• facebook
  • twitter
Sunday, 21 December, 2025

প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

ধারাবাহিক উপন্যাস

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

২২.
চিত্রজিৎ

Advertisement

প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস––

Advertisement

এখনও চৈত্রমাসের ঢের ঢের দেরি, তবু এই গানটা হঠাৎ সুরঞ্জনার গলায় শুনে কেমন যেন চমকে উঠল চিত্রজিৎ৷

শরৎ শেষ হয়ে সবে হেমন্ত উঁকি দিয়েছে কলকাতার শরীরে, তবু ঠান্ডার আমেজ নেই ছিটেফোঁটা৷ চিত্রজিৎ এমন কর্মহীন থাকে না কখনও, যা এখন৷ নতুন কী ছবি আঁকবে, আদৌ আর আঁকতে পারবে কি না, এমন দোলাচল সারাক্ষণ৷ তার মাসাধিককালের পরিশ্রম সুরঞ্জনা এক মুহূর্তে ছিঁড়ে ফালাফালা করে দেওয়ার পর কিছুক্ষণ হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ কয়েক মুহূর্ত মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু দুই হাতের মুঠো সজোরে চেপে সামলে নিয়েছিল নিজেকে৷

তারপর থেকে সুরঞ্জনার সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত নেই৷ এক ছাদের নীচে থাকে, যে যার ঘরে৷ সুরঞ্জনাও অনেকদিন হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজে বসেনি৷ চিত্রজিৎও ছোঁয়নি রঙ-তুলি৷

তার ঘরের মধ্যে অপেক্ষারত চিত্রজিতের ইজেল নিশ্চয় বিস্ময়-বিমূঢ়, শিল্পী তার শরীর একবারের জন্যও ছুঁয়ে দেখেনি৷

চিত্রজিতের হাত নিসপিস করছে এক ভয়ংকর নিশ্চেষ্টতার মধ্যে বসবাস ক’রে৷ একজন শিল্পীর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান৷ প্রতিদিনই তাকে কিছু না কিছু সৃজন করতে হয়৷ সৃজনে বিরতি দিলে শিল্পীর দক্ষতার ধার কমে আসে৷ অথচ সেই শিল্পী যদি দীর্ঘদিন সৃজনহীন থাকে, তবে—
চিত্রজিৎ একা-একা ছটফট করে, এক ভয়াবহ নৈঃশব্দের শিকার হয়ে ঘরবন্দি এ ক’দিন৷
পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে:
প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস––
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ৷৷
কয়েকদিন আগে রবীন্দ্রসদনের পাশ দিয়ে আসার সময় গেটের পাশে বিশাল হোর্ডিং দেখে থমকে গিয়েছিল চিত্রজিৎ৷ একটি অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন৷ পাশাপাশি দু’টি বিশাল মাপের ছবি৷ তমোনাশ গুপ্তর ছবির পাশে সচকিতা রায়চৌধুরির ছবি৷ দেখে প্রবল বিস্ময় চিত্রজিতের৷ সুরঞ্জনা বসুর নাম বা ছবি কোথাও নেই৷ সংগঠক সেই ‘রবি–অনুরাগ’ গোষ্ঠী৷

সংস্থাটির কর্ণধার রত্নদীপবাবু তো সুরঞ্জনার খুব অনুরাগী৷ অথচ এই অনুষ্ঠান সুরঞ্জনাকে না নিয়েই করলেন!
চিত্রজিতের মনে কাটাকুটি চলছে আরও একটি ভাবনার৷ সুরঞ্জনা-তমোনাশ জুটি এই মুহূর্তে রবীন্দ্রসংগীত জগতে অতিচর্চিত৷ হঠাৎ সেই জুটি ভেঙে রত্নদীপবাবু নতুন জুটি আনলেন কেন, তাঁর সংস্থার অনুষ্ঠানে? আরও লক্ষ্যণীয়, সেখানে সুরঞ্জনার কোনও আমন্ত্রণ নেই!

চিত্রজিৎ এও লক্ষ্য করেছে বেশ কিছুদিন ধরে রেওয়াজেও বসেনি সুরঞ্জনা৷ এতদিন পরে হঠাৎ যা-ও বা আজ বসেছে, তাও এমন একটি গান, যা আগে কখনও করেনি৷ গানটার কথাও যেমন অন্য অর্থবহ, তেমনই তার সুরও৷ এখন চৈত্র মাস নয়, অথচ চৈত্রের সন্ধ্যায় আকাশ রাঙা হয়ে যাওয়ার যে-ছবি, সেই ছবিতে সুরঞ্জনা সুরারোপ করছে নিজের মতো করে।

চৈত্র-সন্ধ্যায় সুরঞ্জনা কার চোখে নিজের সর্বনাশ দেখেছে! চিত্রজিতের চোখে, ন্যুড ছবি আঁকার কারণে, না কি তমোনাশের চোখে! তবে কি তমোনাশের সঙ্গে ইছামতী যাওয়ার পর্বে সৃষ্টি হয়েছে কোনও সমস্যার!
চিত্রজিৎ শুনছে সুরঞ্জনার দেওয়া সুরে গানটির পরের অংশ :
এ সংসারের নিত্য খেলায় প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়৷
বাটে ঘাটে হাজার লোকের হাস্য-পরিহাস—
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ৷৷
রবীন্দ্রনাথের এই গানটির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে এক আশ্চর্য দার্শনিকতা৷ এই জগৎসংসারে প্রাণের মেলায় প্রতিদিন মানুষ যে-খেলায় প্রবৃত্ত, সেই বাটে ঘাটে হাজার হাজার মানুষ ব্যাপৃত হাস্য-পরিহাসে৷ অথচ সেই হাসিখেলার মধ্যে তোমার চোখে দেখতে হল আমার সর্বনাশ৷

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সেই কতকাল আগে, গানটি সম্ভবত তাঁর পছন্দ হয়নি, অথবা এমন কোনও স্মৃতি জড়িয়ে আছে গানটির প্রতি কলিতে, যা তাঁর পক্ষে ছিল হৃদয়-বিদারক৷ কী সেই স্মৃতি, যা রবীন্দ্রনাথ ধরতে চেয়েছিলেন এই কয়েকটি মর্মস্পর্শী কলিতে!

চিত্রজিৎ যত দূর মনে করতে পারে, এই গানটি কবি লিখেছিলেন জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে পৌঁছে৷ সেই বয়সে এরকম সর্বনাশের ঘটনা না-ঘটাই স্বাভাবিক৷

তা হলে কি আগেকার কোনও ঘটনার কথা মনে পড়তে লিখে ফেলেছিলেন এই গান! অথচ সুর দেননি। তবে কি তাঁর বউঠানের দুটি চুম্বক-চোখের কথা ভুলতে পারেননি শেষ বয়সে পৌঁছেও! কী জানি কোন চৈত্রমাসের এক শেষবেলায় অস্তমান সূর্যের রাঙা আলোয় বউঠানের চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠেছিলেন কবি, সেই তাকানো এখনও শিহরন তোলে মনের গহনে৷
আমের বনে দোলা লাগে, মুকুল পড়ে ঝরে—
চিরকালের চেনা গন্ধ হাওয়ায় ওঠে পড়ে৷

গানের কথাগুলো নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে চিত্রজিতের ভিতর, ঠিক সেই মুহূর্তে মোবাইলে ভেসে উঠল রাকেশ মিত্রর নাম, একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে মোবাইল অন করতে শুনলেন, মি. চৌধুরি, আপনার ছবি কত দূর?

কী বলবেন চিত্রজিৎ বুঝে উঠতে পারলেন না, একটু সময় নিয়ে বললেন, মি. মিত্র, আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি, এই ছবি আমি শেষপর্যন্ত এঁকে উঠতে পারলাম না।
—সে কী, মি. চৌধুরি, আমি যে ওদের কথা দিয়ে ফেলেছি৷ কী সমস্যা হল আপনার? মডেল পেলেন না?
—না, মানে, আমি যে আবহাওয়ায় বড়ো হয়েছি, তাতে ন্যুড ছবি আঁকা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আপনি অন্য কোনও শিল্পীকে বলুন৷
—এখন, এতদিন পরে! এখন কাউকে বলা যাবে না৷ আপনি বরং আরও কিছুদিন সময় নিন৷
—মি. মিত্র, আপনার কথামতো ছবি আঁকতে আমি অক্ষম৷ যদি বলেন, আমি অন্য একটা প্রস্তাব দিতে পারি৷
—কী প্রস্তাব?
—আপনি জানেন, আমি ও আমার স্ত্রী, দু’জনেই রবীন্দ্রগানের পরম অনুরাগী৷ এ বছর রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র শতবর্ষ চলছে৷ ‘রক্তকরবী’ নাটকে অনেকগুলো গান আছে, আমি এক-একটি গান অবলম্বন করে ছবি আঁকতে মনস্থ করেছি৷ আপনার পছন্দ হলে সেই ছবি দিতে পারেন মুম্বাইয়ের হোটেলে৷

রাকেশ মিত্র কিছুক্ষণ ভাবলেন প্রস্তাবটি নিয়ে। তারপর বললেন, ঠিক আছে, মি. চৌধুরি, আপনি বড়ো শিল্পী, আপনার বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম৷ আপনি আরও একমাস সময় পাবেন, ওদের কনস্ট্রাকশনের কাজ এখনও শেষ হয়নি৷ তারপর শুরু হবে ইন্টেরিয়র ডেকরেশনের কাজ৷
—তা হলে কোনও সমস্যা নেই৷ রবীন্দ্রনাথের গানকে ভিত্তি করে আঁকব এক-একটি ছবি৷ এর চেয়ে বড়ো কিছু আর হতে পারে না৷ আপনি আমার উপর নির্ভর করতে পারেন৷
—ঠিক আছে, তাই হোক৷

রাকেশ মিত্র ফোন রেখে দিলে একটা বড়ো স্বস্তির শ্বাস ফেলল চিত্রজিৎ৷ গত কয়েকদিন তার ভিতরে তুমুল ঝড় চলছিল৷ এতদিনের এত পরিশ্রম৷ এখন সেই ঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষান্তি৷

কিন্তু ‘রক্তকরবী’র ছবি আঁকতে গেলে তাকে যেতে হবে শিলং৷ হয়তো একাই যেতে হবে৷ ‘রক্তকরবী’ লেখার বীজ বোনা হয়েছিল শিলং থাকতে৷ যাওয়ার আগে ‘রক্তকরবী’র গানগুলো রেকর্ড করে নিয়ে যেতে হবে৷ শিলংয়ের প্রকৃতির মধ্যে ইজেল রেখে গান শুনতে শুনতে আঁকতে হবে ছবিগুলো৷ তা হবে এক অভিনব অভিজ্ঞতা।

পাশের ঘর থেকে তখন ভেসে আসছে গানটির শেষ কয়েক কলি :
মঞ্জরিত শাখায় শাখায়, মউমাছিদের পাখায় পাখায়,
ক্ষণে ক্ষণে বসন্তদিন ফেলেছে নিশ্বাস—
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ৷৷
গানটা শুনছে আর চিত্রজিতের মনে উসিয়ে উঠছে হাজারো প্রশ্ন৷ রবীন্দ্রনাথ এরকম কবিতা বোধহয় লেখেননি কখনও, ‘সর্বনাশ’ শব্দটি এখানে খুবই প্রতীকী৷ আমের বনে দোলা লাগলে মুকুল ঝরে পড়বে, তা এক চিরচেনা সত্য৷ চিরকালের সেই চেনা গন্ধ উড়ে বেড়ায় হাওয়ায়৷ আমগাছে যখন মুকুল ধরে, সেই মুকুলের সব তো গুটি হয় না৷ সব গুটিও পরিণত হয় না আমে৷ কিছু থাকে, কিছু ঝরে যায়৷ কথাগুলো কঠিন হলেও সত্য৷ গাছের প্রতি শাখায় মঞ্জরীতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় মৌমাছিদের পাখা৷ বসন্তদিন ফেলছে তার নিশ্বাস৷ সেই গূঢ় সময়ে তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ৷

অনেকক্ষণ ধরে গানটি গাইল সুরঞ্জনা৷ গাওয়ার মুহূর্তে তার গলায় এক বেদনাঘন আকুতি৷ এই গানের সুর কি নিজেই দিয়েছে সুরঞ্জনা? রবীন্দ্রগানের গায়কির মতোই গাইতে চেষ্টা করেছে সুরঞ্জনা৷

অনেকদিন পরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে তার এই ব্যতিক্রমী চেষ্টা বিস্মিত করল চিত্রজিৎকে৷
গানটা শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ আর কোনও শব্দ নেই৷

হঠাৎ কী মনে হতে চিত্রজিৎ এ-ঘর থেকে উঠে গেল পাশের ঘরে৷ বোধহয় বহুদিন পর সে এল সুরঞ্জনার ঘরে৷ তাকে হঠাৎ দেখে চমকে উঠল সুরঞ্জনা৷ জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাতে চিত্রজিৎ জিজ্ঞাসা করল, গানটার সুর কে দিল? এই গানের সুর কি স্বরবিতানে আছে?

সুরঞ্জনা তাকে এ-ঘরে দেখে একেবারে হতভম্ব, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, না, আমি চেষ্টা করলাম সুর দিতে৷
—হুঁ, চিত্রজিৎ বলল, আমার তাই মনে হল৷ খুব সুন্দর সুর হয়েছে৷ গানটা শুনে একবারও মনে হল না এই গানের স্বরলিপি স্বরবিতানে নেই৷ রবীন্দ্রগানের গায়কী অনুসরণ করা খুব সহজ কাজ নয়৷

সুরঞ্জনা তখনও বুঝে উঠতে পারছে না হঠাৎ এতদিন পরে কেনই বা চিত্রজিৎ তার ঘরে এল, অযাচিতভাবে কেন এত প্রশংসা করছে?

যেন কিছুই হয়নি, এমন সহজ গলায় চিত্রজিৎ বলল, মুম্বাইয়ের এক হোটেলে ডেকরেশনের জন্য আমার কিছু ছবি কিনতে চেয়েছে৷ আমি ভাবছি এমন একটা সিরিজ আঁকব, যা স্পর্শ করে থাকবে রবীন্দ্রনাথের গান৷
সুরঞ্জনা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ভাবছিল চিত্রজিতের অভীপ্সা কী।

চিত্রজিৎ আবার বলল, রক্তকরবীর শতবর্ষ চলছে৷ ঠিক এই সময়ে রক্তকরবীর গানগুলো নিয়ে যদি এক-একটা ছবি আঁকি, তা হলে কেমন হবে?
সুরঞ্জনা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ভালোই হবে৷
—গানগুলো হবে ‘রক্তকরবী’র, কিন্তু ছবিগুলোর পটভূমি হবে শিলং৷ কেমন হবে?
সুরঞ্জনা এই প্রশ্নের উত্তরও নির্বিকারভাবে আগেরটার মতোই দিল, বলল, ভালোই হবে৷
—ভাবছি গানগুলো যদি তুমিও গাও৷

একটু থেমে বলল, যখন আমি ছবিগুলো আঁকব, ঠিক তখন তুমি যদি কাছেই বসে গানগুলো গাও, তা হলে ছবিগুলো খুব জীবন্ত হবে৷

সুরঞ্জনার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হল প্রস্তাবটা, বলল, কিন্তু তুমি তো বললে ছবি আঁকবে শিলং গিয়ে, সেখানে আমি কোথায়?
—তুমিও সেখানে থাকবে৷
—আমি থাকব শিলংয়ে!

চিত্রজিৎ এবার খোলসা করে বলল, আমার সঙ্গে তুমিও যাবে শিলং৷ কোনও একটা হোটেলে থাকব৷ তারপর রবীন্দ্রনাথ যে-বাড়িতে থাকাকালীন ‘শেষের কবিতা’ বা ‘রক্তকরবী’র প্লট ভেবেছিলেন, সেখানেই পর-পর কয়েকদিন ইজেল বসিয়ে একটা-একটা করে ছবি আঁকব৷

প্রস্তাবটা একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হল সুরঞ্জনার কাছে৷ বলল, তুমি আর আমি একই ফ্ল্যাটে থাকি, একই ছাদের নীচে৷ অথচ বহুদিন ধরে কোনও সম্পর্ক নেই আমাদের মধ্যে৷ হঠাৎ আজ এরকম একটা অবাস্তব প্রস্তাব আমার কাছে নিয়ে এসেছ কেন? কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমাকে শিলং নিয়ে যেতে চাইছ?

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়

Advertisement