• facebook
  • twitter
Thursday, 14 August, 2025

কারাবাস

বাবার অশ্রু ভেজা ঝাপসা দু’টি চোখ অতনুর দুঃখ যন্ত্রনায় ফিকে হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকাল একবার। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘চিন্তা করবো না!

কাল্পনিক চিত্র

মনিরুল ইসলাম মল্লিক

খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার অতনু হাজরা এখন পুলিশ কাস্টডিতে। অভিযোগ, তিনি আজ নিজের স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজামউদ্দিন কাজির সঙ্গে মিড-ডে মিল নিয়ে ছুটির সময় বচসায় জড়িয়ে পড়েন। সেই বচসা একসময় হাতাহাতিতে পরিণত হয় এবং প্রধান শিক্ষককে মাটিতে ফেলে অনবরত বুকে লাথি মারেন। সেই লাথির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে নিজামবাবু মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শী, বিদ্যালয়েরই আরো দু’জন শিক্ষক। একে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড়ে গোটা রাজ্য এরই মধ্যে এই ঘটনাকে শিক্ষাজগতে এক কলঙ্কিত অধ্যায় বলে অভিহিত করছেন গুণীজনেরা। শিক্ষকদের সম্মান এমনিতেই অনেক নীচে নেমেছে তার উপর এই ঘটনা যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিল।

খবর পেয়ে থানায় ছুটে এসেছেন অতনুর বাবা-মা এবং স্ত্রী। অতনুর বাবা পুলিশকে অনেক করে বললেন, ‘আমার ছেলে খুব সৎ এবং একটু প্রতিবাদী। তাই বলে সে কখনও কারো গায়ে হাত তোলে না।’

এসআই পার্থবাবু অতনুর বাবার কথায় আমল দিলেন না। বললেন, ‘কাল আসামীকে কোর্টে তুলছি সেখানে যা বলার বলবেন।’

অতনু ছেলেবেলা থেকেই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাংলা পরীক্ষায় একটা রচনা এসেছিল— তুমি বড়ো হয়ে কী হতে চাও। অতনু লিখেছিল আমি বড়ো হয়ে শিক্ষক হতে চাই। মাতৃভাষা তার খুব প্রিয় তাই মাধ্যমিকে ৮৮% নম্বর পেয়েও অতনু বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়নি। বাংলার টিচার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে কলাবিভাগে ভর্তি হয়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর এমএ, বিএড সব করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন স্কুল সার্ভিসে নিয়োগ বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়েই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়েছে। ইচ্ছা ছিল বাংলার টিচার হওয়ার, হয়েছে প্রাইমারির টিচার। তবে এতে তার ক্ষোভ নেই। যতদিন না হাইস্কুলে চাকরি হচ্ছে ততদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরিটা করাই যায়।

নিজের জেলাতে চাকরি হলেও বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল অনেকটাই। সেই উদয়নারায়ণপুর। প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশ কিলোমিটার পথ রোজ বাইক জার্নি অতনুর কাছে যেমন কষ্টকর ছিল তেমন সুখকরও। স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দনবাবু ছিলেন দারুণ মানুষ। একটা স্কুল কীভাবে চালাতে হয় বোধ হয় তাঁর থেকে ভালো আর কেউ জানে না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যে এত সুন্দর হতে পারে অতনু ওই স্কুলে জয়েন না করলে জানতে পারত না। সুন্দর বিল্ডিং, ঝকঝকে কিচেন, স্কুলের নিজস্ব কিচেন গার্ডেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন টয়লেট, সুন্দর অফিস, আলাদা টিচারসরুম, স্কুলের বিশাল খেলার মাঠ দেখে অতনুর মন বসে গিয়েছিল।

চন্দনবাবু সহকারী শিক্ষকদের যেমন কড়া অনুশাসনে রাখতেন তেমন ভালোও বাসতেন। অতনু বা অন্যান্য শিক্ষকদের এতে অসুবিধা ছিল না। অতনু অনুশাসন পছন্দ করে, তাই এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে একটা দিনও তার স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়নি। প্রার্থনার পর ধমক দিয়ে চন্দনবাবুকে কোনোদিন বলতে হয়নি, ‘ক্লাসে চলে যান।’

কঠোর অনুশাসন আর সকলের সহযোগিতা না থাকলে চন্দনবাবুর স্কুল ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’ ও ‘স্বচ্ছ বিদ্যালয় পুরস্কার’ পেত না। এমন সুন্দর স্কুল ছেড়ে ট্রান্সফার নিতে অতনুর মন চাইছিল না। শুধু স্ত্রীর জেদাজেদিতে মিউচুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে অতনু চলে এসেছে আনন্দপুর সেখপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অতনু জয়েন করায় একজন মহিলা সহ স্কুলের মোট শিক্ষক এখন পাঁচ জন। ছাত্রসংখ্যা মন্দ নয়, দু’শো ত্রিশ। অতনুর আগের স্কুলের তুলনায় এই স্কুলের অবস্থা নিতান্তই খারাপ। অত্যন্ত অগোছালো একটা অফিস ঘর, স্কুল বিল্ডিংয়ের অবস্থা দেখলে মনে হবে গত বেশ কয়েক বছর সরকারি কোনো অনুদান স্কুলে প্রবেশ করেনি। স্কুলের বহু কাজই অসমাপ্ত পড়ে আছে। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো বসার বেঞ্চ নেই। যে ক’টা আছে তাদেরও অবস্থা শোচনীয়। ক্লাসরুম নোংরা, ছেলে-মেয়েরা স্কুলে আসে না। অতনুর স্কুল পছন্দ নয়। আগে এসে সে কেন স্কুলটা দেখে নেয়নি ভেবে মনে মনে নিজেকেই তিরস্কার করল একবার।

অতনু জয়েন করার দিনই বিমলবাবু স্কুল বিল্ডিং ঘুরিয়ে দেখানোর সময় বলেছিলেন, ‘আপনার আগের স্কুলের হেডস্যার কেমন ছিল জানি না তবে এখানে আপনার কোন চাপ নেই। হেডস্যার নিজামবাবু খুব ভালো মানুষ। সাতে পাঁচে থাকেন না।’

অতনুর বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব যেমন কমেছে তেমনি মনের শান্তিও লোপ পেয়েছে বহুগুণে। নতুন স্কুল তার মোটেও ভালো লাগেনি। সহকর্মীরাও একেক জন একেক রকম। কেউ শাসকদলের রাজনীতি করেন তো কেউ বিরোধী। একজন সারাক্ষণ প্রেমিকের সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত। আর হেডস্যারের কথা তো আগেই বলে দিয়েছেন বিমলবাবু। নিতান্তই ভালো মানুষ, সাতেও নেই পাঁচেও নেই! যে মানুষটা কোনো কিছুতেই নেই, সেই মানুষটা ভালো মানুষ হয় কোন যুক্তিতে অতনু কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিল। বিমলবাবুর বাড়ি সেই পশ্চিম মেদনিপুরের চন্দ্রকোনা থেকে আরো প্রান্তিক এলাকায়। তার উপর আবার শাসকদলের রাজনীতি করেন। কাজেই তাঁর সুযোগ সুবিধা একটু বেশিই পাওনা নিজামবাবুর কাছ থেকে। শুক্রবার হাজিরা খাতায় সই করে দিয়েই বারোটা কুড়ির ট্রেন ধরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন আর ফেরেন মঙ্গলবার। ভালোমানুষের কৃপায় হাজিরা খাতায় তাকে কখনও সিএল বসাতে হয় না।

স্কুলে পাঁচজন টিচার থাকলেও একসঙ্গে পাঁচজনের দেখা মেলা ভার। একজন টিচার মাসের অর্ধেক দিন ছুটি ভোগ করবেন আর বাকিরা কী অপরাধ করল! তাই ওই ভালো মানুষের কৃপায় ছুটির বরাদ্দ সকলের জন্যেই সমান। অতনু অতিশয় বোকা ছেলে না হলে সেও নিজের ভাগের ছুটি নিয়ে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মধুমিতাকে নিয়ে প্রতি মাসে একবার করে শ্বশুর বাড়ি ঘুরে আসতে পারত। কিন্তু তা না করে প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে কোন মাস্টার স্কুলে আসেনি, কে ক্লাসে না গিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়েছে, কে দেরি করে এসেছে বোকার মতো মধুকে শোনাতে থাকে। রোজ রোজ একই কথা শুনতে কার ভালো লাগে! তাই সেও বিরক্ত হয়ে বলে দিয়েছে, ‘ওরা সবাই ঠিক করে। কাল থেকে তুমিও ওদের মতোই করবে।’

অতনু যে ওদের মতো পারে না, সে কথা মধুকে বোঝাবে কে? সে ভালো শিক্ষক হতে চায়। এটাই তার অ্যাম্বিশন। সে শুধু অর্থের জন্য শিক্ষকতা করতে আসেনি। সে সমাজ গড়ার কারিগর হতে চায়। সমাজের এই অবক্ষয় সে সহ্য করতে পারে না। তার কষ্ট হয়।

অতনু তার নতুন স্কুলকে অন্য টিচারদের সহযোগিতা ছাড়াই একক প্রচেষ্টায় সুন্দর করে গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সহবত জ্ঞান, নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে আসা, প্রার্থনা করা, ক্লাস রুম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি শেখায়। অল্প দিনে ছাত্রদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অতনু। তার কার্যকলাপ দেখে অন্যান্য টিচারদের ঈর্ষার অন্ত নেই।

আজ শ্রাবন্তী ম্যাডাম স্কুলে আসেননি। বিদেশবাবু আর বিমানবাবু স্কুলে ঢুকেই নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে ডিবেট শুরু করে দিলেন। অতনু রাজনীতি একদম পছন্দ করে না। তাই ওদের ডিবেটের মধ্যে থাকবে না বলে একটু তাড়াতাড়িই ক্লাসে চলে গেল। বারোটা বেজে গেছে তবু কেউ ক্লাসে ঢোকেনি। নিজামবাবু ওদের ক্লাসে না পাঠিয়ে তিনিও ওদের ডিবেটের মাঝে একটু করে সুড়সুড়ি দিয়ে ডিবেট আরো জমিয়ে তুলছেন। এদিকে ক্লাসে মাস্টার নেই তাই ছেলেরা লাফালাফি, মরামারি, চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। পাশের ক্লাসে থেকে ছেলেরা এসে বারবার এ ওর নামে, সে তার নামে নালিশ করে যাচ্ছে। অতনু বিরক্ত হয়ে পাশের ক্লাসে গিয়ে সকলকে শান্ত করে দিয়ে বেরিয়ে এলেও কিছুক্ষণের মধ্যে আবার একই শব্দ কানে আসে। কীকরে ক্লাস নেবে! শেষে নিজেই অফিসে গিয়ে দু’জনের ডিবেটের মধ্যে ঢুকে ক্লাসের পরিস্থিতি বর্ণনা করলে দু’জন স্যারই প্রেজেন্টের খাতা হাতে নিয়ে ক্লাসে চলে যান। কিছুক্ষণ পরে আবার সেই চিৎকার। ক্লাসে গিয়ে অতনু দেখল পাশাপাশি দু’টি ক্লাসেই টিচার নেই। অতনু নিশ্চিত হল, লোকে কেন বলে সরকারি স্কুলে পড়াশোনা হয় না। আসলে কিছু মানুষ আছে যারা সরকারি চাকরি পেলে নিজেকেই সরকার মনে করে।

এ তো গেল ফার্স্ট হাফের কথা। সেকেন্ড হাফেও সেই একই ডিবেট, ওরা কেউ ক্লাসেই গেল না। অতনুর সব থেকে বেশি অবাক লাগল নিজামবাবু একজন স্যারকেও বললেন না ক্লাসে যাওয়ার জন্যে!
আবার ছেলেরা স্কুলে হৈ হৈ, লাফালাফি মারামারি করতে লাগল। এমন সময় ক্লাস ফোরের
দু-তিন জন ছেলে ছুটে এসে বলল, ‘স্যার… আকাশের মাথা ফেটে গেছে!’

সঙ্গে সঙ্গে অতনু ছুটে গিয়ে দেখে রক্তে গোটা জামা লাল হয়ে গেছে। অতনু দেরি না করে একজন ছাত্রের জলের বোতল থেকে সব জল মাথায় ঢেলে দিল। তারপর ক্ষতস্থান চিহ্নিত করে সেখানে চেপে ধরল। ততক্ষণে নিজামবাবু আর অন্যান্য টিচাররা ছুটে এসেছেন। কিছুক্ষণ পরে রক্ত পড়া বন্ধ হলে অতনু হাতটা ক্ষতস্থান থেকে সরিয়ে দেখল আঘাত খুব অল্প কিন্তু রক্ত বেরিয়েছে অনেক। অতনু নিজামবাবুকে বলল, ‘স্যার ফার্স্টএইড বক্স কোথায় আছে? একটু তুলো আর ডেটল লাগবে।’

নিজামবাবুর উত্তর এল, ‘স্কুলে তো ফার্স্ট এইড বক্স নেই। ওকে নিয়ে বরং ডাক্তারখানায় চলে যান।’
‘স্কুলে একটা ফার্স্ট এইড বক্স থাকবে না!’ অতনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তার আগের স্কুলের কথা একবার ভাবল। মনেমনে কষ্ট পেল ট্রান্সফার নেওয়ার জন্য। এখানে সে রোজ যা দেখে, তা তার কাছে কোনো নরকযন্ত্রণা অপেক্ষা কম নয়। তাকে যে এই নরকযন্ত্রণা আর কতকাল সহ্য করতে হবে কে জানে!

ছেলেটির ফার্স্ট এইড হলো না। খবর পেয়ে ছেলেটির বাবা এসে ছেলেটিকে বাড়ি নিয়ে গেছে। আজ ক্লাসে টিচাররা যায়নি, আবার এই দুর্ঘটনা। অতনুর মেজাজ গরম হয়ে ছিল। সে নিজামবাবুকে বলে ফেলল, ‘আপনি ক্লাসে টিচারদের পাঠিয়ে দিলে আজ এই ঘটনা ঘটত না। ক্লাসে টিচার না থাকলে ছেলেরা তো মারামারি করবেই!’

অতনুর কথায় বাকি দু’জন টিচার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। বিদেশবাবু তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন, ‘স্কুলে ছেলেরা যদি মারামারি করে মাথা ফাটায় সেই দায় কি মাস্টারদের? আমরা কি ছেলেদের দেখাশোনা করার ঠিকা নিয়ে বসে আছি!’
বিদেশবাবুর কথায় অতনু অবাক। এই স্কুলে আসার দিন থেকে সে অনেক অন্যায় দেখেছে কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করেনি। আজ যেন তার সমস্ত জমে থাকা প্রতিবাদ এক হয়ে পিশাচের মত ভর করেছে তার জিহ্বাটিকে। আজ নিজের অজান্তেই একের পর এক অপ্রিয় সত্যগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে আবার বলল, ‘না না, মাস্টারদের দায় তো শুধু ইচ্ছামতো স্কুলে আসা যাওয়া আর আড্ডা মারা!’

নিজামবাবু সাতে পাঁচে না থাকলেও অতনুর কথার প্রতিবাদ করে বললেন, ‘দেখুন আপনার এসব কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে থানায় যান, এসআই-কে গিয়ে জানান।’

‘এসআই-কে তো জানাবোই ডিপিএসসি-তেও জানাবো। মেন তো আপনি, আপনার নামেই সব জানাবো। আপনি কেন টিচারদের এত ছুটি দেন, দেরি করে এলেও কিছু বলেন না। আমি জানি না মনে করেছেন। যাতে কেউ আপনার বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে। মিড-ডে মিল খাচ্ছে ত্রিশ-চল্লিশ জন আপনি দেখাচ্ছেন একশো আশি-নব্বই জন। তার পরেও কাঁদুনি গাইছেন এই পাঁচটাকা পঁয়তাল্লিশ পয়সায় কি করে খাওয়াবো। আপনি ছাত্র পিছু পাঁচগুন টাকা নিয়েও বছরে একদিন ছেলেদের ভালো খাওয়াতে পারেন না। কী করছেন সেই টাকা? স্কুলে যত টাকা আসছে সেই টাকায় কী কাজ করছেন তারও কোনো হিসেব নেই। সেই হিসেব যাতে কেউ না চায় তাই আপনি টিচারদের ছুটি দিয়ে ভুলিয়ে রাখছেন!’
অতনুর কথা শুনে নিজামবাবুর মুখ লাল হয়ে উঠল। বাম হাতটা বুকের মাঝখানে চেপে ধরে ডান হাতে চেয়ারের একটা হাতল শক্ত করে ধরল। মুহুর্তের মধ্যে গোটা শরীর ঘামে ভিজে গেল। বিমলবাবু সঙ্গে সঙ্গে নিজামবাবুর হাতটা ধরে বললেন, ‘শরীর খারাপ লাগছে? জল খাবেন?’

বিদেশবাবু বললেন, ‘মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক। ওঁকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।’
অতনু নির্বাক। সে বোধহয় একটু বেশিই বলে ফেলেছে। এতটা বলা তার উচিত হয়নি। উপায় না দেখে নিজামবাবুকে নিয়ে বাইকে করেই হাসপাতালে ছুটলেন বিদেশবাবু আর বিমলবাবু।

পরদিন উকিল অনেক চেষ্টা করেও অতনুর জামিন করাতে পারেনি। চারদিন পরে তাকে পুনরায় আদালতে পেশ করা হবে। ঘটনার সাক্ষী দু’জন টিচারই বলেছেন অতনু স্যারকে মাটিতে ফেলে পাগলের মতো বুকে লাথি মেরেছে। কিন্তু অতনুর বক্তব্য স্যারের সঙ্গে তার শুধু কথা কাটাকাটি হয়েছে। সে স্যারকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। এখন পোস্টমর্টেম রিপোর্টটাই একমাত্র ভরসা। আজ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থানায় আসার কথা। তাই উকিল নিয়ে থানায় হাজির হয়েছেন অতনুর বাবা। তিনি থানায় গিয়ে পুলিশের কথায় স্তম্ভিত। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক লেখা থাকলেও শরীরের কয়েকটা জায়গায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, মানে অতনুর জেল নিশ্চিত। অতনু বাবার কাছ থেকে সব শুনে বলল, ‘বাবা চিন্তা করো না। যা হবার হবে।’

বাবার অশ্রু ভেজা ঝাপসা দু’টি চোখ অতনুর দুঃখ যন্ত্রনায় ফিকে হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকাল একবার। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘চিন্তা করবো না! তোর অ্যাম্বিশানের কী হবে তাহলে?’
অতনু মৃদু হেসে বলল, ‘কারাবাস।’

News Hub