৷

জলপথে বাণিজ্য মোটেও নিরাপদ ছিল না৷ জাহাজডুবি, ঝড় তুফান ছাড়াও ছিল জলদসু্যর ভয়৷ আরবসাগরের জলপথ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পর্তুগিজরা সুরক্ষার কারণে এক ধরনের অনুমতিপত্র দিত৷ রাহিমি নামক বাণিজ্যতরীটির সেই অনুমতিপত্রও ছিল৷ তা সত্ত্বেও পর্তুগিজরা বেপরোয়া ভাবে জাহাজটি আটক করে এবংবিপুল পরিমাণ মালপত্র ও সাতশো যাত্রী সমেত জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়িয়ে দেয়৷
এই দুঃসাহসের কথা যখন আগ্রার শাহী জেনানামহলে পৌঁছে গেল মারিয়াম উজ জামানি তীক্ষ্ণ চোখে তাঁর পুত্রের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আমার কথা তুই আর কবে শুনবি বল তো?
হ্যাঁ, বাণিজ্যপোতটির মালিক ছিলেন একজন মহিলা৷ তাঁর নামের অর্থ ‘এ যুগের মা মেরি, মারিয়াম উজ জামানি’৷ বাদশা আকবরের প্রিয় মহিষী কচ্ছওয়াহা রাজপুতানি জোধাবাই৷

অন্তপুরের মেয়েরা যুদ্ধে নেমেছে, তলোয়ার ধরেছে, রাজনীতিতে মাথা ঘামিয়েছে৷ তার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য সামলিয়েছে, জমিজিরেত তদারকি করেছে, টাকা পয়সার লেনদেন করেছে, সবচেয়ে বড় কথা সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকলেও সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা যদি না থাকে তবে সঠিক অর্থে ক্ষমতায়ন হয় না৷

রাহিমি জাহাজটি যে বিশাল পরিমাণ সওদা করত সেটাই মারিয়াম উজ জামানির পক্ষে একটা অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণ৷ এই ঘটনায় রাজনীতির প্যাঁচ পয়জারে একটি মোক্ষম বিষয় দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে তা হল অর্থনৈতিক উদ্যোগে একজন অভিযানপ্রিয় মহিলার সক্রিয় ভূমিকা৷ সেকালে বহির্বাণিজ্যে তিনি খুব সুপরিচিত একটি নাম৷ তাঁর জন্যই রাজানুগ্রহ থেকে পর্তুগিজরা বঞ্চিত হয়েছিল৷ কিন্ত্ত তিনি ইতিহাসে আকবরের হিন্দু রাজপুত স্ত্রী হয়েই রয়ে গেলেন! দুঃখের কথা এই যে ইতিহাসের গলিপথে এইসব চরিত্ররা হারিয়ে গেছেন৷ রাজপথ জুড়ে শুধু পুরুষের কাফিলার সোরগোল৷

বিদেশী অনুপ্রবেশের ফল যে খুব শুভ নয় সেকালের মেয়েরা তাদের ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে অন্দরমহলে বসেই অনুভব করেছিলেন৷ জেসুইট পাদ্রীদের সঙ্গে আকবরের মাখামাখি তার পিসি গুলবদন বেগম বা মা হামিদা বানু কেউই পছন্দ করতেন না৷ বাংলায় রানি ভবানী ইংরেজ তোষামোদের মধ্যে ভবিষ্যতের দুর্যোগ দেখেছিলেন৷ প্রসঙ্গে ফিরে আসি, খোদ রানিমাতার জাহাজ দখল করে চরম দুঃসাহস দেখিয়ে পর্তুগিজরা বাদশা জাহাঙ্গিরের বিরাগভাজন হলেন৷ মারিয়াম উজ জামানির অধীনে অনেক গোমস্তা ও দালাল কাজ করত৷ প্রচুর অর্থ, ব্যাবসায় লগ্নী করেছিলেন তিনি৷

পর্তুগিজদের আগেই মারিয়ামের সঙ্গে ঝামেলা হয়ে গেছে ইংরেজদের৷ তার কারণও ছিল বাণিজ্য৷ ইনিও ইংরেজ সহ ফিরিঙ্গি বণিকদের উদ্দেশ্য ও অভিসন্ধি নিয়ে খুবই বিরক্ত ছিলেন৷ বায়ানা অঞ্চলের নীল চাষে রানিমাতার নিজের উৎসাহ ছিল বেশি৷ এখানে কুয়ো বানিয়ে জলসেচ শুরু করেন এই আশায় যে বায়ানার সব উৎপাদিত নীল তিনি নিজে কিনে নিয়ে মোখা বন্দরে রপ্তানি করবেন৷ কিন্ত্ত উইলিয়াম হকিন্স নামে জনৈক ইংরেজ ব্যবসাদার চড়া দামে সব নীল কিনে নিল৷ বলাই বাহুল্য এই অপমানের সাজা ইংরেজদের ভুগতে হয়েছিল৷

এর রাজনৈতিক ফল আমাদের আলোচনার বিষয় নয়৷ আলোচনার মধ্যবিন্দু এক মহিলা উদ্যোগী, একজন সফল ব্যবসায়ী৷ কাজেই মোঘল হারেম বলতেই যে দৃশ্যপট আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বিপ্রতীপ বিন্দুগুলো কখনোই আলোকিত ও আলোচিত হয়ে ওঠেনি সেভাবে৷ বা তাদের পরিচয়ে কখনোই এইসব দক্ষতার কথা উল্লেখ করা হয় না৷

একথা ঠিক যে, মোঘল মেয়েরা প্রায় সবাই খুব সুশিক্ষিত ও ধনী ছিলেন৷ সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে অর্জিত ধনসম্পদ রক্ষায় তারা অনেকেই বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন৷ যে সময় কৃষিজাত সম্পদ অর্থনীতির বুনিয়াদ ছিল সেই সময়ে আমদানি রপ্তানীর বাণিজ্যে তাদের ভূমিকা, তাও আবার জলপথে, আমাদের বিস্মিত করে৷

প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে মীনাবাজারের কথা৷ এখানে মেয়েদের মুখ্য ভূমিকা, ক্রেতা ও বিক্রেতা দুইই৷ বাজারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কারা? বেগম শাহজাদিরা আর আমির ওমরাহের গিন্নিরাও৷ সদাগরের ঘরনিরা৷ এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়৷

এবারে নূরজাহানের কথা শোনা যাক৷ নূরজাহানের রাজনীতিতে বেশ জাঁদরেল ভূমিকার কথা জানা যায়৷ তবে বাণিজ্যের দিকেও বেশ আগ্রহ ছিল তাঁর৷ সুরাটে ইংরেজদের প্রথম কারখানা স্থাপনের নেপথ্যে তাঁর কিছু পরোক্ষ ভূমিকা ছিল৷ নূরজাহান, ইংরেজদের বাণিজ্যের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলেন৷ আর এই বিষয়টাই কাজে লেগে গিয়েছিল ইংরেজদের৷ নূরজাহান ইংরেজদের বিলাসদ্রব্যের সওদাগরিতে উৎসাহী ছিলেন৷ আর ইংরেজদের আগ্রহ ছিল এদেশের তুলো আর রঞ্জক পদার্থে৷ ইংরেজদের সঙ্গে ব্যাবসা ছাড়াও ডাচ ও পর্তুগিজদের সঙ্গে কাজকারবারেও সম্রাজ্ঞীর ভালোই উৎসাহ ছিল৷ বাণিজ্য-পোত নূরজাহানেরও ছিল৷ তবে হ্যাঁ, ইংরেজ বণিকেরা তাঁর তালিকায় প্রথম দিকে ছিল৷ পর্তুগিজ বা দেশীয় বণিকেরা নয়৷

১৬২৭ সালে সম্রাজ্ঞী আদেশ দেন যে ইংরেজদের পথকর ও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার মধ্যবর্তী কর দিতে হবে না৷ ব্যবসায় তিনি ছিলেন সুচতুর, এমনটাই লিখে গেছেন ঐতিহাসিকেরা৷ জামাকাপড়, নকশা, ফ্যাশন এসব তাঁর খুব পছন্দের বিষয়৷ দোদামি, ফারশ এ চাঁদনি, পাচটোলিয়া এসব নানান পোশাক, চাদর তিনিই প্রথম চালু করেন৷ নূরজাহানের বিলাসদ্রব্যের ভালোবাসার জন্যই কিনারি বাজার নামে নতুন একটি বাজার চালু হল শাহজাহানাবাদে অর্থাৎ দিল্লিতে৷ এছাড়াও তিনি শুল্ক আদায় করতেন৷ নীল ও সূচি শিল্পের ব্যাবসায় ভালোই অংশ নিয়েছিলেন৷

দিল্লি শহরে ইতিউতি প্রচুর সরাইখানার হদিশ পাওয়া যায়৷ তখন সরাইখানার বেশ চাহিদা ছিল৷ নূরজাহান সরাইখানা বানিয়েছিলেন৷ আগ্রার কাছে, সরাই নূর মহল৷ সরাইখানা তখন পর্যটক, সওদাগর এবং সৈন্যদের থাকার প্রধান আস্তানা৷ মসজিদ বা ধর্মশালা ছাড়াও যে সরাইখানা বানানোর চিন্তা তাদের মাথায় এসেছিল এর থেকে ব্যবসা বাণিজ্যে তাদের আগ্রহের বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়৷ ফরাসি বণিক ও পর্যটক জাঁ ব্যাপ্টিস্ট তেভারনিয়ের লিখছেন, এইসব সরাইখানাতে সাধারণ মেয়েরা চাল মাখন আটা সবজি বিক্রি করতে আসত৷ বাজারে হাটে দোকানে বসে মেয়েরা বিক্রিবাটা করছে, চাল মাপছে এমন দৃশ্য বিরল ছিল না৷

তবে পুরুষশাসিত সমাজে পয়সাকড়ির ব্যাপারে সাধারণ মেয়েদের এন্টাইটেলমেন্ট বা হক আদৌ ছিল কি না তা তো সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়৷
বাণিজ্যিক উদ্যোগ যাকে আমরা entrepreneurship বলি সেদিক থেকে জাহানারা বেগম কোনো অংশেই কম ছিলেন নাকি!

বাদশা শাহজাহানের প্রিয় কন্যা, তুখোড় বিদূষী ও মরমিয়া কবি, একজন দিওয়ানা সুফি, যিনি বলেছিলেন, একমাত্র ঘাস ছাড়া আর যেন কিছু না থাকে আমার সমাধিতে, আমার মত দীন অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন! এভাবেই জাহানারা বেগমকে ইতিহাসের পাতায় আমরা পেয়ে থাকি৷ তিনি স্পষ্ট বক্তাও ছিলেন৷ ধর্মীয় অনুদারতা নিয়ে ছোটভাই আওরংজেবকে এক হাত নিতে কখনোই ছাড়তেন না৷

যদি দেখেন ইনিই বসে বসে নকশা আঁকছেন একটি বিশাল বড় বাজারের, কোথায় কোন দোকান বসবে, কীভাবে বসবে? অর্ধচন্দ্রাকারে না সার বেঁধে? সরু সরু খাল সমান্তরাল বয়ে যাবে৷ বিচিত্র সব পশরা আর বিকিকিনির হাটের নকশা৷ পাক্কা কলাকুশলীর মতো৷ চৌকশ কারিগরের মত! খুব আশ্চর্য লাগে কি? এই হল দিল্লির চাঁদনি চকের নকশা৷ মুখ্য উদ্দেশ্য সওদা৷ সেকালে চাঁদনি চক ছিল দুনিয়ার কেনাবেচার কেন্দ্র৷ ভিড় গমগমে৷ বাজারের আয়তন এক কিলোমিটারের বেশি৷ ১৫৬০ টির মত দোকান৷ তাতে কাবাব থেকে শুরু করে রত্ন হিরে মোতি সব কিছুই পাওয়া যেত৷ পাওয়া যেত বিদেশি সম্ভার৷ আশরাফি বা জহরি বাজার ছিল বেচাকেনা লেনদেনের মূল কেন্দ্র৷ চাঁদনি চক নিয়ে জাহানারা বেগমের উৎসাহ ও উদ্যোগ ছিল তুমুল! তবে তাঁর অতু্যৎসাহী উদ্যোগী ভূমিকাটি ছাপিয়ে ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ৷ তাঁর মরমিয়া মন ফকিরা উদাসীনতা৷ অনালোকিত বিপ্রতীপ বিন্দু তো বটেই আবার একই অবয়বে কত বৈপরীত্যের মিশেল৷

ডাচ ও ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসার আগ্রহ জাহানারা বেগমের অবশ্যই ছিল৷ তখন মোঘল বিলাসিতা ও শিল্পকলার রাজযোটক পর্ব চলছে৷ আর পাদিশাহ বেগমের আয় আসছে সুরাট বন্দরের শুল্ক থেকে৷ পানিপথ থেকে৷ জাহানারা বেগমের দুটি জাহাজ ছিল সাহিবি আর গাঞ্জাওয়ার৷ তাঁর জাহাজ ব্যবসার দুটি উদ্দেশ্য ছিল৷ এক হল বাণিজ্যিক আয় আর দুই হল হজ তীর্থ যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া৷ মোখা ছাড়াও লোহিত সাগরের জেদ্দা বন্দরেও জাহাজ ভিড়ত৷

রাজস্ব আদায়ে শাহজাদির ছিল কড়া নজর ও সেই সঙ্গে তৎপরতা৷ শাহজাদির নিশান বা সরকারি আদেশ তখন ইংরেজ বণিকদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ৷ জাহানারার কাছে পাঠানো হত মশলাপাতি, তেল৷
তাঁর একটি নিশানে কস্তুরী পাবার কথা লেখা আছে৷ আরেকটিতে বরফ৷ বরফ নিয়ে তাঁর কিছু অনুযোগও ছিল৷ আরেকটি নিশানে তিনি আধিকারিকদের রাজস্ব আদায়ে নজরদারি বাড়াতে বলেছেন৷ মজুরদের ন্যায্য পাওনা দেবার কথা বলেছেন৷

ভেনিসের পর্যটক ও লেখক নিকোলো মানুচ্চি অনেক লিখে গেছেন এসব নিয়ে৷ টাকা খাটানোর কাজ মেয়েরা বেশ ভালোই পারত৷ রাজপুত রাজবাড়ির মেয়েরা এই ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে ছিলেন৷ এলাকার ছোটবড় বণিকেরাই ধার করত তাদের কাছে৷ আবার বানিয়া মেয়েদের কাছে ইংরেজরা গিয়ে হাজির হয়েছেন এমন উদাহরণও আছে৷

ছোটখাটো ক্ষেত্রে দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, ঘুঁটে, মেয়েরাই বেচাকেনা করত৷
শুধু বহির্বাণিজ্য নয় দেশের ভেতরেও ব্যবসা করতেন মোঘল নারীরা৷ জায়গির থেকে অনেক আয় হত তাঁদের৷ ১৬৬৫ সালে নূরজাহানের একটি হুক্ম্ (হুকুম) বা আদেশ পাচ্ছি আমরা যেখানে তিনি কাসবা সিরোঞ্জে নূরগঞ্জ কাটরায় (বাজার বা বাণিজ্যের জায়গা) বণিকদের ও বিক্রেতাদের বসবাস করতে বলছেন৷ মানে জায়গাটির বাণিজ্যিক প্রসার ঘটানো তাঁর উদ্দেশ্য৷

জাহানারা বেগম অনেক কারখানা তৈরি করেছিলেন৷ হুনার বা শিল্পকলার জন্ম হত সেইসব কারখানায়৷ মোঘল হারেমে সরবরাহ ছাড়াও বিপুল বাণিজ্যের রসদ ছিল সে সব সামগ্রী৷
সরাইখানার কথাও ভেবেছেন তিনি৷ বলেছিলেন, এমন একটা সরাইখানা বানাবো হিন্দোস্তানে যার কোনো জুড়ি থাকবে না৷ পথিক এখানে মনপ্রাণ দেহ জুড়িয়ে নেবে আর আমার নাম চিরঅক্ষয় হয়ে থাকবে৷

দৃশ্য চার
গারদি কা ওয়খত বা বিক্ষুব্ধ সময়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিলেন বেগম সামরু৷ দিল্লির চাওড়ি বাজারের খানুম জানের কোঠার এক পঞ্চদশী বাইজি থেকে মেরঠের কাছে সারধানার বিশাল সম্পত্তির ও জায়গিরের মালিকানা৷ হাউইএর মত উড়ে গেছেন তিনি, তুবড়ির ফুলঝুরির মতো এক অন্যরকম রূপকথার নাম বেগম সামরু৷ শেষ মোঘলেরা তখন রোহিলা, মারাঠা শিখ রাজপুত আক্রমণে পর্যুদস্ত৷ তার ওপরে বিষফোঁড়ার মত নাদির শাহ ও আহমদ শাহ আব্দালির লুঠমার৷ তার ওপর পলাশী যুদ্ধের পরে ব্রিটিশ শক্তির উত্থান৷ এইসময় অনেক ইয়োরোপীয় সেনা ভাড়াটে সৈনিকের কাজ করত৷ বেলজিয়ামের এক ভাড়াটে সেনা ওয়াল্টার সমব্রের সঙ্গে প্রেম হয় ফারজানা নামে নাচিয়ের৷ সংক্ষেপে বলি, এই জুটি উত্তাল সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে মোঘল বাদশা শাহ আলমের বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন৷ বিশেষ করে ফারজানা, যিনি নিজে সেনাবাহিনির নেতৃত্ব দিতেন, বার দুয়েক নাটকীয়ভাবে শাহ আলমের প্রাণ বাঁচিয়ে বাদশার স্নেহের পাত্রী হয়ে ওঠেন৷ সারধানার অগাধ জায়গিরের মালিক হয়েছিল ফারজানা৷ সমব্রেকে বিয়ে করে তার পরিচয় হয় বেগম সমব্রে বা সামরু৷ ওয়াল্টার সমব্রে এই সম্পত্তি পাবার পরেই মারা যান৷ ১৭৭৮ সালে বিরাশি জন ইওরোপীয় অফিসার সমেত চার হাজারি সেনার সেনানায়ক হলেন বেগম৷ সারধানার মালকিনের কূটনৈতিক দক্ষতা প্রশ্নাতীত! সামরু খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে নাম নিলেন জোয়ানা৷ আজ মেরঠের সারধানার পুরো এলাকাটাই একসময় ছিল বেগম সামরুর দখলে৷ বিপুলায়তন জায়গির, অগাধ সোনারুপো একা হাতে সামলেছিলেন ঘটনার ঘনঘটার মধ্য দিয়ে যার জন্ম সেই অখ্যাত এক অঘটন ঘটন পটিয়সী সামরু বেগম৷ এক সফল সেনাপ্রধান, কূটনীতিক ও জায়গিরদার৷ জায়গিরের আয় ছিল অনেক৷ জলপথ ও স্থলপথে পণ্য পরিবহনে বেগম কর আদায় করতেন৷ শুধু কূটনীতি ছলাকলা নয় বেগম সামরু অর্থ নীতিতেও সমান পারদর্শী৷ বাদশা শাহ আলম তাঁকে ডাকতেন জেবউন্নিসা বলে৷ সে নাম সার্থক৷ নারীরত্ন! অগুন্তি পুরুষ তাঁবেদার পরিবৃত, মাথায় পাগড়ি, মুখে হুঁকো ছোট্টখাট্টো বেগমের দরবারের ছবি ঠিক যেন গোপিনী বৃত্তে কৃষ্ণের একটি বিপরীত চিত্র৷ সারধানায় নিজের নির্মিত ব্যাসিলিকা চার্চের মধ্যেই সমাধিস্থ এই ক্ষুরধার মহিলাটিকে আমরা ভুলে গেছি৷

দৃশ্য পাঁচ
ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজ গুছোতে এসে এক বিচ্ছিরি ঘুষ নেবার কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়েছিলেন৷ গোমস্তা ইজারাদারদের দিয়ে ভালোই আয় হচ্ছিল কিন্ত্ত মুন্নি বেগমের অনুরোধ উপেক্ষা করা অত সোজা ছিল না৷ এর আগে ক্লাইভের আমলে কোম্পানির কোষাগার বেগম উপুড় হস্ত করে ভরে দিয়ে ‘কোম্পানির মা’ হয়ে উঠেছিলেন৷ কারণ তার নাবালক পুত্রকে সিংহাসনে বসাতেই হবে৷ বেগম হলেন মীরজাফরের গারদিনশিন বেগম মুন্নিবাঈ৷ খানিকটা বেগম সামরুর মত তার জীবনের উত্থান৷ সেই যে দিল্লি থেকে মুর্শিদাবাদে নাচ দেখাতে এলেন তারপর আর ফিরে যাওয়া হয়নি তার৷ ক্ষমতাকে কী করে বটুয়ায় বেঁধে রাখতে হয় বিলক্ষণ জানতেন তিনি৷ তখন ক্লাইভ কলকাতা নামের নোংরা অস্বাস্থ্যকর জায়গায় না থেকে দমদমে বাস করতে শুরু করেন৷ তার বউয়ের বাচ্চার ধাইকে মুন্নি বেগম মুর্শিদাবাদ থেকে পাঠিয়েছিলেন৷ এমনটাই ভাব-ভালোবাসা ছিল কোম্পানির সঙ্গে বেগমের৷ এরপর চক মসজিদ বানিয়ে দেদার দানছত্র খুলে বসেন তিনি৷ সেটা আবার কোম্পানির ইজারাদারেরা সুনজরে দেখতো না৷ কোম্পানি বলতে শুরু করল এখন তো মসনদে বব্বু বেগমের ছেলে বসেছে৷ সুতরাং মুন্নি বেগমের প্রাসাদ রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরে আসা উচিত৷ এই মুন্নি বব্বু পাঞ্জা লড়াইতে ঢুকে গেলেন হেস্টিংস৷ প্রচুর ঘুষ নিলেন মুন্নি বেগমের কাছ থেকে৷ কিন্ত্ত শেষ রক্ষা হল না৷ কোম্পানির কাউন্সিল মুন্নি বেগমকে সরিয়ে বব্বুর হাতে ক্ষমতা দিল৷

মুন্নি বেগমের কথা এইজনই বলা হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাসে মুন্নি বেগমের অবদান অনেক৷ ক্ষমতা ধরে রাখার কী উদগ্র বাসনা ছিল তার! অসাধু উপায়ে হলেও বা কী! বেগমকে এই পয়সাকড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করায় উত্তর এসেছিল, ঘুষ কাকে বলে জনাব? মহলে অতিথিরা এলে তাদের খাতিরদারি করতে হয়, আপ্যায়ন করতে হয়, সওগাত দিতে হয়৷ এসব কথাও বলে দিতে হবে নাকি?
তার মৃতু্যর পর ইউনিয়ন জ্যাক অর্ধনমিত রাখা হয়৷ দেওয়া হয় গান স্যালুট৷ কারণ তিনি ছিলেন মাদার এ কোম্পানি!

এই লেখা শেষ করব এমন একজন নারীর কথা দিয়ে যার সঙ্গে মুন্নি বেগমের বিশেষ স্নেহের সম্পর্ক ছিল৷ তিরিশ কাহার বইতে পারে এমন একটি বিশাল পালকি তিনি বেগমকে উপহার দেন৷ তিরিশ কাহারের খাই খরচা মেটানোর জন্য একটা গ্রামও তিনি দিয়েছিলেন৷ তিনি হলেন অর্ধবঙ্গেশ্বরী রাজসাহীর রানি ভবানী৷ রানি ভবানীকে পুণ্যবতী দানশীলা হিন্দু বিধবা বলে বলে তার চরিত্রের মূল ভিত্তিচিত্রটির বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হয়েছে৷

অর্ধবঙ্গেশ্বরী মানে তার জমিদারীর আয়তন ছিল সুবিশাল৷ কোম্পানিকে রানি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দিতেন৷ জমিদারির আয় ছিল দেড় কোটি৷ প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা তিনি খাজনা দিতেন৷ স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় কী অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি ছিল তার৷ বিপুল জমিদারি দেখভাল শুধু নয় সেই সঙ্গে ছিল নিরন্তর প্রজাকল্যাণ৷

‘ভবানীর সমকীর্তি কেহ নাহি ধরে’৷
মুন্নিবেগমের কাছে উৎকোচ নেওয়া হেস্টিংস রানি ভবানীর জমিদারি গিলতে বিশেষ ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন৷ বাহারবন্দ পরগনার কথা এ প্রসঙ্গে এসে পড়ে৷ তখন ভয়ানক মন্বন্তর ও মারী বাংলাকে ছারখার করে দিচ্ছে৷ রানি তার প্রজাদের আগলে রেখেছিলেন৷ তার বিশেষ নজর ছিল এই অকালে না খেতে পেয়ে বিনা চিকিৎসায় কোনো প্রজা যেন তার জমিদারিতে মারা না যায়৷ খাজনা আদায় বন্ধ রাখলেন তিনি৷ মনে রাখতে হবে প্রাচীন জমিদারিপ্রথা পৃষ্ঠপোষক ও পোষ্যবৃন্দের সম্পর্কের উপরেই দাঁড়িয়েছিল তার নানান নেতিবাচক দিক সত্ত্বেও৷ ইংরাজরা এসে গ্রামসম্পর্কের এই মেরুদন্ডটাকে ভেঙে দিয়েছিল৷ রাষ্ট্র হয়ে উঠছিল পীড়নযন্ত্র৷ রানি কলকাতার ইংরেজ কাউন্সিলের দ্বারস্থ হলেন৷ তিনি বললেন প্রজাকল্যাণ আমার ধর্ম৷ আমি কিছুদিন খাজনা আদায় বন্ধ রেখেছি আর কোম্পানি কিনা এই সুযোগে আমার সম্পত্তি দখল করতে চায়!

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রানি তাঁর জমিদারি রক্ষা করেন৷ সিরাজ তাঁর বালবিধবা কন্যা তারাসুন্দরীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন শোনা যায়৷ সে নিয়ে অনেক কাহিনিও আছে৷ অত্যন্ত সুচতুর কৌশলে তিনি সেই সমস্যা মিটিয়েছিলেন৷ চারিদিকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদের মধ্যে রানি কিন্ত্ত বাংলার সেই ঘোরতর দুর্দিনে বাংলার নবাবকেই সমর্থন করেছিলেন৷ নবাব তাঁর কাছে সিরাজ নামক ব্যক্তিমাত্র নন৷ নবাব মানে বাংলার স্বাধীনতা৷ দেশের তুমুল অরাজকতা ও বর্গী হাঙ্গামার মধ্যে রানি সুকৌশলে তাঁর বিপুলায়তন জমিদারি সামলেছেন দশভূজা দুর্গার মতোই৷ এমনকি কোম্পানির সঙ্গে যখন পরিযায়ী মাদারি ফকিরদের ঝামেলা বাধে তখন তাদের নেতা মজনু শাহ রানির কাছে আবেদন করেন যে আপনি আমাদের মালকিন৷ আপনিই এই দুর্যোগে হাল ধরুন৷ এতোটাই ছিল রানি ভবানীর সুনাম ও প্রতাপ৷

তিনি তাঁর ক্ষমতা ও বুদ্ধি দিয়ে পথ চলেছেন৷ কোনো দলেই ভিড়ে যাননি৷ মেয়ে সুলভ দুর্বলতা বোঝাতে ঘোমটা পরে থাকো বা চুড়ি পরে নাও, এসব কথা আমরা শুনে এসেছি৷ সেকালে সিরাজ-বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে রানি ভবানী শাঁখা সিঁদুর ও শাড়ি পাঠিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, অবলার মতো কাজ যেন তিনি না করেন৷ না রাগ নয়, রানিকে দেখতে হবে তাঁর কালের প্রেক্ষিতে৷ প্রবল প্রতাপান্বিত পুরুষদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সমস্ত বাধা তিনি দাপটের সঙ্গে অতিক্রম করেছিলেন৷ প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে এই সময় বাংলায় বেশ কয়েকজন মহিলা জমিদার বেশ দুঃসাহসের সঙ্গে রাজত্ব করে গেছেন৷ তাঁদেরই একজনের নাম জয়দুর্গা দেবী৷

কবি নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ কবিতায় রানি ভবানী যেন দেশের বিবেক৷ তাঁর মুখ দিয়ে শোনা গেছে ভবিষ্যৎ দূরদ্রষ্টার আক্ষেপ,
‘দীনহীনা নারী আমি তবু মহারাজ
দেখিতেছি দিব্যচক্ষে সিরাজদৌল্লায়
করি রাজ্যচু্যত, শান্ত হবে না ইংরাজ
বরঞ্চ মত্ত হবে রাজ্যপিপাসায়৷’

খণ্ডচিত্র বটে৷ কিন্ত্ত চিত্র তো অবশ্যই৷ হারিয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে থাকা রঙের রেখাকে স্পষ্ট করে তুললেই এক অজানা দুনিয়া এসে হাজির হয়৷ এমন অনেক মুখ লুকিয়ে আছে৷ কিছু কি আশ্রয় নিয়েছে গল্পে বা কল্পনায়? আমার মনে পড়ে, আমির খুসরোর বাগ ও বাহারের সেইসব মেয়েদের কথা— যারা ঘোড়া ছোটায়, পুরুষের বেশে ভিন দেশে গিয়ে ব্যবসা করে, বাবার অপমানের বদলা নেয়, ফলাও করে প্রেম করে বা হামজানামার শিরিন নামে মেয়েটি যে এমন একট শহর শাসন করে যেখানে শুধু মেয়েরাই থাকে, কোনো ছেলে নেই৷ আর রাত জেগে তাদের পাহারা দেয় সিমুর্গ পাখির বৌ!