কেয়া চট্টোপাধ্যায়
লাল, নীল রঙিন মোড়কের সারি। মোড়ক খুললেই লোভনীয় নানান স্বাদের বাদামি, মিষ্টি, খাদ্যদ্রব্য। কোনোটা ফ্রুট অ্যান্ড নাট, কোনোটা আবার মিল্ক চকোলেট। অনেকের আবার পছন্দ ডার্ক চকোলেট বা হোয়াইট চকোলেট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে চকোলেটের আকার, আকৃতি ও স্বাদের পরিভাষা। তবে এই চকোলেট কিন্তু হাজার হাজার বছর আগে মিষ্টি দ্রব্য হিসেবে একেবারেই ব্যবহৃত হত না। বরং এটিকে ব্যবহার করা হত ওষুধ হিসেবে। আশ্চর্য ব্যাপার! তাই না? বেশ তাহলে কিছুক্ষণের জন্য সময় সরণিতে পিছিয়ে যাওয়া যাক, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগের মেসো-আমেরিকান সভ্যতায়। চকোলেটের উৎপত্তি তো এদের হাত ধরেই।
আমাজন রেনফরেস্টের স্থানীয় উদ্ভিদের মধ্যে একটি হল কাকাও গাছ। এর ফল থেকে পাওয়া যায় কোকোয়া বিন্স যেটি এই ফলের বীজ। এই বীজকেই শুকিয়ে গুঁড়ো করে এবং আরও নানাধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করে তৈরি হয় শুকনো চকোলেট। তবে প্রথমদিকে চকোলেট এখনকার মতো শক্ত বানিয়ে খাওয়া হত না। অল্মেক সভ্যতার মানুষরা প্রথম কোকো বিন্স থেকে পানীয় তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এর কয়েক শতাব্দী পরে, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতার বিকাশ ও পরিব্যাপ্তি ঘটে। এই দুই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন, ছবি ও লিপি থেকে বোঝা যায় এই সময় এক বিশেষ ধরনের পানীয় বিভিন্ন ধার্মিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পান করার চল ছিল। এই পানীয়কে এরা এতটাই পবিত্র বলে মানত যে কোকোয়া বিন্সকে তারা ঈশ্বরের উপহার বলে মনে করত। এই পানীয় আর কিছুই নয় কোকোয়া বিন্স আর জলের মিশ্রণে তৈরি একটি বিশেষ তিক্ত পানীয়। তবে মহিলা বা শিশুদের এই পানীয় পান করার অনুমতি ছিল না। মনে করা হত এই পানীয়ের তীব্র প্রভাব সহ্য করার মতো শক্তি তাদের নেই। তাছাড়া কোকোয়া বিন্স বিনিময় প্রথা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উপহার ও ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করা হত।
১৫০২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের জাহাজ মায়ান সভ্যতার কোকো বিন্স বোঝাই একটি নৌকা আটক করে। এই বিন্সগুলি তারা নিয়ে যাচ্ছিল বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। তবে দূরদর্শী কলোম্বাস সেই সময় এই ‘mysterious-looking almonds’ বলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কোকো বিন্সের মাহাত্ম্য আমাজনের জঙ্গলের ছোট্ট গণ্ডি ছেড়ে ইউরোপীয় দেশগুলিতে ছড়িয়ে পরে স্প্যানিশ যোদ্ধা এরনান করতেসের হাত ধরে। করতেস ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় মন্তেজুমা-র দরবারে প্রথম তরল চকোলেট পান করেন এবং মুগ্ধ হন। ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই বিন্সগুলিকে স্পেনের তৎকালীন রাজাকে উপহার স্বরূপ দান করেন। রাজ রন্ধনশালায় কোকো বিন্সের তিক্ত পানীয়কে পানযোগ্য করার জন্য তাতে মেশানো হল চিনি ও মধু। ব্যস, এক অনামি দ্বীপের রহস্যময় ফলের জয়জয়কার ছড়িয়ে পড়ল গোটা স্পেনময়।
চকোলেটের সুখ্যাতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল ইতালি, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে। এতদিন পর্যন্ত চকোলেটকে উষ্ণ পানীয় হিসেবেই পান করা হত। ইংল্যান্ডের লন্ডনে ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে এক ফরাসি নাগরিক প্রথম নিরেট চকোলেট বিক্রি করা শুরু করেন। সেই সময় এই চকোলেটের মূল্য ছিল ১৫ শিলিং যে মূল্য সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ক্রমে ক্রমে চকোলেট অভিজাত পরিবার এবং ক্যাথলিকদের শৌখিন পানীয়ে পরিণত হল। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি প্রাতঃরাশ বা রাত্রির ভোজনে চকোলেট খেতে শুরু করল। ইতিমধ্যেই চকোলেটের গুণাগুণ সম্পর্কিত খবরাখবর চারিদিকে চাউর হয়ে গেছে। ফলে দ্বিগুণ আমদানি মূল্যের ভার বহন করা সত্ত্বেও দেশগুলিতে চকোলেটের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে বিশ্বের প্রথম চকোলেট ফ্যাক্টরি চালু হয় ফ্রান্সিস লুই কেলারের উদ্যোগে।
পরবর্তীকালে আরও অনেক ব্যাক্তির অবদানের ফলে এই ফ্যাক্টরির উন্নতি সাধন হয়। এটিই এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন ও বিখ্যাত চকোলেট ফ্যাক্টরি। চকোলেটের এই দীর্ঘ ইতিহাসের উপর একটা গোটা মিউজিয়াম তৈরি করা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের লিন্ট চকোলেট ফ্যাক্টরিতে। এখানে যেমন অডিও ভিসুয়াল পদ্ধতিতে দর্শকদের জানানো হচ্ছে মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতা থেকে বর্তমান চকোলেটের ইতিহাস তেমনি দর্শকদের জন্য সাজানো রয়েছে সেই সময়ে ব্যবহৃত চকোলেট প্রস্তুতকারী মেশিনগুলির নিদর্শন থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, র্যাপার ইত্যাদি।
শুধু তাই নয়, এখানে বিনামূল্যে নানা স্বাদের চকোলেটের স্বাদ নেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে শুধুমাত্র সুইস চকোলেট নয়— বেলজিয়ান চকোলেটেরও কিন্তু বিশ্বজোড়া নাম। আবার স্কটল্যান্ডের ঘরে ঘরে কুটির-শিল্পের মতো গড়ে উঠেছে চকোলেট শিল্প। বিশ্ব জুড়ে বহু ব্যবসায়ীরা রঙিন মোড়কে সজ্জিত করে চকোলেট পৌঁছে দিচ্ছেন আমাদের অন্দরমহলে। তবে এই সুমিষ্ট খাদ্যটির স্বাদের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ভুললে চলবে না যে, এই চকোলেট শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু দরিদ্র মানুষের শ্রম। বাজার ধরে রাখার জন্য বড় বড় কোম্পানিগুলি ঘানা, আফ্রিকা ইত্যাদি পিছিয়ে পড়া দেশের শ্রমিক ও শিশুদের দিয়েও কোকোয়া চাষে বাধ্য করাতো। সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য এই কাজ একপ্রকার দাসত্বে পরিণত হয়েছিল। সংবাদ মাধ্যম এই খবরটি প্রচারের আলোয় আনার সঙ্গে সঙ্গে এই নির্মম প্রথা আইন প্রণয়ন করে বন্ধ করা হয়। পৃথিবীর যা কিছু ভালো, তার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্ধকার। চকোলেটের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়।