দু’টি কবিতা
সুভাষ সরকার
চালচিত্র
আমাদের একদিনে পৃথিবীতে কতো কী ঘটে, কেউ
মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তত্ব খোঁজে প্রাণপণে, তো কেউ আবার
খুন করে নিরীহ মানুষ।
Advertisement
আমাদের একরাতে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য নথি পোড়ে,
সংগে পোড়ে সময়ের গুপ্ত ইতিহাস।
রাতভর বোবা কালা অন্ধকারে ভানু চিত্রকর
লবনাক্ত নারীদেহে আঁকে আদিমতার যৌনগন্ধী ত্রাস।
Advertisement
সন্তানের ঠাটবাটে যতটা প্রাচুর্য বুঝি, মায়ামাতৃচোখে
তত কলরব।
কোনোটাই অগ্রাহ্য করার নয়, আদরে বা অনাদরে
গ্রহণের চালচিত্র সব।
মহার্ঘ মান্যতা
কোনক্রমে বেঁচেবর্তে থাকার ইচ্ছেটুকু ক্রমশ কমছে।
মৃত্যুর কাছে প্রতিদিন একটু একটু করে নত হয় মাথা।
এখন নদীর তীরে এখন শ্মশানঘাটে যত শয্যা পাতা,
মনে হয়, তার কোনো একটাতে আমি
শুয়ে আছি একা।
দাহকাজে খানিক বিলম্ব তাই পৃথিবীতে এইভাবে শুয়ে পড়ে থাকা।
এই মৃত্যুচেতনার কাছে মহার্ঘ মান্যতা পেতে
করজোড়ে নতজানু আমি পৃথিবীর দীর্ঘতম এক রাতে।
পুরুষ বড়…
বিধানেন্দু পুরকাইত
পুরুষ বড় একলা এখন— পুরুষ ভীষণ কাঁদছে
সইতে সইতে বিক্ষততার অনল গ্রাসে জ্বলছে।
ডাইনে বাঁয়ে দরকারি মন তাকায় অনাবিল
পায়ের নিচে ফস্কা গেরো ছেঁড়া জামায় দিন
কাঠ কয়লা পুড়ে গিয়েও আবার পোড়ে নিজে
তবুও তাকে সুস্থ রাখে যে তার কলিজে।
ছুঁয়ে ফেলার স্বপ্ন ভাঙন তীব্র তীরের ফলা
আত্মজারা দূরে দূরে ছিন্ন বেহালা
কে নেবে তার আত্মহনন কিংবা মারণ রোগ
অর্থ যখন ছিবড়ে দোসর— কে রাখে সংযোগ!
পুরুষ বড় একলা এখন পুরুষ বড় কাঁদে
বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ— বেরোয় না সংলাপে।
সর্বসাধ্য
বর্ণজিৎ বর্মণ
এক কাঁখে আমি অন্য হাতে গরম ভাতের থালা
মা শোনাচ্ছে সহজপাঠ মুখে মুখে
আমি দেখি মায়ের উচ্চারিত শব্দগুলো সব চলন্ত চাঁদ
এই কাঁখে বসে পানিমারার কুঠিগ্রাম কতবার গেছি
মামার বাড়ি তিশিফুলে জড়ানো আলপথ ধরে
কখনো কখনো মা কাঁখ বদল করত
এই বদল করার ক্ষমতা, সর্বসাধ্য মা ছাড়া কারো নেই
নারী, অরক্ষিতা
বৌধায়ন মুখোপাধ্যায়
নিশ্চিত বিষের মাত্রা রোজ পান করি
আমরা অভাগী পণ্য নারী।
রোজ শঙ্কার মেঘ ঘনায় আকাশে
খাদ্যহীন, সুরক্ষাহীন
শুয়ে থাকি অচেনা পুরুষের পাশে।
তুমি কেন রোজ আসো এই নিষিদ্ধ পাড়ায়
কেউ কি সাধ করে নিজের গণ্ডি ছাড়ায়?
তুমি কি আরেকটি পালছেঁড়া দেবদাস হতে চাও
তাহলে শুধু প্রেম নয়, আমার শরীরও নাও।
জানি এই হাটে যৌন লেনদেন পীরিতি উধাও
যতদিন গতরে জেল্লা রবে, মিটবে ক্ষুধাও
তুমি ফিরে যাও, এসো না এই অন্ধ নরকে
আমরা এইবার শেষ অভিশপ্ত কোভিড মড়কে।
ঐশ্বর্যবতী বাগানবিলাস ও কালের নৈঃশব্দ্যমালা
অনিন্দিতা মিত্র
প্রতিটা ঈশ্বর-কাল সাজিয়ে রেখেছি বাগানবিলাস ফুলের অপরূপ মাধুরী দিয়ে। প্রান্তিকের ধুলোর পথে যেদিন আমার ঠোঁটে প্রথম এঁকেছিলে চুমুর আলোচিহ্ন, সূর্য সেদিন নিজের অস্তজাত রঙে লুকিয়ে রেখেছিল ভালোবাসার আকর-গ্রন্থ। চলিষ্ণু সময়ের অক্ষরেখায় মোহনবাঁশির সুরমূর্ছনা, সভ্যতা নিজের হৃদদেশে আগলে রাখে চিরকালের ঐশ্বর্য। দুপুরের নির্জনতার ভাষাপত্রে অফুরান গন্ধসুধা ছড়ায় বৈকালিক প্রস্রবণের ধারা।
নৈঃশব্দ্যমালার ডালে ডালে ঘুমন্ত পাখিদের মধুশয্যা। অনন্ত শূন্যতার ভেতরে নিঃস্বতার সূক্ষ্ম কারুকার্য, প্রেমের জলে ভিজতে ভিজতে আমরা দু’জনে মাঝে মাঝেই পাখি হয়ে উড়ে যাই।
বিজয়গাথা
শাশ্বতী চক্রবর্তী
তারায় ভরা রাতের আকাশ এঁকে রাখি চোখের পাতায়
মেঘলা দুপুর দুয়োরানি হয়ে যায়।
শুধু জয়মাল্যের সৌরভ চিনি
কিন্তু ফুল ফোটার গল্প জানি না।
জানতে চাইও না।
শুধু চেয়ে দেখি হাজার বিনিদ্র বর্ণমালা
ঢেকে দেয় একটা ধূসর সন্ধ্যা।
মুহূর্তের বর্ণিল উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া
নীলাভ চোখ দুটো ছুঁতে হাজার মাইল হেঁটে যাই
সাজাই অফুরান গল্পমালা,
কিন্তু চোখের জলের রঙ চেনা হয় না কখনো।
অথচ সেই জল রঙেই লেখা হয় পৃথিবীর সব বিজয়গাথা।
কথাগুলো
তীর্থঙ্কর সুমিত
কথাগুলো…
ভালো থাকার অভ্যেস
সব বদলে বদলে এখন
নতুন হয়ে উঠেছে নদীপাড়
কত না জানা ব্যর্থতা খুঁটে খায় চড়ুইয়ের দল
অনন্ত বিকেলে আঁকা
শকুন্তলার চোখ ভেজানো এক ছবি
যে ছবি
জল ছুঁয়ে, মাঠ ছুঁয়ে
দূর দিগন্তে—
আজ বৃষ্টির প্রয়োজন ।।
একদিনের সংলাপ
শ্যামাশ্রী মুখোপাধ্যায়
যে কথারা শুরু হয়েছিল কখনও
স্লিপিং পিলের মতো নিঃশব্দে মিশে যায় গভীরে
আজ সারাদিন কথা হল না তোমার সাথে
হয়তো হবেও না আর কখনও…
একটা সুতীব্র শূন্যতা অনুভব করছি…
মাত্র একদিনের সংলাপে এতটা ঘোর!
কীভাবে কাটাবো এ ঘোর!
বিনিসুতোর মতো একদিন কেটে যাবে এ টান—
যে টানের একমাত্র জাদুকর ছিলে তুমি!
রহস্যের ভেতর রহস্য ভেদ করে
যে মায়াজাল তৈরি হয়েছিল কখনও
তার উত্তর আমাদের জানা হবে না…
বিবর্ণ জলের গর্জন
কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়
মানুষের ক্লান্ত মুখ দেখেও, কেউ নাম জানতে চায় না
কাগজের বদলে আজকাল হাওয়ায় চিঠি উড়ে যাচ্ছে,
সবার হাতেই খেলনার মতো চাবি
তবু দরজা খুললে, ঘরের ভিতরে কোনো ঘর নেই!
নদীর বুকে উত্তাল স্রোত, শূন্য করে দেয় বাসস্থান
পাখি ডাকছে অবিরাম, ডানার শব্দ শোনা যায় না
ঘড়ির কাঁটা এগোলেও, সময় যেন থমকে আছে
মানুষের দঙ্গল ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে চারিদিকে!
তাদের মুখ বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন!
দু’হাত বাড়িয়ে ত্রাণের খাবার নিতে লজ্জাবোধ হয়,
তাই শব্দহীন ভিড় জমে ওঠে, আনাচে কানাচে
কান্নার ভিতরেও শোনা যায়, বিবর্ণ জলের গর্জন!
Advertisement



